মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহীদের তৎপরতা গত এক মাসে বেড়েছে অনেকগুণ। অঞ্চলগুলোতে বিদ্রোহীরা সামরিক সরকারের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশ কিছু সফলতা দেখিয়েছে। গত তিন বছরের সেনা শাসনের শুরু থেকেই বিদ্রোহী তৎপরতা ছিল; কিন্তু এবারের মতো এতটা চ্যালেঞ্জে আগে কখনো পড়েনি সামরিক জান্তা। গত এক মাসে চীন সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহীরা। অনেকগুলো সেনা চৌকি দখল করেছে তারা। সেনা সদস্যদের আত্মসমর্পণের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। যে কারণে দেশটিতে বড় ধরনের গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, সেনা সরকারের নিয়োগকৃত প্রেসিডেন্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন- এই অবস্থা চলতে থাকলে মিয়ানমার বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে। দেশটির জনগণের মাঝে সামরিক জান্তার জনসমর্থন নেই বললেই চলে, যেটি সেনাবাহিনীকে নৈতিকভাবে দুর্বল করছে। এছাড়া তাদের বিদেশী বন্ধুদের ভূমিকাও রহস্যময়। চীন ও থাইল্যান্ডের সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহীদের তৎপরতা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, ওই দেশগুলোর নিরব সমর্থন হয়তো পাচ্ছে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো। এই ধারণা সত্যি হলে ধরে নিতে হবে, মিয়ানমার আগামী দিনে আরো বড় বিশঙ্খলায় জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২১ সালে অং সান সু চি সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের পর এতটা বিপদে আর পড়েনি সামরিক বাহিনী। ওই অভ্যুত্থানের পর দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন চলে দেশটিতে। সেই আন্দোলনের ওপর ধরপাকড় ও নির্যাতনের কারণে এক সময় তা রূপ নেয় সশস্ত্র বিদ্রোহে। এতদিনের বিদ্রোহী তৎপরতাকে এবার বেশ সংগঠিত ও পরিকল্পিত বলে মনে হচ্ছে। বিদ্রোহীরা বেশ আটঘাঁট বেঁধেই মাঠে নেমেছে হয়তো। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষক ও মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ অরনল্ড সিএনএনকে বলেছেন, জান্তা খুব জোরেশোরেই ধসের দিকে যাচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে কারণ দেশজুড়ে একযোগে বিদ্রোহীদের তৎপরতা চলছে। এই বিশ্লেষক মনে করেন, সামরিক সরকারের জন্য এখন অস্তিত্বের প্রশ্ন এসে সামনে হাজির হয়েছে। বিদ্রোহীরা ছোট শহর দখলের পর এখন বড় শহরের দিকে নজর দিচ্ছে। যাতে তারা জান্তাকে পুরোপুরি পরাজিত করতে পারে।
গত অক্টোবরে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে সম্মিলিত জান্তাবিরোধী অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের কয়েকটি বিদ্রোহী গ্রুপের জোট। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলো একযোগে আঞ্চলিক শহরগুলো দখলের আক্রমণ শুরু করে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন পর্যায়ের শহর ও গ্রামাঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর এই জোটের সদস্য হলো- তা’য়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), কোকাং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমাক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), আরাকান আর্মি (এএ) ও তাদের সংশ্লিষ্ট পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস। এই জোটের টার্গেট এবার পুরো দেশকে জান্তার কবল থেকে মুক্ত করা। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু জায়গায় সফলতা দেখিয়েছে তারা। বিশেষ করে চীন সীমান্তবর্তী অঞ্চল এখন অনেকটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে। গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত গেটও নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহীরা। যে গেট দিয়ে দুই দেশের স্থল বাণিজ্যের প্রধান অংশ পরিচালিত হয়।
মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সাথে চীনের সম্পর্ক বরাবরই ভালো ছিলো। দেশটিতে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। যে কারণে তারা চায় মিয়ানমার স্থিতিশীল থাকুক। কারণ এতে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষিত হবে। তবে দেশটির বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সাথেও চীনের সম্পর্ক খারাপ নয়। অর্থাৎ দুই পক্ষের সাথেই বেইজিংয়ের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। তবে এবার চীন-সীমান্ত এলাকায় হঠাৎ বিদ্রোহীদের এই তৎপরতার পেছনে চীনের সহযোগিতার সম্পর্ক আছে কি না সেটি স্পষ্ট নয়। চীন বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন দিচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। তাদের যুক্তি, বেইজিংয়ের নিরব সমর্থন না থাকলে চীন সীমান্ত এলাকায় এতটা দাপট দেখানো সম্ভব হতো না।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব মঙ্গোলিয়ার পিএইচডি গবেষক অ্যান্তোনিও গ্রাসিফো তার এক লেখায় বলেছেন, মিয়ানমারের জাতিগত গ্রুপগুলোর ওপর চীনের প্রভাব রয়েছে। এমনকি চীনা অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায়ও কাজ করে এই গ্রুপগুলো। বিশেষ করে চীনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তায় জাতিগত বাহিনী নিয়োজিত আছে। এই বাহিনীগুলোই আবার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। যে জান্তাকে সমর্থন দিচ্ছে চীন।
