‘আমরা এখন সপ্তম বেহেশতে আছি
নতুন একটি শহর গড়ে উঠছে এখানে
রক্তাক্ত ইউনিফর্মে কাজ করছেন চিকিৎসকেরা,
শিক্ষকরা ছাত্রদের সাথে করছেন কোমল আচরণ
দুঃখ স্পর্শ করছে না একটি পরিবারকেও।
সাংবাদিকরা বেহেশতের ছবি তুলছেন
অবিরাম প্রেমের গান গাইছেন কবিরা
তারা সবাই গাজা থেকে এসেছেন।
আসমানে একটি নতুন গাজা গড়ে তোলা হচ্ছে
এমন একটি গাজা- যা অবরুদ্ধ নয়।’
ফিলিস্তিনী কবি ও ঔপন্যাসিক হিবা আবু নাদার সর্বশেষ কবিতা এটি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে এই কবিতাটি পোস্ট করেন আবু নাদা। বলা হয়, কবিরা সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। তাহলে কি গাজা উপত্যকার এই নারী কবি বুঝতে পেরেছিলেন সহসা ফিলিস্তিনীদের মুক্তি নেই, আর থাকলেও সেটি দেখার সুযোগ তার হবে না! সে কারণেই হয়তো বেহেশতে নতুন গাজা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। সেখানেই নিতে চেয়েছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস।
যে গাজা হবে মুক্ত, যেখানে জমবে না লাশের স্তুপ, আহতের আর্তচিৎকারে ভারি হবে না পরিবেশ, ঘুমন্ত মানুষকে পুড়িয়ে দেবে না ইসরায়েলী বোমা। আবু নাদা এখন তার সেই স্বপ্ন পথেরই যাত্রী। খান ইউনুস শহরে ইসরায়েলের একটি মিসাইল হামলায় গত ২০ অক্টোবর মৃত্যু হয়েছে ৩২ বছর বয়সী এই কবির। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই গাজা উপত্যকা নামক উন্মুক্ত বন্দীশালা থেকে ‘মুক্তি’ মিলেছে তার।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামাসের হামলার পর পাল্টা হিসেবে গাজায় নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলী বাহিনী। এই হামলায় প্রাণ হারাচ্ছে নারী, শিশু, বৃদ্ধ সবাই। মৃতদের তালিকায় নাম উঠেছে আরবি সাহিত্য জগতে অল্পদিনেই সম্ভাবনা জানান দেওয়া হিবা আবু নাদার। সম্ভাবনার প্রদীপ আলো ছড়ানোর আগেই নিভিয়ে দিয়েছে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান। ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের সংস্কৃতি বিভাগ তাদের ওয়েবসাইটে আবু নাদার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
আবু নাদার জন্ম ১৯৯১ সালের ২৪ জুন সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কায়। উদ্বাস্তু হিসেবে সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছিল তার পরিবার। পরে দেশে ফিরে গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োক্যামেস্ট্রিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর মিশরের আল আজহার ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন বিভাগে। মিশর থেকে পড়াশোনা শেষ করে আবার ফিরেছেন গাজায়। সেখানেই কাজ করতেন মানুষের কল্যাণে। চাইলেই জন্মভূমি সৌদি আরব কিংবা উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া মিশরে বসবাসের সুযোগ পেতেন; কিন্তু আবু নাদা অবরুদ্ধ গাজাকেই ভালোবেসেছেন। থেকে গেছেন স্বজাতির কাছে। তাদের সাথে নিয়েই করেছেন মুক্তির অপেক্ষা।
আবু নাদা ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির সাথে জড়িয়ে ছিলেন। কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন বেশ কিছু। সাহিত্য চর্চার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭ জিতেছেন ‘শারজাহ অ্যাওয়ার্ড ফর আরব ক্রিয়েটিভিটি’। তখন তার বয়স ছিলো ২৭ বছর। ওই বয়সেই আরবি সাহিত্যের জগতে আলোড়ন তোলে তার উপন্যাস ‘অক্সিজেন ইজ নট ফর দ্য ডেড’। এই বইটির জন্যই শারজাহ সাহিত্য উৎসবের মঞ্চে ডাক পড়ে তার, জিতে নেন পুরস্কার। পাঠকপ্রিয় বইটির এখন পর্যন্ত চারটি সংস্করণ বাজারে এসেছে।
কবি আবু নাদা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। যেটুকু জানা যায় তাতে বোঝা যাচ্ছে, তিনি দেশ ও জাতি নিয়ে খুবই সচেতন ছিলেন। তার গল্প, কবিতায় ফুটে উঠতো ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও জীবনবোধ। ফিলিস্তিনীদের সাত দশকের দুর্ভোগের চিত্রও পাওয়া যেত তার লেখায়। গাজা উপত্যকায় বিভিন্ন সামজিক কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িত ছিলেন বলেও জানা যায়।
মৃতুর আগে অক্টোবরের ৮ তারিখ সর্বশেষ টুইটারে (এক্স) পোস্ট দিয়েছিলেন আবু নাদা। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘রকেটের শিখা ছাড়া গাজার রাত্রি অন্ধকার, বোমার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই, ইবাদতের স্বস্তি ছাড়া পুরোটা সময় ভয়ঙ্কর, শহীদদের উজ্জলতা ছাড়া সব কিছুই কালো। শুভ রাত্রি গাজা।’
আবু নাদার মৃত্যু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উদারমনা সাহিত্যিকদেরও নাড়িয়ে দিয়েছে। ব্রিটেনে জন্ম নেয়া সাইপ্রিয়ট কবি, লেখক অ্যান্থনি অ্যানাজাগোরু আবু নাদার লেখা শেষ কবিতাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। আরো অনেকে শোক জানিয়েছেন আবু নাদার মৃত্যুতে।
গাজায় এবারের ইসরায়েলী হামলায় মৃত্যু হয়েছে আরো কয়েকজন লেখকের। তাদের একজন আতেফ আবু সাইফ। পরিবারের কয়েকজন সদস্যসহ তিনি নিহত হন ইসরায়েলী মিসাইল হামলায়। ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা কমা প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও রা পেজ জানিয়েছেন, মৃত্যুর আগের দিনও খান ইউনুস শহরের তাল আল-হাওয়া এলাকায় ইসরায়েলী বোমা হামলায় বিধ্বস্ত কয়েকটি বাড়িতে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন আতেফ আবু সাইফ। কমা প্রেসকে তিনি ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে জানিয়েছেন হামলার ভয়াবহতার কথা। জানিয়েছেন, খালি হাতে ধ্বংস্তুপ সরিয়ে বের করেছেন নিহতদের আর বাসিন্দাদের নাম ধরে ধরে চিৎকার করে ডেকেছেন কাউকে জীবিত পাওয়ার আশায়।
আরো একাধিক লেখক, অনুবাদকের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে প্রকাশনা সংস্থাটি। তাদের একজন কমা প্রেসের কন্ট্রিবিউটর তালাল আবু শয়িশ।
Discussion about this post