সরকারবিরোধী আন্দোলনের ‘মহাযাত্রায়’ বিএনপি ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গত ১৮ অক্টোবর এক সমাবেশ থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ কর্মসূচিকে ঘিরে রাজনীততে শুরু হয়েছে নতুন উত্তাপ। সরকারি দলের মন্ত্রী থেকে পুলিশ প্রশাসনও এ সমাবেশ নিয়ে কথা বলছেন। পাল্টা জবাব দিচ্ছেন বিএনপি নেতারাও।
এর আগে গত বছরেরর ১০ ডিসেম্বর নয়া পল্টনে সমাবেশ করা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা, সংঘর্ষ, প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। রাজধানীর নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়কে ঘিরে ওই সংঘর্ষ হয়। এতে একজন নিহত হন। পরে সমাবেশ নিয়ে যাওয়া হয় গোলাপবাগ মাঠে। মনে করা হয়, তখন বিএনপি সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। যদিও ওই সমাবেশের আগে থেকে বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর সরকারের পতন ঘটে যাবে। কিন্তু এর কিছু ঘটেনি। বিএনপির শান্তিপূর্ণ অবস্থান তখন জনসমর্থন লাভ করে এবং সুশীল সমাজ ও রাজনীতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়। তবে সরকারের পতনের মতো পরিস্থিতি এরপরের ১০ মাসেও তৈরি হয়নি।
অবশ্য লাগাতার কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। বড় বড় সমাবেশ করেছে। গত ২৮ জুলাইয়ের সমাবেশকে বিরোধী দলগুলো বলে আসছে ‘ইতিহাস সেরা’। এরপর ২৯ জুলাইয়ের কর্মসূচিতে কিছু উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে এ পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলতে পারেনি বিএনপি। এখন তারা ২৮ তারিখের কর্মসূচিকে বলছে সরকার পতনের মহাযাত্রা। তারা বলছে, এ দিনও এমন সমাবেশ করা হবে যা ইতিহাসে আর হয়নি। তবে ২৮ অক্টোবরেই যে সরকারের পতন হচ্ছে না, তা বিএনপি নেতাদের কথা বা সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন পড়ে বোঝা যায়। তাহলে সকারের পতন হবে কবে?
বিএনপি নেতাদের কোনো মন্তব্য বা বক্তৃতায় এ বিষয়ে কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তারা বলছেন, একের পর এক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে। কথায় কথায় যদিও তারা বলছেন, সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামাবে। কিন্তু তা আসলে বাস্তবে কতটা সম্ভব? কারণ সরকার নিজে পদত্যাগ না করলে তাকে টেনে নামানো কঠিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এমন চিত্র দেখা গেছে। যেখানে সাধারণ জনতা সরকারি ভবন, সংসদ ভবন পর্যন্ত দখল করে ফেলেছে আন্দোলনের এক পর্যায়ে। তারপর সেখানে সরকারের পতন ঘটেছে। অথবা গণআন্দোলনের মুখে বন্দুকের নল ঘুরে গেলে সরকারের পতন ঘটে। তখন পুলিশ, প্রশাসন সরকারের প্রতি অনাস্থা জানায়। তারা সরকারকে আর সহায়তা করবে না বলে জানায়। এভাবেও সরকারের পতন ঘটে।
বিএনপির আন্দোলনে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কিছু ঘটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এর একটি কারণ হলো, সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা। সাধারণ মানুষ বর্তমান সরকারের পতন চাইছে, বিএনপির আন্দোলনেও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু দাবি আদায়ে বিএনপির সঙ্গে রাজপথে নেমে আসছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
এ কারণে ভাবা হচ্ছে, শুধু বিএনপির রাজপথের আন্দোলন সরকার পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট হবে না। অন্যান্য নিয়ামকের ভূমিকাও এখানে প্রয়োজন। যার অনেকটা যুক্তরাষ্ট্র করে রেখেছে। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তারা ভিসা রেস্ট্রিকশন দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরো নিষেধাজ্ঞা আসবে। আওয়ামী লীগ সরকার যত বিরোধ, সংঘাতে জড়াবে তত নিষেধাজ্ঞা আসতে থাকবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা যত চীন-রাশিয়ার দিকে ঘেঁষবেন, ততোই সরকারকে নানা দিক থেকে জড়িয়ে ধরবে যুক্তরাষ্ট্র। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপে নির্বাচনের আগেই সরকার পতনের ঘটনা ঘটবে কি না বলা মুশকিল। যুক্তরাষ্ট্র তার নীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় নিজেদের অবস্থান সুসংহত করবে। সেটা করতে যতদিন সময় লাগে ততোদিন তারা চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তারা তাড়াহুড়ো করতে চাইবে না বলে মনে হচ্ছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের অধীনে আরেকটি নির্বাচন তাদের জন্য ভালো হতে পারে। তখন তারা এ এলাকাকে চীনের বলয় থেকে বের করার ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটাবে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি, গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে বলেই সমস্ত আলামত পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে একবার ভোটের দিনটা পার হয়ে গেলে আওয়ামী লীগ চাইবে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার সব আয়োজন সেরে ফেলতে। তবে এবার তাদের এই আকাঙ্ক্ষা দল ও সরকারকে বড় বিপদে ফেলবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ এই হিসাবটা বুঝতে পারছে এখন।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেই এবার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে খুবই সতর্ক অবস্থায় আছে। এই সুবিধাটি বিএনপি গত দুই নির্বাচনে পায়নি। পশ্চিমা মিডিয়াও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তখন আগ্রহী ছিল না। চীন ও রাশিয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিলেও গত দুই নির্বাচনের প্রধান কুশীলব ভারত এবার অনেকটাই নিরব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা শক্তিগুলো সরকারকে একটি বার্তা দিতে পেরেছে যে, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না করলে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ হয়তো তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাইবে না।
তাছাড়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও সরকারের অনুকূলে নেই। অর্থনীতির সব সূচক বিপজ্জনক পর্যায়ে। এ অবস্থায় উন্নয়ন সহযোগী ও বড় ক্রেতাগোষ্ঠীর মতের বাইরে গিয়ে একতরফা নির্বাচন করা সরকারের জন্য ভাল সিদ্ধান্ত হবে না। এমনকি দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে গিয়ে জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি তৈরি করাও সরকারের জন্য কঠিন হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে পর্যায়ে আছে তাতে সংঘাতমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।
তৃতীয়ত, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিএনপি গত দুই নির্বাচনের চেয়ে এবার অনেক বেশি সফল। তাদের আন্দোলনে সমাজের নিরপেক্ষ অংশগুলো যুক্ত হচ্ছে। বিএনপি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এখন। এ অবস্থায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহসা সফল হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
Discussion about this post