কাজেই উভয় পক্ষই চীনের সমর্থন পাওয়ার আশায় রয়েছে। এবার চীন বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে; কিন্তু সেটি মিয়ানমারে চীনা স্বার্থের পক্ষে অনুকূল নয়। তারপরও যদি চীন বিদ্রোহীদের প্রতি সুদৃষ্টি দেয়, সেটি নিশ্চিতভাবেই জান্তা সরকারের জন্য পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলবে।
রক্তক্ষয়ী এই লড়াইয়ে সামরিক বাহিনী অস্ত্র সহযোগিতা পাচ্ছে রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের কাছ থেকেও। তাদের রয়েছে বিদ্রোহীদের তুলনায় উন্নত সমরাস্ত্র। বিমান হামলা চালাতে পারছে তারা। তবে মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে, সেটি সেনাবাহিনীকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিমান হামলায় সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক জায়গায় পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। উদ্বাস্তু হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। এটি সাধারণ জনগণের সহানুভূতি পেতে সাহায্য করছে বিদ্রোহীদের। তারা দুর্গম এলাকাগুলোতে স্থানীয়দের সহানুভূতি পাওয়ার ফলে লড়াইয়ে সুবিধা পাচ্ছে। সাধারণ জনগণের সমর্থন না পেলে সেনাবাহিনীর পক্ষে লড়াই করা কঠিন। তাছাড়া কিছু এলাকায় সেনা সদস্যদের আত্মসমর্পণের খবরও গোটা বাহিনীর মনোবলে চিড় ধরাতে পারে।
যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বশেষ খবরাখবর বলছে, সীমান্তবর্তী চিন, শান রাজ্যসহ কয়েকটি রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকার ওপর সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেই। কায়াহ প্রদেশে বিদ্রোহীরা প্রাদেশিক রাজধানীর খুব কাছে পৌঁছে গেছে। দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও দূরবর্তী এলাকার অনেক শহর এখন বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। বিদ্রোহীদের এই অগ্রসরতার খবরে সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিছু কিছু সূত্র জানাচ্ছে, রাজধানী নেপিদোর নিরাপত্তা জোরদার করতে সেখানে অতিরিক্ত ১৫ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। বিশাল দেশ মিয়ানমারের সর্বত্র লড়াই করার মতো পর্যাপ্ত সৈন্যও দেশটির নেই বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে বিদ্রোহীরা স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হওয়ার কারণে নিজ নিজ এলাকায় লড়াইয়ে সুবিধা পাচ্ছে। আবার হয়তো দেখা যাচ্ছে, একই শহরে দু’দিক থেকে দুটি গ্রুপ একযোগে আক্রমণ করছে। যার ফলে সেনাবাহিনী হয়ে পড়ছে দিশেহারা।
মোট কথা, মিয়ানমার যে বড় ধরনের একটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে সেটি নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। বিদ্রোহীদের এই অগ্রসরতা অব্যাহত থাকলে তারা ছোট শহর পার হয়ে বড় শহরেও পৌঁছে যাবে। সাধারণ জনগণও বিদ্রোহীদের মাধ্যমে জান্তার শাসন থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে জান্তা সরকার মিডিয়ার সাথে কথা না বলার নীতি গ্রহণ করেছে। তবে তারা স্বীকার করেছে যে, জটিল সমস্যা শুরু হয়েছে। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএন তাদের এক বিশ্লেষণে মিয়ানমার পরিস্থিতিকে জান্তা সরকারের ‘শেষের শুরু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সংবাদ মাধ্যমটির ভাষ্যমতে, বিদ্রোহীদের হাত ধরেই দেশটি আবার গণতন্ত্র ফিরতে পারে।
তবে সশস্ত্র এই লড়াইয়ের মাধ্যমে জান্তাকে পরাজিত করা সহজ হবে না হয়তো। বিশেষ করে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে জান্তা সরকারের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক। তারপরও বিদ্রোহীরা সফল হলেও দেশে স্থিতিশীলতা আসতে সময় লাগবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যেও রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ লেগে যেতে পারে। কাজেই সব কিছু মিলেই মিয়ানমার হয়তো খাদের গভীর থেকে আরো গভীরে চলে যেতে পারে।
Discussion about this post