দেশে তখনো ওয়ান-ইলেভেন সরকার আসেনি। আসবে কি না তাও দৃশ্যমান নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন এক সাসপেন্সের নাম জাতীয় পার্টি। পার্টির প্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছে না। কেন লুকিয়ে আছেন তাও কেউ জানে না। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটের সঙ্গে তিনি আছেন তখন। তবে বিএনপির অবস্থা ভালো না। একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, লোডশেডিং মিলিয়ে বিএনপির জেরবার দশা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ রাজপথে খুব সরব। নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে- এমনটা বিশ্বাস করা লোকের সংখ্যাই বেশ ছিল তখন। এরমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানকে নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক টানাপড়েন শেষে নির্বাচনের উত্তজনা চলছে। সেই সময়ে নতুন সাসপেন্স হিসেবে লাপাত্তা হয়ে গেলেন এরশাদ।
তিনি হুট করে একদিন ফিরলেন আওয়ামী লীগের সমাবেশে। গুলিস্তানের সেই সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো মহাজোটের। চার দলীয় জোটের এরশাদ যোগ দিলেন মহাজোটে। দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনের পর সে জোট থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার দল পেল ২৭ আসন।
সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করেন। সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতায় থেকে দলটি গঠন করেন।
ঊনিশশ নব্বই সালের গণঅভ্যুত্থানে তার পতন হলেও জেলে থেকেই এরশাদ দলটির প্রত্যাবর্তনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এরশাদ নিজে পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেন এবং তার দল পঁয়ত্রিশটি আসন পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এবং দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেও জেনারেল এরশাদ প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতা এবং ভোটের রাজনীতিতে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে পেরেছিলেন।
সংবাদমাধ্যমের খবর, এরপর ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে জেনারেল এরশাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সাথে থাকতে হয়েছিল। সে সময় দলটির নেতাদের অনেকের কথায় সেই অস্বস্তির কথা চাপা থাকেনি। সে সময়েও দলটিকে ঘিরে নানা ধরনের তৎপরতা দেখা গিয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়ার পেছনে ভারতের চাপ ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের ঢাকায় এসে এইচএম এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নিতে বলেন। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ দেশের ভেতরে রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। কারণ তারা একই সাথে সরকারের অংশ ছিল এবং সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটি একটি বিরল ঘটনা।
ওই নির্বাচনে নিজের আসনে এরশাদ শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে চাইলেও তা কার্যকর হয়নি। তিনি এমপি নির্বাচিত হন এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত নিযুক্ত হন।
জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে জাপা নেতা মুজিবুল হক বলেন, তারা কয়েকজন ২০১৪ সালে দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সঙ্গে বেইমানি ও বিদ্রোহ করে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তারা সেই নির্বাচনে না এলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হতো।
‘২০১৪ সালের নির্বাচন জাতীয় পার্টি বর্জন করেছিল। আমাদের চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তিনি চূড়ান্ত সময় বললেন নির্বাচন করবেন না এবং সারা দেশের সব প্রার্থীকে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য চিঠি দেন। নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করে নেন। সেদিন এমন একটা অবস্থা হয়েছিল…বিএনপি নির্বাচনে আসে না, কোনো দল আসবে না। জাতীয় পার্টি যদি না আসে (নির্বাচন) তাহলে বাংলাদেশে একটা অসাংবিধানিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হতো।’
মুজিবুল হক বলেন, ‘সেই দিন বেগম রওশন এরশাদ এবং আমরা কয়েকজন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে বেইমানি ও বিদ্রোহ করে বেগম এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচন করেছিলাম।’
২০১৪ সালের নির্বাচনে লালমনিটরহাট-১ আসনে এরশাদের প্রার্থিতা প্রসঙ্গে মুজিবুল হক বলেন, সে নির্বাচনে এইচ এম এরশাদ লালমনিরহাট, রংপুরসহ কয়েকটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। রংপুরেও তিনি নির্বাচন করতে চাননি।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও এইচ এম এরশাদকে সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। সেবার নির্বাচনে যাবেন না বলে ঘোষণা দেয়ার পরই তাকে জোর করে সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও এরশাদ হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে সেই নির্বাচনে বিএনপিসহ সবাই অংশ নেয়। একাদশ সংসদে আওয়ামী লীগের সাথে থেকে জাতীয় পার্টি ২২টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে। তবে এবার সরাসরি কোনো সরকারি পদে তারা নেই।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যান হুসেই মুহাম্মদে এরশাদ। তার মৃত্যুর পরও দলের পদ, অর্থ-সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। যদিও এরশাদ মারা যাওয়ার আগে তার ভাই জিএম কাদেরকে দলীয় প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যান। তবে এর বিরোধিতা করেন রওশন এরশাদ। এদের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বিরোধে জড়ান বিদিশা এরশাদ। রওশনের সঙ্গে সাদ এরশাদ এবং বিদিশার সঙ্গে এরিক এরশাদ যোগ দেন পারস্পরিক দ্বন্দ্বে। তবে রওশনকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সম্মান দিয়ে জিএম কাদের পরিস্থিতি সামাল দেন। লোকবল ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা না পেয়ে বিদিশা এখন চুপ আছেন।
এ ছাড়া দলের চেয়ারম্যান পদ, বিরোধী দলীয় নেতার পদ, চিফ হুইপের পদ, সম্মেলন-সব কিছু নিয়ে বিরোধে জড়ান রওশন ও জিএম কাদের। আওয়ামী লীগের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন রওশন এরশাদ। আর বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছেন জিএম কাদের। চলতি মাসে তিনি ভারত সফরে যান। তার এ সফরের সময় আবার বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন রওশন। যদি দ্রুতই অস্বীকার করেন তিনি।
জিএম কাদের গত কয়েক মাস ধরে সরকার বিরোধী নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। দলটির কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি তাদের ‘সরকার বিরোধী’ অবস্থান তুলে ধরতে চায়। নির্বাচনে দলটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এ বিষয়টিকে তারা অনেক জরুরি মনে করেন।
যদিও ভারত সফর শেষ করার পর থেকে জিএম কাদের চুপ আছেন। তিনি ভারতীয় সংবদমাধ্যমকে বলেছেন তার একটি ফর্মুলা আছে। দেশের সাংবাদিকদেরও বলেছেন একই কথা। তবে ফর্মুলাটা কী কেউ জানে না। ভারতের অনুমতি ছাড়া ভারত সফর নিয়ে কিছু বলতে রাজি না হওয়ায় তিনি সমালোচিত হচ্ছেন। জাতীয় পার্টির ওপর ‘ভারতের চাপ’ এখনো রয়ে গেছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত কী হয় বলা যায় না। জাতীয় পার্টি কোন অবস্থান নেবে তার বোঝা মুশকিল। তাদের দলে যেন শেষ কথা বলে কিছু নেই।
Discussion about this post