২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে কোনো বাধা না দিলে কী ঘটতে পারতো?
ধরা যাক, সমাবেশের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়া লোকজনের পথ আটকায়নি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পথে পথে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে লোকজনের ফোন-পরিচয়পত্র যাচাই করা হয়নি। গণপরিবহন বন্ধ করে তাদের আসার পথে বাধা দেওয়া হয়নি। ব্যাপকহারে গ্রেফতার ও আটক করা হয়নি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের।
তাহলে কী ঘটতে পারতো?
সমাবেশে যে পরিমাণ লোক সমাগম হয়েছে তার চেয়ে কিছুটা বেশি জমায়েত হতো।
কিন্তু, আরেকটু বেশি জমায়েত হলেই কি বিএনপি রাস্তায় বসে পড়তো? রাস্তায় বসে পড়ার কর্মসূচির জন্য কি কালকের জমায়েত যথেষ্ট ছিল না?
রাস্তায় বসে পড়ার কর্মসূচি দেওয়ার ইচ্ছা থাকলে এই জমায়েত নিয়েই বিএনপি তা করতে পারতো। কিন্তু সত্য হলো, এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা বিএনপির ছিল না।
রাস্তায় বসে পড়ার কর্মসূচি মানে অনিবার্য সংঘাতের জন্য অপেক্ষা করা। মানে পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি অবলম্বন করা। সঙ্গে খাবার ও পানির যথেষ্ট জোগান রাখা। কিন্তু তেমন প্রস্তুতি কি বিএনপির ছিল?
অবশ্যই ছিল না। পুলিশের ন্যুনতম আক্রমণ প্রতিহত করার মতো প্রস্তুতিও তাদের ছিল না। থাকলে এত দ্রুত লাখ লাখ কর্মীকে ছত্রভঙ্গ করে নয়াপল্টন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারতো না পুলিশ।
বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, অপেক্ষাকৃত বড় সমাবেশ হলেও এটি তাদের অন্য কর্মসূচিগুলোর মতোই একটি কর্মসূচি। এই সমাবেশ দীর্ঘায়িত করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
পুলিশের অভিযানের পর এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, বাইরে অন্যেরা যত কথাই বলুক, বিএনপির মনে অন্য কোনো ইচ্ছা ছিল না। সেরকম কোনো প্রস্তুতিও ছিল না। তারা বরং এই কর্মসূচিকে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছে। নভেম্বরে বড় কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপির যে অন্য কোনো পরিকল্পনা নেই, সেটি কি সরকার জানতো না? অভিযান পরিচালনা ছাড়া শক্তিশালী গোয়েন্দা ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার কি সেটি জানতে পারতো না? উত্তর হলো, সরকার অবশ্যই জানতো। কোনো সন্দেহ থাকলে আরও স্পষ্টভাবে জানার যথেষ্ট উপায়ও তাদের হাতে ছিল। কিন্তু সেটা না করে সরকার কেন অভিযান পরিচালনার দিকে গেল?
এর উত্তরে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, বিএনপি নেতাকর্মীরা সরকারী স্থাপনায় ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করেছেন, ফলে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, সরকার ঠিক বলছে। কিন্তু ছোট ঘটনাগুলোর প্রতিবিধান করার জন্য যে মোড়ে ঘটনাটি ঘটেছে সেই মোড়ে ব্যবস্থা নিলেই চলতো। পুরো সমাবেশ পণ্ড করার দরকার ছিল না। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে যেভাবে পুরো সমাবেশে অভিযান পরিচালনা করেছে তাতে মনে হয় তারা আগে থেকে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল।
সমাবেশের আগে থেকে অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতারা এমন আভাস দিয়ে আসছিলেন। শাপলা চত্বরের মতো পরিণতির কথাও প্রকাশ্যে উচ্চারণ করা হয়েছে। আরও নানারকম উস্কানি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউই ধারণা করতে পারেনি, সরকার শেষ পর্যন্ত এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অভিযান পরিচালনা করার ঝুঁকি নেবে।
প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইওরোপীয় ইউনিয়নসহ গণতন্ত্রমনা ও মানবাধিকারপন্থী পুরো গ্লোবাল ওয়েস্ট অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর তীব্র চাপ তৈরি করতে পেরেছে। এবং এই চাপ প্রশমিত করার জন্য সরকারের সকল চেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, দেশের অর্থনীতির সব সূচক নিম্নগামী এবং তীব্র ঝুঁকির মধ্যে আছে। যে কোনো সময় অর্থনীতিতে বড় বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা আছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সামান্যতম চাপও অর্থনীতি নিতে পারবে না।
