১. ২৮ অক্টোবর ২০২৩ সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কৌশল প্রদর্শিত হয়েছে জামায়াতের মহাসমাবেশে। তারা একদিকে পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করে শাপলা-চত্বর দখলে নিয়েছে এবং সংঘাত এড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে স্বল্প সময়ে ব্যাপক নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে আরামবাগে সমাবেশ করেছে। তাদের নেতাকর্মীরা শাপলা চত্ত্বরে প্রবেশের মাধ্যমে পুলিশবাহিনীর কতিপয় অফিসারের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে, অপরদিকে অভ্যন্তরীণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পুলিশের কাছ থেকে আরামবাগে সমাবেশের অনুমতি আদায় করেছে বা অনুমতি দিতে বাধ্য করেছে। যা তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ফুটিয়ে তোলে। এটাকে চতুর্মুখী লড়াইয়ে একক বিজয় হিসেবেও গণ্য করা যায়।
২. বিএনপি আজ হয়তো তার ৪৫ বছরের রাজনীতির সবচেয়ে সুন্দর উপস্থিত রাজনৈতিক কৌশল প্রদর্শন করেছে। একদিকে সরকারদলীয় সন্ত্রাসী ও পুলিশ বাহিনীকে একেবারে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়নি, অপরদিকে নিজেদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানি এড়িয়েছে। সরকার একটা রক্তক্ষয়ী-প্রাণঘাতী সংঘর্ষ চেয়েছিল, কিন্তু বিএনপির কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়েছে। বিএনপি নেতৃবৃন্দ যদি প্রতিরোধের ঘোষণা দিতো এবং কর্মীদের শক্ত অবস্থান নিতে নির্দেশনা দিতো তাহলে এই সংঘাত সারা শহরে ছড়িয়ে পড়তে পারতো। এতে করে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদ বিনষ্ট হতে পারতো। এতে করে সরকার গণতান্ত্রিক বিশ্বে বিএনপিকে আগুন সন্ত্রাসের দল বলে ২০১৩/২০১৪/২০১৫ এর মতো প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গণতন্ত্রের এই সংগ্রামকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ পেত। কিন্তু বিএনপির দূরদর্শী সিদ্ধান্তে সরকারের এই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
৩. নতুন দল হিসেবে নুরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ সাহসী ভূমিকা রেখেছে, তারা তাদের যথাসাধ্য প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। আহতও হয়েছেন অনেকে। তাছাড়া সমাবেশের আগের রাত থেকে তাদের শক্ত অবস্থান গণতন্ত্রকামী যুবসমাজকে আন্দোলিত করেছে। অবশ্যই নুরুল হক নূর ও রাশেদ খান সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে রাজপথ আঁকড়ে ছিলেন। তারা এমন সাহসী ভূমিকা চলমান রাখলে, ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারবেন ব্যাপকভাবে।
৪. গণতন্ত্র মঞ্চ তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি, প্রতিরোধও করতে হয়নি। কিন্তু জোনায়েদ সাকীর মতো তরুণ, সাইফুল ইসলাম-মাহমুদুর রহমান মান্না ও আ.স.ম. রবের মতো প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব এই জোটটিকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, গতানুগতিক বাম ধারার রাজনীতির বাইরে গিয়ে তারা ধীরে ধীরে জনসাধারণের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। বাম দলগুলোর এই জোটটি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে অপরাপর সরকারপন্থী বাম দলগুলোর সাথে আদর্শিক লড়াইয়ে অনেকটা এগিয়ে। তারা সরকারের অ্যালাই বামদলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছে।
৫. আওয়ামীলীগের শান্তি সমাবেশে লগি-বৈঠা হকিস্টিক নিয়ে নেতাকর্মীরা বাধাহীনভাবে অথবা একপ্রকার পুলিশি সহায়তায় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটের সমাবেশে অংশগ্রহণ করলেও, তাদের হৃদয়ে যথেষ্ট সাহসের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত হামলা করতে আসছে এই গুজবে তাদের দিগ্বিদিক ছুটোছুটি তারই প্রমাণ বহন করে। এতে এই উপসংহারে পৌঁছানো ভুল হবে না যে- শাসকের সুবিধাভোগী এই গোষ্ঠীটি ক্ষমতা হারানোর ভয়ে চরম আতঙ্কগ্রস্ত।
৬. সর্বশেষ আজকের সংঘাতে একটা বিষয় পরিষ্কারভাবে সামনে আসলো যে- বিরোধীদের কর্মসূচিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই সহিংসতার আশ্রয় নেয়, নিজেরাই বাসে আগুন ধরায়। কাকরাইলে মোড়ে ও মালিবাগ ফ্লাইওভারে বাসে আগুন দেয়ার ঘটনায় পুলিশ ও ডিবি সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন গাড়ি দুটোর চালক-হেল্পাররা। যা গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে পুলিশবাহিনীর ভূমিকাকে প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে বলে আমি মনে করি। যদিও এর আগে বিরোধীদল এই অভিযোগগুলো করে আসছিল। কিন্তু গত জুলাইয়ের অবরোধ কর্মসূচির পর আজ আরেকবার গাড়ির চালক-হেল্পার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তুললো। এর একটা নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পড়বে।
৭. এই সংঘাতের পর পুরো জাতির দৃষ্টি ছিল পশ্চিমা বিশ্ব বা এককভাবে বলতে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী হয় তার দিকে। তারাও প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেনি। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় স্বল্প সময়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতি এই ইঙ্গিত দিয়ে রাখলো যে- তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরো বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। সুস্পষ্টভাবে এই সংঘাতে জড়িতদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের হুমকি দিয়ে রেখেছে তারা। যা আগামীর রাজনীতিকে আরো ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে।
সর্বোপরি সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে রণপ্রস্তুতি ছিল, তা বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়েছে। তবে তাদের এ কৌশল সফলতার মুখ দেখবে, যদি আগামী কালের কর্মসূচি সফল হয় এবং যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, হেফাজতে ইসলামের মতো দলগুলোকে আরো কাছে টানতে পারে। অন্তত একইদিনে ভিন্ন কর্মসূচি হলেও যেন তারা দেয় এমন একটা ঐক্যমতে যদি পৌঁছাতে পারে সেটা ভাল ফল দেবে।
আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, বিএনপির কর্মসূচিতে ব্যাপকহারে খেটে খাওয়া মানুষের অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে রিকশাচালকদের মিছিল আলাদা মাত্রা যোগ করেছে এই আন্দোলনে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন আরো বেশি উগ্র হয়ে উঠবে। যা তাদের জন্যে হিতে-বিপরীত হবে। কেননা গণতান্ত্রিক বিশ্বের নজর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর নিবদ্ধ রয়েছে।
Discussion about this post