২৭ সেপ্টেম্বর, বুধবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকবে কি না, গণতান্ত্রিক অধিকার থাকবে কি না, জনগণ তার প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে কি না—সবকিছু নির্ভর করছে আগামী কয়েকটা দিনের ওপর।
তার এ বক্তব্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এমনিতেই অক্টোবরে বিএনপি চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবে বলে আলোচনা তুঙ্গে। বিএনপির পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, তফসিল ঘোষণার আগেই তারা পরিস্থিতি পাল্টে দিতে চায়। অর্থাৎ, আন্দোলন সফল করতে চায়। তবে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, তারা ক্ষমতা ছাড়বে না এবং সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন হবে।
এর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর, সোমবার রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে এক জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে ৩৬ দিনের আল্টিমেটাম দেন।
এ ৩৬ দিনের মধ্যে তিনি বিএনপিকে ‘অপরাজনীতি, আগুন সন্ত্রাস, নাশকতার রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ বন্ধের আহ্বান জানান। তা না হলে বিএনপির ‘হাত গুড়িয়ে দেওয়া হবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
২৭ সেপ্টেম্বর, বুধবার তিনি বিষয়টি আরো পরিস্কার করে বলেন, ‘নানা রকম জগাখিচুরি ঐক্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে হটানো যাবে না। ৩৬ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছি বিএনপিকে। এই ৩৬ দিন বিএনপিকে দাঁড়াতে দেবো না। সব জায়গা বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের দখলে থাকবে, শেখ হাসিনার কর্মীদের দখলে থাকবে।’
প্রশ্ন হলো, ওবায়দুল কাদের ৩৬ দিন বলতে কী বুঝিয়েছেন? ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী ৩৬ দিন হিসাব করলে হয় নভেম্বেরের শুরু।
যা করতে চায় আওয়ামী লীগ
আগামী ১ নভেম্বর থেকে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। সংবিধান অনুসারে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এ সময়ে যে সরকার থাকবে, তা নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে পরিচিত।
যদিও ভোটের তফসিল কবে ঘোষণা করতে হবে, এ বিষয়ে আইনে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে, ইসি থেকে এমন বক্তব্য পাওয়া গেছে।
২৬ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী ২৯ জানুয়ারি তারিখের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে।
সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ভোট গ্রহণ করা হয়। এবার তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত দুই মাসের মতো সময় রাখতে চায় ইসি।
ইসি সূত্র বলছে, বর্তমান কমিশন মূলত মনোনয়নপত্র বাছাই ও আপিলের জন্য বেশি সময় রাখতে চায়। তারা মনে করছে, আপিল শুনানির জন্য সাধারণত যে সময় রাখা হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। এ ক্ষেত্রে এক সপ্তাহের মতো সময় রাখতে চায় ইসি। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও এবার আগের চেয়ে বেশি সময় রাখার চিন্তা আছে।
প্রশাসন সূত্র জানায়, এবার তফসিল ঘোষণার পর লম্বা সময় নেয়ার কারণ, পরিস্থিতির জন্য যেন তারা প্রস্তুতি নিতে পারেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যত দ্রুত তফসিল ঘোষণা করা যায় তত সরকারের সুবিধা। তারা মনে করছে, তফসিল ঘোষণা করলেই নির্বাচনের সময় শুরু হয়ে যাবে। তখন নির্বাচনী কাজে বাধা দিলে বিএনপিসহ বিরোধীদের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আনার যৌক্তিক ক্ষেত্র তৈরি হবে। আর যদি ভিসা নিষাধাজ্ঞা তখন যুক্তরাষ্ট্র না দেয়, তাহলে আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলতে পারবে। চীন বা রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে যাওয়ারও যুক্তি তারা দেখাতে পারবে। অবশ্য, বিএনপিকে ছাড়া এক তরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলে স্বীকৃতি দেবে কি না সেটি স্পষ্ট নয়।
একই সঙ্গে অনেকের মতে, ভারত এবার সরাসরি আওয়ামী লীগকে আগের মতো সমর্থন না দিলেও, মনে মনে তাদেরই চায়। দিল্লি চায় আওয়ামী লীগ ভোট করে ক্ষমতায় আসুক। হাতের পাঁচ হিসেবে তারা জাতীয় পার্টিকে রেখেছে। এ ছাড়া তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমের মতো দলগুলোও রাজি আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে যেতে। জামায়তের দলছুট নেতারাও নির্বাচনে যেতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি থেকেও দলছুট কেউ কেউ আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবেন।
ফলে এটা অনেকটা পরিষ্কার যে, সরকারের সার্বিক প্রস্তুতি আছে নভেম্বরেই তফসিল ঘোষণার। সেটা যত দ্রুত সম্ভব তারা করতে চায়। আর অক্টোবরে মোকাবিলা করতে চায় বিএনপিকে। সেই হুঁশিয়ারিই দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, এ সময়ে সরকারকে ‘পাহারা’ দেবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিএনপি অক্টোবরে সরকার পতনের দাবিতে ঢাকা অচল করে দিতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে এ পরিকল্পনা ক্ষমতাসীন দলটির। অক্টোবর মাসজুড়ে প্রায় প্রতিদিন সভা–সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থেকে সরকারকে ‘পাহারা’ দিতে চান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
