নিউ ইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের র্যাংঙ্কিংয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের মধ্যকার রেটিংয়ে ডি গ্রেড পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গভর্নরদের মূল্যায়ন করে আসছে গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনটি। সাময়িকীটির বার্ষিক প্রকাশনা হিসেবে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ‘সেন্ট্রাল ব্যাংকার রিপোর্ট কার্ড’।
মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের সুরক্ষা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুসংহত করার মতো বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করেই এই গ্রেডিং করা হয়। এসব বিষয়ে যে গভর্নর যত ভালো করেন, তিনি তত ভালো গ্রেড পান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ১০১ জন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মধ্যে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তৈরি করা সূচকে ডি গ্রেড পেয়েছেন। একই র্যাংঙ্কিংয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর শক্তিকান্ত দাস পেয়েছেন এ প্লাস এবং শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল ভীরাসিংহে পেয়েছেন এ মাইনাস, নেপালের মহাপ্রসাদ অধিকারী পেয়েছেন বি মাইনাস। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জামিল আহমেদ পেয়েছেন সি মাইনাস।এই সুচকে পাকিস্তানের পেছনে পড়ে গেছে বাংলাদেশ।
বিগত বছরগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের গ্রেড ছিল সি। ২০১৫ সালে তিনি ‘বি মাইনাস’ গ্রেডে উন্নীত হন। পরবর্তী গভর্নর ফজলে কবির ২০১৭ সালে বি গ্রেড অর্জন করেন। তবে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তার গ্রেড ছিল নিম্নমুখী। ওই দু’বছর তিনি পান ডি গ্রেড। ২০২০ ও ২০২১ সালের জন্য ফজলে কবিরকে সি গ্রেড দেয় ম্যাগাজিনটি।
গভর্নর হিসেবে এ প্লাস পেয়েছেন মাত্র তিনজন গভর্নর। ভারতের বাইরে দুজন হচ্ছেন— সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর টমাস জর্ডান ও ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নগুয়েন থি হোং।
ভারত সম্পর্কে এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে (এপ্রিল-মার্চ) ভারতের অর্থনীতি ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এ ধারা বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সূচকেও ভালো করে ভারত। যেমন মূল্যস্ফীতি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশটিতে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ছিল ৬ শতাংশ, মে মাসের মধ্যে তা ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে তারা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আরবিআই এ সময়ের মধ্যে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে ছয় দফায়। আরবিআইয়ের এই কৃতিত্বের মূল কান্ডারি গভর্নর শক্তিকান্ত দাস। এ ছাড়া দেশটির ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায়ও সফল শক্তিকান্ত দাস। সে কারণে তিনি এ প্লাস পেয়েছেন।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে টাকার ৯ দশমিক ৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়। দেশের বাজারে ডলার–সংকটে হিমশিম খান আমদানিকারকেরা। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যমূল্য অনেকটা বেড়ে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ।
এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণের কারণে মূল্যস্ফীতির মতো বাহ্যিক ধাক্কার মুখে নাজুক অবস্থানে পড়ে যায় বাংলাদেশ।’
সরকারের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছে গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন। বহিস্থ খাতের অনিশ্চয়তা ও চাপের মুখে অর্থনীতি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। ২০২২ সালের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতির বহিস্থ খাতে যে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেটা উল্লেখ করে দেশের অর্থনীতির অনিশ্চয়তার চিত্র তুলে ধরেছেন তারা।
এই প্রতিবেদনটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সিনিয়র অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কর্মক্ষমতার চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থার প্রতিফলন বেশি।’
তবে অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, ‘এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা উচিত নয়।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা সরকারের আর্থিক নীতি বাস্তবায়ন করেন।’ দেশের নীতিগুলো সহায়ক না হলে কোনো কেন্দ্রীয় গভর্নর একা ভাল কাজ করতে পারবেন না।’
এই প্রতিবেদনে দেশের দুর্বল রাজস্ব আদায়, মূল্যস্ফীতি এবং টাকার মানের অবমূল্যায়নের প্রতিফলন ঘটেছে।
আলোচনা চলছে শ্রীলঙ্কা নিয়েও। দেউলিয়াত্ব ও মূল্যস্ফীতিসহ ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কার গভর্নর নন্দলাল বীরাসিংহে পেয়েছেন এ মাইনাস গ্রেড। দেশটিকে সংকট থেকে তুলে আনতে তার ভূমিকার কথা বলা হয়েছে ওই রিপোর্ট কার্ডে। দুর্দশাগ্রস্ত শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের ভালো করার কারণ হলো, দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে তিনিই মূলত নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগস্টে দেশটির মূল্যস্ফীতি ২ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। তাঁর নেতৃত্বে দেশটি সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, যদিও এ বছর শ্রীলঙ্কা প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না বলে মনে করছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তাঁর নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কার যে পুনরুদ্ধার হচ্ছে, সেই কৃতিত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে। সে কারণেই তিনি এ মাইনাস পেয়েছেন।
ম্যাগাজিনটির বিশ্লেষণে গভর্নরদের মূল্যায়নের মাপকাঠি হিসেবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের সুরক্ষা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুসংহত করার মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে। যেসব সূচকে গত এক বছরে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে বলে বলছে, গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় দুর্বলতা হিসেবে অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ক্যারিয়ারে একজন সফল মানুষ। তিনি যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রীধারী। তিনি তার ক্যারিয়ার জীবনে বেশির ভাগ সময় রাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি অর্থমন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের দায়িত্ব পালন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে তার নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১২ জুলাই, ২০২২। তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা পেলে হয়তো এই চিত্রের কিছুট উন্নতি ও হতে পারতো। তাই এই অবস্থার এককভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে দায়ী করা ঠিক হবে না, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থীতি যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম তার সার্বিক বিশ্লেষণ করে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নয় বরং বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিচ্ছবিই ফুটে উঠেছে। তাছাড়া ভারত এবং শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংককের গভর্নররা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীন। তারা তাদের মতামত দিতে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন এবং প্রয়োজনে দেশের অর্থনীতিবিদদের পরামর্শও নিতে পারেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার সুযোগ খুব সীমিত।
Discussion about this post