জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোর শীর্ষে অবস্থান খাদ্যপণ্যের। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি এখন আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। গত তিন মাস ধরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে। অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছর এই সময়ে এই হার ছিল ৮.৫০ শতাংশ। অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এ বছর মার্চ মাস থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর আছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হিসাবটা একটু সহজ করে বললে বলা যায়, গত বছর অক্টোবর মাসে একজন ভোক্তা চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ-মাংসসহ যাবতীয় খাদ্যপণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতো, তাহলে এ বছরের অক্টোবরে একই খাবার কিনতে তার খরচ হচ্ছে ১১২ টাকা ৫৬ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খাবার কেনায় খরচ প্রতি ১০০ টাকায় বেড়েছে ১২ টাকা ৫৬ পয়সা। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে এখন খুবই কষ্ট হচ্ছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। কখনো ডিমের দাম বাড়ে, আবার কখনো পেঁয়াজ, আলুর দাম বাড়ে। শাকসবজি, মাছ-মাংসের দামও অনেক বেশি। দিন দিন খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরো ঝুঁকির মধ্যে চলে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত এক বছরে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার কোনটাই তেমন একটা কাজে আসেনি। যেমন ডিম, পেঁয়াজ ও আলু আমদানি পর বাজারে বিশেষ প্রভাব পড়েনি। এ ছাড়া আগামী কয়েক মাস রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় আগামী দু–তিন মাস মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা কম। এতে গরিব মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। এখন গ্রাম আর শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির মধ্যে তেমন বেশি তারতম্য নেই, প্রায় সমান। বিবিএস-এর তথ্য মতে, গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর শহরে এই হার কিছুটা বেড়ে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
বাংলাদেশে গত এক বছরে চাল ও আটার মতো পণ্যের দাম তেমন না বাড়লেও শুধু অক্টোবরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে সর্বোচ্চ হয়েছে। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বেশিরভাগ সময় সিন্ডিকেটের দিকে আঙুল তোলা হলেও এর পেছনে আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। অনেক সময় উৎপাদন বেশি হলেও বাজারে ঠিকমতো সরবরাহ হয় না। আবার উৎপাদন ও আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও পড়েছে অনেক পণ্যের দামে। আবার সরকারি যেসব তথ্য দেওয়া হয়, তাতেও প্রকৃত অবস্থার সাথে তারতম্য থাকে। সরকারী তথ্যে দেখা যায়,আমাদের দারিদ্র্যের হার কমেছে। বাস্তবে কি আসলে কমেছে? উন্নয়ন হয়েছে অবকাঠামোগত। সবচেয়ে বেশি বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের। এর ফলে বাজারে আরো প্রভাব পড়েছে। আমরা এখন তথ্য দিয়ে মিথ্যাকে জায়েজ করার চেষ্টা করছি। কারণ তথ্য যারা বানাচ্ছে, তারা যদি সত্য না বলে তবে তথ্যও সত্য হয় না। মানুষ এখন অনেক বিপর্যস্ত।
বাজারে মোটা চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে মানুষের দুর্ভোগ অনেক বেড়ে গেছে। গত একবছরে অনেক পণ্যের দাম একেবারেরই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, আলু, কাঁচামরিচ ইত্যাদি। এছাড়াও দামে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে সব ধরনের মাংস এবং মাছের।
টিসিবির তথ্য মতে, দেশি পেঁয়াজের দাম গত এক বছরে ১৪০.৯১ শতাংশ এবং আমদানি করা পেঁয়াজে ১০০ শতাংশ বেড়েছে। দেশি পেঁয়াজ এক বছর আগে ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ১৩০-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর আমদানি করা পেঁয়াজ ৪৫-৫৫ টাকা থেকে এখন ৯০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশে এ বছর পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল প্রায় ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু মজুদের সুবিধা না থাকায় এর প্রায় ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আমদানি করতে হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ। তারপরও পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। আমদানি করেও পরিস্থিতি পুরোপুরি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। গত এক বছরে আলুর দাম ৮২.৬৯ শতাংশ বেড়েছে। এক বছর আগে আলুর দাম ছিল প্রতি কেজি ২৪-২৮ টাকা, যা বর্তমানে কেজিপ্রতি ৪৫-৫০ টাকা। আমাদের আলুর চাহিদা ৮৫-৯০ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলু উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ১২ লাখ টন। তারপরও আলুর দাম বেড়েছে ৮২.৬৯ শতাংশ। এবং গত এক বছরে প্রায় সব ধরনের মাছ-মাংসের দাম বেড়েছে। ব্রয়লার মুরগির দাম গত এক বছরে ৭.৪৬ শতাংশ, খাসির মাংস ১১.৭ শতাংশ, গরুর মাংস ১২.৫ শতাংশ, ইলিশ ৫.৪১ শতাংশ, রুই ২৫ শতাংশ বেড়েছে। দেশি মুরগির দাম এক বছরে কেজিপ্রতি ২৮.২৬ শতাংশ বেড়েছে। আগে কেজিপ্রতি দাম ৪২০-৫০০ টাকা ছিল। এখন এই দাম ৫৩০-৬৫০। দারুচিনি ও এলাচ ছাড়া সব ধরনের মশলার দাম বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রসুনের দাম। গত এক বছরে এই পণ্যটির দাম ১২৭.