তৃতীয়ত, বিরোধী দলগুলো আগের থেকে অনেক বেশি সংগঠিত ও একাট্টা। তারা নিজেদের দাবিগুলোকে সংকলিত করে এক দফায় উপনীত হতে পেরেছে। দ্রুত সংগঠিত হওয়ার সক্ষমতাও অর্জন করেছে।
এই তিনটি বিষয় বিবেচনায় রেখে সরকার দেশকে বড় সংঘাতের দিকে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেবে না বলে অনেকে মনে করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের সংঘাত সরকারের ওপর বাইরের চাপ বাড়াবে, অর্থনীতিকে আরও নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলবে এবং বিরোধী দলগুলোকে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যেতে উৎসাহিত করবে।
২৮ তারিখের আগে কোনো কোনো বিশ্লেষক এমন আভাসও দিচ্ছিলেন যে, সরকার হয়তো বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে একটি আপোষরফার দিকে যাবে। তারা বলছিলেন, ইতিহাসে আওয়ামী লীগ সবসময় আপোষ-আলোচনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আগে যাই করুক, শেষ পর্যন্ত আপোষরফা করে ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজেদের এগিয়ে রেখেছে। এবারও হয়তো তারা সেদিকে যাবে। টানা ১৫ বছরের শাসনকাল শেষ করে দলটির মধ্যে যথেষ্ট পরিতৃপ্তিও এসেছে। ফলে, এবার কিছুটা আপোষরফা করে ভাল একটি নির্বাচন দিতে তারা হয়তো আগ্রহী হবে। আওয়ামী পরিমণ্ডলের অনেক বুদ্ধিজীবী এর মধ্যে জোরেশোরে সংলাপের প্রস্তাব দিচ্ছিলেন। তাতে মনে হচ্ছিল, হয়তো সরকার খানিকটা হলেও নমনীয় হবে।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাবের পরিস্থিতি যেখানে এসে ঠেকেছে তাতে আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে ভাল বিকল্প ছিল নিজেদের পছন্দসই একটি নামে তিন মাসের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার সংসদে পাশ করিয়ে আনা। অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার পাশ করিয়ে আনলেও আওয়ামী লীগ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। গত ১৫ বছরে তারা নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসনে যে বিপুল দলীয়করণ করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে নিজেদের লোক বসিয়েছে তিন মাসের জন্য আসা সরকার শত চেষ্টাতেও তাতে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে পারবে না। কর্মকর্তারা ওপরে ওপরে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলেও ভেতরে তারা ঠিকই আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করতে পারবে। ফলে, তাদের প্রভাবিত করে নির্বাচনে জিতে আসা দলটির জন্য খুব কঠিন হবে না। সরকার এমন একটি ব্যবস্থা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধী দলগুলোকে সংলাপে বসার আহবান জানালে তাতে না করার সুযোগও বিরোধীরা পাবে না। কিন্তু এমন একটি ব্যবস্থার দিকে যেতে চাইলে সরকার সংহিসতাকে উস্কে দেবে কেন?
সরকারের জন্য আরেকটি পন্থা অবশ্য তৈরী আছে। এটিই তাদের পছন্দসই এবং প্রথম বিকল্প। সেটি হলো, বর্তমান ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে নির্বাচন করা। মনেপ্রাণে তারা এটিই চায় এবং এর কথাই বারবার বলে আসছে। প্রধানমন্ত্রীকে রুটিন দায়িত্বে রেখে বা ছুটিতে পাঠিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট মন্ত্রিসভা দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে ভোট করে ফেলার কথা বলা হচ্ছে। বিরোধী দলগুলো এ ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে এটিকে মাথায় রেখেই। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে বেশ কয়েকটি দলকে ম্যানেজ করা হয়েছে। অনেক দলের কাছে প্রস্তাব গিয়েছে বলে শোনা যায়। উকিল আব্দুস ছাত্তার মডেলে বিএনপি থেকেও দলছুটদের ভাগিয়ে আনার কাজও চলছে তলে তলে। তবে বিএনপি বাদে অন্য সবাই এলেও যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না সেটি এখন দেশে-বিদেশে অনেকেই অনুধাবন করছে।
এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমান ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে যদি নির্বাচন করার ইচ্ছা সরকারের থাকে তবে সহিংসতা কি তাদের কোনো কাজে লাগবে?
