গত ৭ অক্টোবর (শনিবার) সশস্ত্র ফিলিস্তিনী গোষ্ঠী হামাস একাধিক ফ্রন্টে ইসরায়েল ওপর আক্রমণ করে। তারা এই হামলার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’। রকেট ছোঁড়ার পাশাপাশি গাজা সীমান্তের শক্তিশালী সীমানা প্রাচীর ভেঙে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে তারা।
নজিরবিহীন এই অভিযান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় দেশের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এ হামলায় প্রায় ১,৩০০ নিহত এবং ৩,৩০০ জনেরও বেশি আহত হয়। পরে গাজায়, ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় ৭০০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়।
গত ৯ অক্টোবর ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় “সম্পূর্ণ অবরোধ” ঘোষণা করে বিদ্যুৎ, খাদ্য, জ্বালানী এবং পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ‘স্থল আগ্রাসন’ মানে সেখানকার ২.৩ মিলিয়ন বাসিন্দাকে লক্ষ্যবস্তু করে অন্যায়ভাবে সহিংসতা চালিয়ে যাওয়া। এই সহিংসতার মাত্রা আরো খারাপ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গাজা শরণার্থী শিবিরে বেড়ে উঠা ব্যক্তি হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের প্রতিরক্ষার লড়াই এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পৌঁছেছে।
দশকের পর দশক অন্যায়-অত্যাচার, অমানবিকতা এবং দুর্ব্যবহারের শিকার ফিলিস্তিনীদের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে জন্ম নিয়েছে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’, যা প্রমাণ করে ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে না পারবে মুছে ফেলতে, না পারবে তাদের ন্যায়সঙ্গত মুক্তির সংগ্রাম থামাতে।
এতে এটাও প্রমাণিত হয়েছে ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ আরো শক্তিশালী ও গঠনমূলক হয়ে উঠছে। বছরের পর বছর নিপীড়ন, জাতিগত নির্মূল অভিযান, অবরোধ ও গণহত্যা সহ্য করার পরেও, ফিলিস্তিনীরা এখনও সীমিত সম্পদ নিয়ে ইসরায়েলের মোকাবেলা করতে পারে; যদিও তাদের এই প্রতিরোধের শক্তি কিংবা সাহস কোথা থেকে আসে তা সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল নই। এই অপারেশন প্রমাণ করে গত ত্রিশ বছরে ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ ব্যবস্থা কতটা বদলে গেছে। ছোট, অসংগঠিত গোষ্ঠী হামাস, যারা কিনা শরণার্থী শিবিরে কেবল মোলোটভ ককটেল ব্যবহার করতো আজ তারা প্যারাগ্লাইডারে করে ইসরায়েল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে তাদের “আয়রন ডোম” প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাঙতে শত শত রকেট ছুঁড়ছে। এই রূপান্তর ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ কৌশলের অগ্রগতিই তো, না কি?
এই সাম্প্রতিক আক্রমণগুলো নিজের প্রতি ইসরায়েলেরে দৃষ্টিভঙ্গি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার অবস্থানের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
দীর্ঘদিন ধরে, ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান ও বৃহত্তর পশ্চিমা স্বার্থের শীর্ষ ও সবচেয়ে কার্যকর রক্ষক হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করে আসছিল, বিশেষ করে ইরান এবং অন্যান্য উৎস থেকে হুমকি মোকাবেলায়। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলী সরকার আরব দেশগুলোর সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষের হুমকির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করতে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
তবে ৭ অক্টোবরের অনুপ্রবেশ প্রমাণ করে ইসরায়েল তার সীমানা রক্ষায় এখনো অক্ষম। এই ঘটনা ইসরায়েলের নিরাপত্তা সম্পর্কিত অনুমান এবং প্রতিশ্রুতির বৈধতা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, একটি সু-সংগঠিত আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার পর, ইসরায়েল তার সামরিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর না করে, দ্রুত ঔপনিবেশিক সমর্থকদের কাছ থেকে বাস্তব ও প্রতীকী সহায়তা চেয়েছে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত বহিরাগত সমর্থনের ওপর ইসরায়েলের নির্ভরতাকে তুলে ধরে। এটি সত্যিই বিদ্রুপের বিষয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একটি জাতিকে অতিরিক্ত সামরিক সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে যারা কিনা ইতিমধ্যেই শক্তভাবে সুরক্ষিত এবং বার্ষিক ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পায়।