সরকার আবারও বিএনপিকে নিষ্ক্রিয় করার কাজে পুলিশ বাহিনীকে মাঠে নামিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতার বাসায় পুলিশ হানা দিয়েছে, অনেকের নামে মামলা করেছে। গত কয়েক দিনের কয়েক হাজার গ্রেফতারের পর গতকাল ঢাকায় ৫৪৮ জন, ঢাকার বাইরে ১,১১২ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মাত্র কয়েকদিন বাকি। তার আগে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে এমন আচরণ সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সব সম্ভাবনাকে কার্যত বাতিল করে দিল। দুই দলের ভেতর সংলাপ-সমঝোতার অবকাশও রইলো না।
সরকারি দল বলছে, শনিবার (২৮ অক্টোবর) বিএনপি মহাসমাবেশের নামে তাণ্ডব চালিয়েছে, পিটিয়ে পুলিশ মেরেছে। তার জেরে পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় অচল করে দিয়েছে এবং নেতাদের গ্রেপ্তার করছে।
তবে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সরকারের এ আচরণকে অনেকেই উদ্দেশ্যমূলক মনে করছেন। সরকার নির্বাচনে বিএনপিকে আনার ব্যাপারে আন্তরিক, শনিবারের ঘটনা থেকে এটা মনে হচ্ছে না তাদের কাছে।
শনিবারের সমস্যাটা শুরু সমাবেশের একটা প্রান্ত থেকে। ওখানেই সেটা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। যদি সরকার মনে করতো যে, সামনের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করা দরকার। সেক্ষেত্রে বিএনপির নেতাকর্মীদের কোনো আইন ভাঙার ঘটনা কাকরাইল মোড়েই শেষ করে দেওয়া যেত। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা যেত। পুলিশ কেন বিএনপির সমাবেশের দিকে আওয়ামী লীগের গাড়ি ঢুকতে দিল সেই প্রশ্নও আর উঠত না। কিন্তু উঠছে। কারণ পুলিশ একটি প্রান্তের সংঘর্ষের জেরে পুরো সমাবেশ ভণ্ডুল করে দিয়েছে। তাদের আয়োজন দেখে মনে হয়েছে, প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। সেদিন আর কোনো সমাবেশ নিয়ে সমস্যা হলো না, শুধু বিএনপির সমাবেশকেই তারা ভণ্ডুল করে দিল।
অনেকে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে শনিবার বিকেল থেকে বলতে শুরু করলেন, বিএনপি হেরে গেছে। কিন্তু তারা একটু খতিয়ে দেখছেন না যে, নির্বাচনের কী হবে এখন? আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে কিছু খুচরা দল মিলে আরেকটি একপেশে নির্বাচন কার জন্য সুফল বয়ে আনবে। কোন সংকট এতে দূর হবে?
আপাতদৃষ্টিতে সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য তারা কোনো চাপ অনুভব করছে না। বিএনপি এবং তাদের সঙ্গে থাকা কিছু ছোট দলের চাপ তারা আমলে নিচ্ছে না। এ ভাবনা হয়তো তাদের মধ্যে আছে যে, বিএনপির ওপর প্রচণ্ড নিপীড়ন চালিয়ে যদি তাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেলা যায়, তাহলে আর সমস্যা হবে না কোনো। কারণ গণমাধ্যম, সুশীল সমাজের অনেকেই একচোখা সরকারপন্থী নীতি নিয়ে রেখেছে। আওয়ামী লীগ যে কোনো উপায়ে জিতে গেলেই তারা যেন ভালো থাকবেন। অথচ কেউ ভালো নেই। গণমাধ্যম অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় তীব্র সংকটে ভুগছে। বেশিরভাগ গণমাধ্যম পাঠক-দর্শক হারিয়েছে। তাদের বিশ্বস্ততা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। ব্যবসায়িকভাবে টিকে থাকাও অনেকের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে সংবাদমাধ্যমের অবস্থানকে জোরদার করার চেষ্টা বা ইচ্ছাও তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সুশীল সমাজও সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। বিভিন্ন সময়ে তারা নানা চাপের কথা বলেন। তবে যখন সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের সমালোচনা করার প্রশ্ন আসে, তারা সেটা করেন না। শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষেই কথা বলেন। বিরোধীদের সমালোচনা করেন। বাস্তব পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে সংলাপের ওপর জোর দেন।
বিএনপি মহাসচিবকে গ্রেপ্তারের পর বিএনপির অধিকাংশ নেতাই এখন কারান্তরীণ। বিশ্বের কয়টি গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের এমন অবস্থা হয়েছে? এভাবে একটি বিরোধী দলের ওপর সর্বাত্মক চাপ সৃষ্টির পর সংলাপ কীভাবে সম্ভব? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অবশ্য সংলাপের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ আগ বাড়িয়ে কোনো সংলাপের উদ্যোগ নেবে না। চারটি মূল বিষয়কে বাইরে রেখে বিএনপির যদি শুভবুদ্ধির উদয় হয়, তাহলে সংলাপ হতে পারে।
তার সেই চারটি মূল বিষয় হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর ফিরবে না, শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, সংসদ আগামী ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থিতাবস্থায় থাকবে এবং নির্বাচন কমিশন যেমন আছে তেমনই থাকবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপি থেকে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করারও সুযোগ নেই। কারণ, সেখানে শুধুমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই অংশ নিতে পারবেন।
এ অবস্থায় একমাত্র বাইরের চাপ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এ দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য অনুকূল না। বরং বিএনপিকে বাইরে রেখে আরেকটি সাজানো নির্বাচনের দিকেই বেশিরভাগ ‘পাওয়ার হাউজের’ সম্মতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ শুরু করেছে। যুক্তরাজ্যও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে তাদের অবস্থান ক্রমাগত ঘোষণা করে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া তাদের অবস্থান ঘোষণা করেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময় অর্থনৈতিক ইস্যুতে প্রাধান্য পায়, তাই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না হলে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে না।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও দেশ আরও রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগ সরকার বিষয়টিকে কতটা আমলে নিচ্ছে তাও বোধগম্য নয়। জিনিসপত্রের লাগামহীন দামে মানুষ দিশেহারা। রাজনৈতিক সংকট থাকলে দাম আরো বাড়বে। ইতিমধ্যে বিএনপি একদিনের সফল হরতাল কর্মসূচি পালন করেছে। এক যুগেরও বেশি সময় পর ডাকা হরতাল সফল হবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। তবে হরতাল সফল হয়েছে। পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে বিএনপি তিন দিনের অবরোধের ডাক দিয়েছে। এ অবরোধ কতটা সফল হবে সে নিশ্চয়তা নেই। কারণ বিএনপির কোনো নেতাই এখন বাসায় থাকতে পারছেন না। তাদের কার্যালয় তালা দেওয়া। পুলিশ ক্রাইম সিন টেপ দিয়ে সে জায়গা ঘিরে রেখেছে।
ইতিমধ্যে অসংখ্য গাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। একটি ঘটনায় ডিবির ভেস্ট পরে বাসে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের অভিযোগ আগেও উঠেছে। এ বিষয়গুলো বিএনপি কতটা মোকাবিলা করতে পারবে তা এখন দেখার বিষয়।
সার্বিক বিবেচনায়, বিএনপিকে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। ভেতর থকে চাপ তৈরি করতে হবে। যতই নিপীড়ন চলুক, নেতাকর্মীদের বিপুল উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে সফল কর্মসূচি পালন করে যেতে হবে।
Discussion about this post