৭৮ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের ৮০-১০০ টাকা কেজি দরে রসুন বিক্রি হলেও বর্তমানে ১৯০-২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি ও আমদানি করা আদার দাম ২৩ শতাংশ থেকে শুরু করে ৪৫.১৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া শুকনা মরিচ, হলুদ, জিরা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনে ও তেজপাতারও দাম বেড়েছে। গত এক বছরে প্রতি হালি ডিমের দাম শতকরা ৫.২৬ শতাংশ বেড়েছে। ডিমের দাম কমাতে এরই মধ্যে ডিম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ভারত থেকে বাংলাদেশে ডিম আসতেও শুরু করেছে। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কাঁচামরিচের দাম গত এক বছরে কেজিপ্রতি ১৮০ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর কাঁচা মরিচ ৪০-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে এই পণ্যটি ১০০-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও কাঁচামরিচ সর্বোচ্চ ৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। চিনির দাম গত এক বছরে ১২৫ শতাংশ বেড়েছে। এক বছর আগে চিনির দাম প্রতি কেজি ছিল ১২০ টাকা। বর্তমানে এটি সর্বোচ্চ ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উচ্চমূল্যের বাজারে জীবনযাপন সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এখন সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। খাবারের প্লেটে মাছ ও মাংসের উপস্থিতি কমেছে। কারণ, এগুলো এখন সাধ্যের বাইরে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট ও নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত করেছে মূল্যস্ফীতি।
বেশিরভাগ খাদ্য পণ্যের দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে, সাধারণ মানুষকে আয়ের বেশিরভাগ ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যপণ্য কিনতে।
দাম বাড়ার পেছনে যুদ্ধ এবং বাজার সিন্ডিকেটের যোগসাজশের যুক্তি থাকলেও মূলত উৎপাদন ও সরবরাহ কম থাকার কারণেই খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। গত এক বছর চাল এবং আটার দাম খুব একটা না বাড়লেও এ দুটি পণ্য মানুষের প্রধান খাবার এবং মানুষ এগুলোর সাথে আরো পণ্য মিশিয়ে তারপর ভোগ করে। এতে করে অন্যান্য পণ্য যেমন সবজি, মাছ-মাংস ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা বাড়ে, চাহিদার সাথে সরবরাহের ভারসাম্য না থাকার কারণে সেগুলোর দাম বেড়েছে। ফলে চাল ও আটার তুলনায় পরিমাণে কম ব্যবহৃত হলেও সবজি, মাছ-মাংস ইত্যাদির দাম বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তাছাড়া চাল ছাড়া বাংলাদেশ আর কোনো পণ্যেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ না। বাকি প্রায় সব খাদ্যপণ্যই আমদানি করতে হয়। তাছাড়া পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন এবং দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা পণ্যের উচ্চমূল্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, ৩০ শতাংশ রিজার্ভ হ্রাস- এসব কারণে আমদানিতে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়েছে। ডিজেলের উচ্চমূল্য সেচ ও কৃষিপণ্যের দামে প্রভাব ফেলেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে পেট্রোলের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে, যা খুচরা বাজারে পণ্যের দামে প্রভাব ফেলেছে। সরকার পণ্যের মজুদ কমে যাওয়াটা টের পেয়ে যদি আগেই আমদানির অনুমতি দেয় তাহলে এই ঘাটতি তৈরি হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষত্রে এটা হচ্ছে না। যার কারণে ঘাটতি হওয়ার পরই আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনো পণ্যের ঘাটতি থাকলেও সেটির দাম বাড়ার আশঙ্কায় সরকার সেটি স্বীকারও করতে চায় না। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই আমদানির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে যে কয়েকটি জরুরি পণ্যের মার্কেট শেয়ার এখন কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। আমদানি থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত নিজেদের বলয় তৈরি করে নিজেদের শর্তে বাজারে পণ্য সরবরাহ করছে তারা। তাদের কথা মতো না চললে অন্যরা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। বাজারে ম্যানিপুলেশনের অভিযোগে বেশ কয়েকটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানাও করেছে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কেন্দ্রীয় বিপণন ব্যবস্থার ভেতরে যে অনিয়ম ও অস্থিরতা চলছে। সে কারণে শুধু কয়েকটি বাজারে নজরদারি ও জেল জরিমানা করে এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামানো অসম্ভব।
জরুরি ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলেছে তাতে আগামী দু-তিন মাস এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভবনা নেই। এ ছাড়া নীতি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও খুব তাড়াতাড়ি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ফলে খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) পরিধি বাড়াতে হবে। সার্বিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার খাদ্য পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমাতে পারতো। কিন্তু এ ধরনের কোনো উদ্যোগ এখনও নেই। বরঞ্চ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বেফাঁস কথাবার্তা শোনা যায়, যেমন- দেশের মানুষ এখন খুব ভাল আছে। মহিলারা তিন বার লপিস্টিক লাগায়। চার বার সেন্ডেল বদলায় ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে দেশের মানুষ এখন মূল্যস্ফীতির কারণে খুব কষ্টে আছে, সংশ্লিষ্টদের সেদিকেই নজর দেওয়া দরকার।
Discussion about this post