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি এবং ইউরোপীয় নেতাদের আশ্বাস সত্ত্বেও, গত সপ্তাহের ঘটনাগুলো উপেক্ষা করা কঠিন। এই সময়ে, ইসরায়েল এমন একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করতে পারেনি যারা শুরু থেকেই অবরোধ ও আক্রমণের সম্মুখীন। ঘটনাগুলো পশ্চিমের মিত্র হিসেবে ইসরায়েলের ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। শেষ পর্যন্ত, যে জাতি উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি এবং সামরিক সরঞ্জাম দিয়েও নিজের সীমানা সুরক্ষিত করতে পারেনি, মধ্যপ্রাচ্যের মত অত্যন্ত অস্থিতিশীল অঞ্চলে তার মিত্রদের নিরাপত্তা সমস্যা মোকাবেলায় তার ভূমিকা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম।
অপারেশন ’আল-আকসা ফ্লাড’ ইসরায়েল এবং তার আরব প্রতিবেশীদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনাকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২০২০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় হিসাবে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ চুক্তি বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থাপন করা হয়।
৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে অনুপ্রবেশ এবং গাজার মানুষের ওপর ইসরায়েলের অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিশোধমূলক হামলার পর আরব জনগণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে। এতে তারা বলেছে, ফিলিস্তিনীরা ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা অর্জন না করলে এই অঞ্চলে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। আরব বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদসহ রাস্তায় বিক্ষোভ করে ফিলিস্তিনীদের সাথে তাদের সংহতি প্রকাশ করেছে। ফিলিস্তিনীদের ওপর নিপীড়ন, দখলদারিত্ব ও দুর্ব্যবহার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এবং এই অঞ্চলের লক্ষাধিক ফিলিস্তিনী শরণার্থীকে পৈতৃক বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তাদের নেতাদের ইসরায়েলের সাথে সর্ম্পক স্বাভাবিককরণের প্রচেষ্টা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী নেতারা এখন দ্বৈত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এক, তারা ইসরায়েলের সীমানা সুরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে ভাবছেন। দুই, ফিলিস্তিনীদের সাহায্য করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া, যা তাদের সংবিধানে উল্লেখ আছে।
এর মধ্যে ইসরায়েল আরেকটি স্থল আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে যা হবে অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণ । এছাড়া হিজবুল্লাহর মতো শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সাথে আঁতাত করে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এতে করে ওই ভূখণ্ডের সংঘাত অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এতে ইসরায়েলের সাথে আরব দেশগুলোর স্বাভাবিক সম্পর্ক ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
উপরন্তু ১৬ বছরের অবরোধ, অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ক্রমাহত দুর্ভোগের পর, গাজার ফিলিস্তিনীরা নতুন করে ধ্বংসাত্মক ভূমি আগ্রসনের ঝুঁকিতে রয়েছে। তাছাড়া গাজায় ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান অসামঞ্জস্যপূর্ণ সহিংসতা এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য শুধু হামাসের অনুপ্রবেশের প্রতিশোধ নেওয়া নয়; বিশ্বদরবারে শক্তির প্রদর্শনও বটে। গত ৭ আক্টবরের ঘটনা মূলত ইসরাইলের দুর্বলতা উন্মোচন করেছে। প্রশ্ন উঠছে, ইসরায়েল এই অঞ্চলে তার মিত্রদের কতটা নিরাপত্তা দিতে পারবে। আরব জনগণেল সমর্থন সবসময় ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে আছে। সমস্ত ফিলিস্তিনী নিরাপদ ও মুক্ত অবস্থায় দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ মেনে নেবে না তারা। গাজার দুর্বল জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের সহিংস কর্মকাণ্ড তার ভাবমূর্তি উন্নত করার একটি প্রচেষ্টা মাত্র । এর মাধ্যমে দেশটি মূলত ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ শক্তি কিংবা সক্ষমতাও বুঝতে চাইছে।
আল জাজিরা
Discussion about this post