শুক্রবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য’ নামে নতুন ছাত্রজোট আত্মপ্রকাশ করেছে। সরকারবিরোধী ১৫ ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এ জোট।
এই জোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাঈফ মাহমুদ। সমন্বয়ক নির্বাচিত হয়েছেন তিনজন। তাঁরা হলেন, ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদীব। ১৫ ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা কেন্দ্রীয় সমন্বয় পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যের ১৫ ছাত্র সংগঠন হলো- জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্রলীগ (জেএসডি), গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (এলডিপি), নাগরিক ছাত্রঐক্য, জাগপা ছাত্রলীগ, ছাত্র ফোরাম (গণফোরাম-মন্টু), ভাসানী ছাত্র পরিষদ, জাতীয় ছাত্র সমাজ (কাজী জাফর), জাতীয় ছাত্র সমাজ (বিজেপি-পার্থ), জাগপা ছাত্রলীগ (খন্দকার লুৎফর), ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ, বিপ্লবী ছাত্র সংহতি এবং রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলন।
তবে এ জোটে নেই উল্লেখযোগ্য কোনো ইসলামি ছাত্রসংগঠন। একমাত্র ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ আছে। যেটি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠন।
জানা যায়, গত ২৭ আগস্ট বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ১৯ ছাত্র সংগঠন নিয়ে বৃহত্তর ছাত্রঐক্য গঠনের লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনও অংশ নেয়। পরে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে ছাত্রদলের সঙ্গে শুধু মঞ্চভুক্ত সংগঠনের ঐক্য করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে বিএনপি সাড়া না দিলে আরো কিছু সংগঠনকে যুক্ত করার প্রস্তাব ওঠে।
এ বিষয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন ও দলটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের সভা হয়। সেখানে ছাত্রঐক্যের ‘স্টিয়ারিং’-এ ছাত্রদলের পর গণতন্ত্র মঞ্চের ছাত্র সংগঠনকে রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
‘বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারে আন্দোলনরত দলগুলোর ৩১ দফা বাস্তবায়ন’, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘মানবিকতার বিকাশ, নৈতিকতা বোধের উন্নতি, মানুষে মানুষে বৈষম্যবিরোধী চিন্তার অনুশীলন এবং এই লক্ষ্য পূরণে শিক্ষা কাঠামো, পাঠদান পদ্ধতি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সমস্ত ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চর্চাকে অগ্রাধিকার’ দেওয়াসহ নয় দফা ঘোষণা করে এ ঐক্য।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্র সংগঠনগুলোর উদ্যোগে এ ঐক্যের জন্য প্রথম বৈঠকটি হয়। তবে এরপরই মূল দলের নেতারা এ ঐক্য গঠন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হন। তাদের দিক-নির্দেশনায় পরে ছাত্র সংগঠনগুলোর এ ঐক্য গঠিত হয়। সেখানে কিছু বিবেচনায় ইসলামি দলগুলোকে রাখা হয়নি। আবার একেবারে বাদও রাখা হয়নি। ছাত্র জমিয়ত এ ঐক্যে আছে।
কিছু বিবেচনা এ ক্ষেত্রে কাজ করেছে বলে অনুমান করছে রাজনৈতিক মহল। তারা বলছে, ইসলামি ছাত্র শিবির বা ইসলামি ছাত্র আন্দোলনের রাজনীতি মূলগতভাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা। শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের যেসব দাবি-দাওয়া রয়েছে তার সঙ্গে ছাত্রদলসহ অন্যেদের অবস্থান বিপরীত। বিএনপি একটি মধ্যপন্থার দল। তারা সবার সঙ্গেই আদর্শিক বা নৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। শিক্ষা নিয়ে তাদের দাবি-দাওয়াগুলো সবাইকে নিয়েই। এ ছাড়া বাম এবং অন্যান্য দলগুলো শিক্ষাকে সেক্যুলার, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখে আসছে। তাদের সঙ্গে ছাত্রদলের মৌলক পার্থক্য নেই। তবে ইসলামি সংগঠনগুলোর সেই পার্থক্য আছে। তারা শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতেও বড় ধরনের ব্যবধান আছে অন্যদের সঙ্গে। যে কারণে ইসলামি ছাত্র সংগঠনগুলোকে হয়তো রাখা হয়নি এ জোটে।
তারা আরো বলছেন, জামায়াতে ইসলামি বা ইসলামি আন্দোলন বিএনপির সঙ্গে কোনো জোটে নেই, যুগপৎ কর্মসূচিতেও নেই। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যের অন্যান্য ছাত্র সংগগঠনগুলোর মূল দলগুলো জোট বা যুগপৎ আন্দোলনে আছে। ফলে শিবির বা ইসলামি ছাত্র আন্দোলনকে এ জোটে রাখার হিসাবটা মূল দলের সঙ্গেই আগে মেটাতে হবে। ছাত্র সংগঠনের ক্ষেত্রে ঐক্য আর মূল দলে দূরত্ব আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা আরো বলছেন, এখানে মূল আন্দোলনটা হলো বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। যে আন্দোলনে অনেকগুলো পক্ষও আছে। দেশের প্রগতিশীল বা সেক্যুলার সমাজের আপত্তি আছে শিবির বা ছাত্র আন্দোলন নিয়ে। বিশেষত, জামায়াতে ইসলামি নিজেই অনিশ্চয়তায় আছে। তাদের অবস্থান পরিষ্কার হয়নি এখনো। দেশের সাধারণ জনগণের মনে তাদের নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শিবিরকে ছাত্রদের এ জোটে রাখলে জোটটিও সেই প্রশ্নের মুখে পড়বে। শিবির চলমান আন্দোলনে অনেকটা নিষ্ক্রিয় সংগঠন। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা কাজ করছে না। তাদের সম্পৃক্ততা কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার যথেষ্ট সুযোগও রয়েছে।
এ ছাড়া ইসলামী ছাত্র আন্দোলন নিয়েও প্রশ্ন আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা মাঝে মাঝে সক্রিয় হলেও সরকারবিরোধী আন্দোলন করছে এমনটা দেখা যায়নি। ঢাবিতে তাদের রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক আছে। এসব বিবেচনায় রেখেই হয়তো ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্যে রাখা হয়নি তাদের।
রাজনীতি সচেতন মহল আরো বলছে, সম্প্রতি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর শোক জানিয়েছিল বিএনপি। এর পরপরই ভারতের সংবাদমাধ্যমে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন লেখালেখি শুরু হয়। বলা হয়, বিএনপির সঙ্গে জামায়াত বা অন্যান্য ইসলামি দলের জোট ভারত ভালো চোখে দেখবে না। সরকারের বিভিন্ন লবি বিষয়টিকে পুঁজি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করবে। বিভিন্ন পক্ষকে বিভ্রান্ত করবে।
তাদের মতামত, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা পক্ষগুলো ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে সবসময় সংশয়ে থাকে। সে বিষয়টি বুঝতে পেরে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি তাদের কাউকে নিজেদের সঙ্গে নেয়নি। আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় ছাত্রদলের নেতৃত্বে গঠিত জোটেও রাখা হয়নি ইসলামি ছাত্র সংগঠনগুলোকে।
এ অবস্থায় ইসলামি দলগুলোর সরকার বিরোধী আন্দোলনে আরো সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। অন্যদের সঙ্গে জোটে যাওয়া না যাওয়ার রাজনীতি থেকে বের হতে পারলে তারাই বরং রাজনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী হবে।
Discussion about this post