গতকাল বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বাইরে যাওয়ার কোনো আভাস তো ছিল না। তারা সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করার মতো কর্মসূচি এখন পর্যন্ত দেয়নি। খুব শীঘ্রই দেবে এমন কোনো ইঙ্গিতও মেলেনি। সকলেই ধারণা করছিলেন, বিএনপি হয়তো তফশিল ঘোষণার দিন এ ধরনের কোনো কর্মসূচি দেবে। দিলে সেটি তাৎক্ষণিকভাবে ঠেকানোর ক্ষমতা সরকারের ছিল। তাহলে আগেভাগেই কেন বিএনপির সভা পণ্ড করার মতো বড় অভিযান চালানো হলো?
বিএনপির মনে ভয় ধরানোর জন্য?
তাদের আন্দোলনের সংহতি নষ্ট করার জন্য?
সামনে যাতে তারা কঠোর কর্মসূচি দিতে না পারে সে বার্তা দেওয়ার জন্য?
নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্লোবাল ওয়েস্টের বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও বিরোধীদের ওপর হামলা করে সরকার তাদেরকেই বার্তা দিতে চাইলো? তাদের চ্যালেঞ্চ জানালো? তাদের বলতে চাইলো যে, সরকার তাদের থোড়াই কেয়ার করে?
আমার বিবেচনায়, সরকার ভাল বুদ্ধিতে এ ধরনের বার্তা দিতে চাইবে না। তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে, সংলাপে বিরোধীদের আগ্রহ নেই এসব বলে বলে ভালই চালিয়ে আসছিল। পশ্চিমাদের আগ বাড়িয়ে খেপানোর দরকার তো ছিল না। বরং, পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রেখে তফশিল ঘোষণা পর্যন্ত তারা সহজভাবেই এগিয়ে যেতে পারতো।
কিন্তু আসলেই কি যেতে পারতো?
২৮ তারিখের আগে-পরে সরকারের আচরণ বলছে, পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রেখে হয়তো তাদের আর খুব বেশি অর্জন করার নেই। ফলে, তারা বিএনপিকে দমন করার সর্বাত্মক নীতিই নিয়েছে।
এমন হতে পারে, সরকার পশ্চিমাদের দিক থেকে শক্ত কোনো বার্তা পেয়েছে এবং তাতে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে একতরফা নির্বাচন করলে ফল ভাল হবে না।
সেক্ষেত্রে চীন-রাশিয়া-ভারতের সমর্থন নিয়ে একতরফা নির্বাচনের দিকে যাবার আগে সরকার বিএনপি ও পশ্চিমাদের শক্ত বার্তা দিল। জানিয়ে দিল, আর রাস্তায় নামা যাবে না। পশ্চিমাদের সুবচনও আর শোনা হবে না।
কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, সরকার তৃতীয় একটি বিকল্প নিয়ে ভাবতে পারে। আর সেটি করতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা প্রয়োজন ছিল।
তারা বলছেন, বর্তমান ব্যবস্থায় বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন তৃতীয় বারে এসে আর দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আর এ ধরনের নির্বাচন করে ফেললে নানারকম নিষেধাজ্ঞার চাপ সামলাতে হবে। ভঙ্গুর অর্থনীতি বড় নিষেধাজ্ঞায় তিনমাসের মধ্যে ধ্বসে পড়বে। এ অবস্থায় জানুয়ারিতে নির্বাচন করার চিন্তা থেকে সরে আসতে পারে সরকার।
নির্বাচনকালীন সরকার করলে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি হলেও শেষ পর্যন্ত ইগোস্টিক কারণে হয়তো সেদিকেও সরকার যাবে না।
এই দুটি বিকল্প বাদ দিলে সরকারের সামনে থাকে সংবিধান অনুসারে জরুরি অবস্থার দিকে যাওয়ার তৃতীয় বিকল্প। পরিস্থিতি যদি সহিংস হয়ে ওঠে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়, নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায় তবে সংবিধান অনুসারে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে জরুরি অবস্থা জারি করে সরকার ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে পারে।
সম্ভবত, তেমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য ২৮ অক্টোবরের আগে-পরে উদ্যোগী হয়ে সহিংস একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে সরকার।
Discussion about this post