১৫ তম ব্রিকস সম্মেলন শেষ হয়েছে এক সপ্তাহ। এর মধ্যে নানা দেশের নানারকম বিশ্লেষণ আসতে শুরু করেছে। বিবিসি, আল-জাজিরা, সিএনএন, আরটি, ফ্রান্স টুয়েন্টি ফোর, গ্লোবাল টাইমস একেক দেশের একেকটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। বৈশ্বিক পরিসরে পত্রিকাগুলো অনেকটা স্বদেশের মুখপত্র হিসেবেই কাজ করে। স্বদেশের স্বার্থ দেখেই একেক দেশের সংবাদমাধ্যম ব্রিকস নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করছে। তাদের কথায় ফুটে উঠছে নানা সুর। কথাবার্তা শুনে ব্রিকসকে যতটা না একটি অঞ্চলের কয়েকটি দেশের অর্থনৈতিক জোট মনে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে মতাদর্শিক লড়াই। ঠাণ্ডা যুদ্ধের পর এ আরেক গরম যুদ্ধই শুরু হলো বলা যায়।
২৬ আগস্ট প্রকাশিত রাশিয়া টুডে (আরটি)-এর এক মতামতের শিরোনাম- পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা মেশিন দাবি করছে ব্রিকস ন্যাটোর প্রতি চ্যালেঞ্জ ও মারাত্মক হুমকি- তা আসলেই সত্য কিনা?
আরটির বিশ্লেষণের সংক্ষিপ্তসার অনেকটা এরকম: শীতল যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার ত্রিশ বছর পরও পশ্চিমা বিশ্ব সেই মানসিকতা ছাড়তে পারছে না। রাশিয়া ও চীনকে এখনো তারা বিশ্বাসযোগ্য হুমকি হিসেবে ভয় দেখানোর জন্য ব্যবহার করতে পারছে।
আরটি দাবি করছে, পশ্চিমা বিশ্ব প্রচার করছে ব্রিকস একটি নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি মারাত্মক হুমকি।
পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য খোলাখুলি এ-দাবি করে নাই। তবে, তারা নরম সুরে ব্রিকসের কিছু সমস্যা দেখিয়েছে। যেমন সিএনএন-এর একটি বিশ্লেষণ-শিরোনাম এরকম: নতুন ব্রিকস সদস্যরা চীনের জন্য বড় জয়, কিন্তু, তারা কি একসাথে কাজ করতে পারবে?
সিএনএন যুক্তি দেখাচ্ছে, নতুন সম্প্রসারণ বাস্তবতার চেয়ে প্রতীকী বেশি। অর্থাৎ, কাজের চেয়ে লোক দেখানো ভাবটাই যেন প্রধান। কারণ, নতুন সদস্যরা এমনিতেই তো বিচ্ছিন্ন, একসাথে কাজ করবে কী করে? আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। মুদ্রাস্ফীতি চরমে, আর আছে মুদ্রাসংকটে। আইএমএফ থেকে বিশাল অংকের টাকা ধার নিয়ে রেখেছে। মিশরের অবস্থাও তাই, আইএমএফ-এর কাছে দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণখেলাপি তারা। অন্যদিকে সৌদি আরব আর ইরান তো স্পষ্টতই চিরশত্রু। চীন ও ভারতেরও সীমান্ত নিয়ে গণ্ডগোল। এ-অবস্থায় তারা একসাথে কাজ করবে কী করে?
সিএনএন বলতে চাচ্ছে এটা অনেকটা মার্কিন-বিরোধী লড়াই। এবং এতে বেশি লাভবান হবে চীনই। কিন্তু, সিএনএন এও হুঁশিয়ারি দিচ্ছে যে, চীনের নিজেরই অর্থনৈতিক অবস্থা এখন ভালো না। বেকারত্বের হার চরমে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ চীনে এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার খুবই ধীর গতিতে চলছে। যার প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে।
অন্য দিকে চীন ব্রিকসকে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। বিশেষ করে নতুন ছয় দেশের অন্তর্ভুক্তিকে। এখন যদি তারা পারস্পরিক বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করতে পারে তাহলেই ডলারের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে পারবে। এটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভয়।
আরেক দিকে ব্রিকস-এর সংক্ষিপ্তরূপটি প্রথম যিনি তৈরি করেছিলেন সেই বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল প্রোজেক্ট সিন্ডিকেটে এক বিশ্লেষণে জানিয়েছেন, ব্রিকসের নতুন সম্প্রসারণের কি আসলেই কোনো মানে আছে?
