সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছে বিরোধী দলগুলো। মূলত বিএনপিকে কেন্দ্র করে এ আন্দোলন চলছে। যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সমান্তরালে যোগ দিয়েছে বামপন্থী ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। তবে সবচেয়ে আলোচিত দল জামায়াতে ইসলামী রয়েছে নিষ্ক্রিয়।
ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে ইসলামি আন্দোলনও সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির এবং ওই নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিমের বড় ভাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের ওপর হামলার পর তারা সরকারবিরোধী অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তার আগ পর্যন্ত ইসলামি আন্দোলন মোটামুটি সরকার ঘেঁষা বলেই পরিচিত ছিল। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে তাদের অংশগ্রহণ এ পরিচয়কে আরো জোরদার করে। তবে ওই হামলার পর ইসলামি আন্দোলনকে সরাসরি বিএনপির প্রতি সমর্থন জানাতে দেখা গেছে। তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরকারের পদত্যাগ দাবিতে কর্মসূচিও পালন করছে। তাদের দাবিও বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনরত দলগুলোর সঙ্গে মিলে যায়।
বরিশাল, রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনসহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক জায়গায় ভালো ভোট পেয়ে রাজনৈতিক মহলের নজরে আসে ইসলামী আন্দোলন। বিভিন্ন সময় তারা জাতীয় সরকারের প্রস্তাব তুললেও এখন আর সে বিষয়ে কিছু বলতে দেখা যায় না।
দলটি চেষ্টা করছিল সমমনা এবং কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক মোট আটটি দল নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা গড়তে। দলগুলো হলো প্রয়াত শায়খুল হাদিস প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (যিয়াউদ্দীন), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (আতাউল্লাহ), খেলাফত মজলিস (ইসহাক), নেজামে ইসলাম পার্টি, ফরায়েজি আন্দোলন ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (আবুল খায়ের)। প্রায় সব দলের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তাও হয়েছে। এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতির খবর আসেনি।
অপরদিকে খেলাফত মজলিস ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল তাদের মহাসচিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১ অক্টোবর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়। তবে চলতি বছর তারা বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে কর্মসূচি পালন করছে। কোথাও কোথাও তাদের জমায়েতও বড় হয়েছে। যদিও ২০০৫ সালে খেলাফত মজলিস দুই ভাগ হয়ে যায়। একটি ভাগ খেলাফত মজলিস নামে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে থেকে যায়। অপর ভাগটি জোট থেকে বেড়িয়ে গিয়ে ‘বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস’ নাম ধারণ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ৫ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল, তারা নির্বাচিত হলে কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন করবে না। বামপন্থীদের চাপে সে চুক্তি কার্যকর করা যায়নি। ২০২১-২০২২ সালে আল্লামা ইসমাঈল নূরপুরী দলটির আমির এবং মাওলানা মামুনুল হক মহাসচিব নির্বাচিত হন। মামুনুল হক বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দল ১০টি। এর মধ্যে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল আছে ৬টি। সেগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বাকি পাঁচটি দলই একসময় বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। এখন মূল দলের কোনোটিই বিএনপির সঙ্গে নেই। তবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট নামে দুটি খণ্ডিত অংশ বিএনপির সঙ্গে আছে, যাদের নিবন্ধন নেই।
মুফতি ফজলুল হক আমিনীর প্রতিষ্ঠিত এক সময়ের আলোচিত ইসলামী ঐক্যজোট এখন আর আগের অবস্থায় নেই। তারা সরকারের সঙ্গে থাকতে চায়। আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর খেলাফত আন্দোলন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলছে। তারা শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গেই থাকতে পারে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর।
এর বাইরে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও জাকের পার্টি আগে থেকেই সরকারের সঙ্গে রয়েছে। আগামী নির্বাচনে হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে জানা গেছে।
ইসলামপন্থী দলগুলোতে বরাবরই ভাঙন দেখা যায়। অনেক সময় একটি দল বড় আকারে হাজির হলেও পরে তারা ছোট হয়ে আসে। জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে এ জন্য। এর বড় কারণ হিসেবে বলা যায়, ধর্মীয় দৃষ্ঠিভঙ্গি, আচার-আচরণ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে এসব দল বিভক্ত হয় পড়ে। সরাসরি জনস্বার্থ রক্ষা হয় এমন কর্মসূচিও তাদের দিতে দেখা যায় না। এ ছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রাজনৈতিকভাবে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো। যে কারণে তারা শক্তিশালী হতে পারে না।
চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনেও এসব দোদুল্যমানতা দেখা গেছে ইসলামি দলগুলোর ভেতর। তারা কে কোন পক্ষে যাবে, কার সঙ্গে যাবে তার হিসাব-নিকাশেই সময় পার করে দিচ্ছে। নতুন আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে তাদের যে বলিষ্ঠ ভূমিকার প্রয়োজন ছিল, তার দেখা পাওয়া যায়নি। ফলে আগামী বছরগুলোতেও তারা যে রাজনৈতিকভাবে খুব বড় কোনো অবস্থায় যেতে পারবে তা অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না।
যদিও ইসলামপন্তী বুদ্ধিজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টদের এ বিষয় বেশ তৎপর থাকতে দেখা গেছে। তারা ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের বিষয়ে বারবার ইসলামপন্থীদের সজাগ করতে চাইছেন। এর বিপরীতে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের উত্থান চাইছেন। যদিও তাদের এই অবস্থান নিয়ে সমালোচনা আছে। অনেকে মনে করছেন, তাদের মতামত ধারণ করার অবস্থায় ইসলামপন্থীরা নেই। তা ছাড়া ভোটাধিকারসহ সরাসারি জনসম্পৃক্ত বিষয়ের বাইরে অন্য দিকে নজর দেওয়ার সময় এখন না। বাংলাদেশে মানবাধিকারসহ সার্বিক যে পরিস্থিতি; তা থেকে উত্তরণের দিকে ইসলামপন্থীরা যদি মনোযোগ না দেয়, তাহলে তাদের আরো দুর্বল হয়ে পড়তে হবে।
Discussion about this post