বুধবার ওবায়দুল কাদের বিএনপির উদ্দেশ্য আরো বলেছেন, ‘অক্টোবরে নাকি ভাগ্য নির্ধারণ হবে। ফখরুল বলে, মির্জা আব্বাস বলে ভাগ্য নির্ধারণ করবে অক্টোবরে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করতে চাই, ঘরের মধ্যে ঘর, মশারির মধ্যে কত মশারি। তারা আমাদের ভাগ্য কী নির্ধারণ করবে? খেলা হবে, খেলা হবে। জবাব দেবো সব দুঃশাসনের। ওদের আন্দোলন ভুয়া, ওদের এক দফা ভুয়া, ওদের সাতাশ দফা ভুয়া, ওদের গণতন্ত্র ভুয়া, ওদের ক্ষমতা ভুয়া।’
কী করবে বিএনপি
এ পরিস্থিতিতে বিএনপি এবং তাদের সঙ্গে থাকা অন্যান্য দলগুলো আসলে কী করবে, কীভাবে নিজেদের দাবি আদায় করবে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপির ঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অক্টোবরের ৫ তারিখে আপাতত শেষ হচ্ছে। এরপর তারা কী ধরনের কর্মসূচি দেবে তার কোনো ধারণা কেউ দিতে পারছে না। এমনকি দলের অনেক নেতাও জানেন না আগামীতে কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে।
যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ কেউ বলছেন, তফসিল ঘোষণা হলে হরতাল আহ্বানের দিকে যাবেন তারা। দলটির জ্যেষ্ঠ অনেক নেতাই এমন বক্তব্য দিয়েছেন। তবে রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তফসিলের পর আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা কমে যাবে।
বিএনপির বিভিন্ন সূত্র জানায়, কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হবে তা আগে থেকে সবাইকে বলা হবে না। এতে তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চূড়ান্ত কোনো কর্মসূচি নেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ঘোষণা দেওয়া হবে।
দলটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অবরোধ, ঘেরাওয়ের কথা বলা হয়েছে। আদালত, সচিবালয় এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের কথাও উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। তবে এখন পর্যন্ত তারা একটাই অবরোধের কর্মসূচি পালন করেছে। সেটা ছিল ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখ কিছু সময়ের জন্য অবরোধ করে রাখা। তবে ওই কর্মসূচি ব্যর্থ বলে ব্যাপক প্রচার পায়। ছাত্রদল সভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতাকে সরিয়ে দিয়ে বিএনপিও জনমনে এ ধারণা দিয়েছে যে ওই কর্মসূচি ব্যর্থ ছিল। এমনকি স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও ওইদিনের কর্মসূচি ব্যর্থ হওয়ার কারণে কথা শুনতে হয়েছে বলে জানা যায়।
অবশ্য বিএনপির পরের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের বিপুল উপস্থিতি দেখা গেছে। তারা যে কোনো কঠোর কর্মসূচির জন্য প্রস্তুত বলেও জানাচ্ছেন বিভিন্নভাবে।
বিএনপির সূত্র জানায়, ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত তারা যে কর্মসূচি পালন করছে এর মূল উদ্দেশ্য নেতাকর্মীদের ‘ওয়ার্ম আপ’। যে কারণে রোড মার্চকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এক জেলার নেতাকর্মীরা অন্য জেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকার প্রবেশ মুখগুলোতে তারা সমাবেশ করছে। এর উদ্দেশ্য আন্দোলনের জন্য ঢাকার আশপাশকে প্রস্তুত করা। বিএনপির কঠোর আন্দোলনের ছায়া এসব কর্মসূচিতে পাওয়া যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতারাও বলছেন, বিএনপি অক্টোবরে রাজধানী ঢাকা অচল করে সরকার পতনের চেষ্টা চালাবে। এমনকি অঘোষিতভাবে বিএনপি হঠাৎ করে রাস্তায় নেমে যেতে পারে, এমনটাও বিবেচনায় রেখেছে ক্ষমতাসীন দল। সে ধরনের পরিস্থিতিতে স্বল্প সময়ের নোটিশে রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে দলের নেতাকর্মীদের।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ নিয়েও ভাবতে হচ্ছে বিএনপিকে। তারা জানায়, সরকারি দলের পক্ষ নিয়ে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী এত বছর ধরে যে ধরনের আচরণ করে আসছিল, তা থেকে বের হতে বিএনপি তাদের আহ্বান জানিয়ে আসছে। প্রায় সব সমাবেশেই নেতারা পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন কোনো পক্ষে কাজ না করতে।
সোমবার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজধানীর ধোলাইখালের সমাবেশে বলেছেন, এরই মধ্যে মার্কিন ভিসা নীতির প্রভাব প্রশাসনে পড়তে শুরু করেছে। দলটির দাবি, কয়েকটি সংবাদমাধ্যমেও পুলিশ এবং প্রশাসনে এর প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
বিএনপি মনে করছে, মার্কিন ভিসা নীতির কারণে আগের মতো পুলিশ আর আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করতে পারবে না। এর সুবিধা তারা আন্দোলনে নিতে পারবে। তাদের দাবি আন্দোলন শান্তিপূর্ণই থাকবে, যদি না সরকারি দলের পক্ষ থেকে কোনো বাধা আসে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র আরো নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। সরকার যত মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে, তত তারা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে বলেই যুক্তরাষ্ট্রের হাবভাবে মনে হচ্ছে। এ পরিস্থিতির সুযোগ বিএনপিকে কাজে লাগাতে হবে। আর সেটা তফসিল ঘোষণার আগেই। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে বিএনপির করার তেমন কিছু থাকবে না। তখন যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরেও যায়, তাহলে সুবিধা নেবে তৃতীয় কোনো পক্ষ।
Discussion about this post