তিনি বলেছেন, জোটের প্রভাব পড়বে এর কার্যকারিতার ওপর, এর বিস্তারের ওপর নয়। কিন্তু, তাদের বিস্তার দেখে মনে হচ্ছে তেমন সূদরপ্রসারি কোনো পরিকল্পনা নেই। অর্থনৈতিক জোটের চেয়ে একে রাজনৈতিক জোটই বলা যায়। এই যে নতুন ছয় সদস্যকে নেয়া হলো, আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথোপিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত- এখানেই তো আমার কথা আছে। কেন আর্জেন্টিনাকে, মেক্সিকোকে কেন নয়? নাইজেরিয়াকে বাদ দিয়ে ইথোপিয়াকে কেন? এটা পরিস্কার যে ব্রিকস একটা প্রতীকী শক্তি হিসেবেই বিকশিত হতে চায়।
এই যখন অবস্থা বিবিসিও তখন তলে তলে মাঠ গরম করতে চাইছে। এক সপ্তাহ আগেই তাদের সংবাদ-শিরোনাম প্রকাশিত হয়েছে, ‘মার্কিন নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কি নতুন একটি ব্লকের আবির্ভাব ঘটছে?’
বিবিসির বিশ্লেষণের মূল বিষয় হচ্ছে, ব্রিকস- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে একটি শক্তির লড়াই হিসেবেই দেখা হচ্ছে। শি চিন পিং এখন তার সঙ্গীদের বোঝাচ্ছেন, তাদের সবার ভবিষ্যৎ এক। এবং তাদের লক্ষ্য পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
কিন্তু, আসলেই কি তাদের সবার ভবিষ্যৎ এক? এবং আসলেই তাদের সবার পক্ষে পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব থেকে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে?
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, তিনি ব্রিকসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কারো বিরুদ্ধে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছেন না। তার সাথে সুর মিলিয়ে ওয়াশিংটন কুইন্স ইনস্টিটিউটের গ্লোবাল সাউথ প্রোগ্রামের পরিচালক সারং শিদোরও বলেছেন, ছয়টি নতুন সদস্যের কাউকেই আমেরিকা-বিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে দেখা হচ্ছে না।
ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট শত্রু হলেও সৌদি আরব আমেরিকার দীর্ঘকালের বন্ধু। ভারতও আমেরিকার সাথে বন্ধুত্বের চেষ্টা করছে। এই সব মিলিয়ে ব্রিকসকে একটা হযবরল অবস্থা হিসেবেই দেখছে বিবিসি।
কাতার-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদপ্রচারে আল-জাজিরা বিশ্বে অগ্রগণ্য। তাদের বিশ্লেষণে দেখা যায় ব্রিকস-এর নতুন সদস্য গ্রহণ অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক। এবং এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে ইরান। দক্ষিণ আফ্রিকার থিংক ট্যাঙ্ক-এর সিনিয়র গবেষক নাঈম জিনাহ বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে যতটা বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায় ব্রিকস-এর সদস্যপদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেখা যায় ইরান এতটা বিচ্ছিন্ন নয়। জিনাহ আরো বলেছেন, মিশর, সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থা অনেকটা ভারতের মতোই, আরেকটু স্পষ্ট করে বললে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো, তাদের এক পা ব্রিকস-এ, আরেক পা পশ্চিমে। এই অবস্থায় ব্রিকস-এর সুবিধা ইরানই সর্বোচ্চ আদায় করে নিতে পারবে।
আল-জাজিরার ভাষ্যমতে, ইরানকে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়ে ব্রিকস জি-সেভেনকে বা ওয়াশিংটনকে একটা স্পষ্টই বিভাজনের বার্তা দিল। ব্রিকস-এর অনুল্লিখিত মন্তব্য অনেকটা এরকম: ইরানকে নিয়ে তোমাদের সমস্যা থাকলে আমাদের কিছু আসে-যায় না। তোমাদের মাথাব্যথা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাবো না।
ফ্রান্স টুয়েন্টি ফোর-এর সুর খুব নরম। আক্রমণাত্মক ভঙ্গি পরিহার করে তারা বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতেই বোঝাতে চেষ্টা করছে যে, ব্রিকস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি না, বরং একটা সতর্কবার্তা। ব্রিকসের সদস্যরা যখন জোহান্সবার্গে মিলিত হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তখন তার প্রশাসনকে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে আরো কার্যকর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
জ্যাক সুলিভানও বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য এখন আসন্ন জি-২০ সম্মেলনের দিকে। যেখানে ধনী-গরিব উভয় রাষ্ট্রগুলো এক হবে।
সেপ্টেম্বর মাসের ৯-১০ তারিখ ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জি-২০’র অষ্টাদশ সম্মেলন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উপস্থিত থাকবেন এখানে। থাকবেন চীনের রাষ্ট্রপতি শি চিন পিং। উভয়ের মাঝখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো উপস্থিত থাকবেনই। কিন্তু, তাদের পাশে থাকবেন না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোও উপস্থিত থাকবেন। থাকবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
ব্রিকস-এর গরম যুদ্ধ কতটা ঠাণ্ডা হয় তখন বোঝা যাবে।
Discussion about this post