সামনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সংবিধান অনুযায়ী ২০২৪ সালে অবশ্যই এই নির্বাচন করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই এগারোটি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন; ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন; ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন; ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই চারটি নির্বাচন বাদে বাকি ৭টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যদিও ১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ সুক্ষ্ম কারচুপি করে হারানোর অভিযোগ তোলে। একইভাবে ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর দলটির সভাপতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ তোলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্যাস বিক্রি না করায় তাকে নির্বাচনে হারানো হয়েছে। একইভাবে ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) অভিযোগ করে, এই নির্বাচনে সুক্ষ্ম কারচুপি করে তাদেরকে হারানো হয়েছে।
পরাজিত দলের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এসব নির্বাচন দেশের ভেতরে রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে এই চারটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। এই নির্বাচনগুলোতে সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পেরেছে।
এর বাইরে বাকি যে ৭টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনোটাই দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মতো ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই নির্বাচনগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনিয়ম, কারচুপি, ভোট জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। এবং এগুলো প্রতিষ্ঠিত সত্য।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। দলের প্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। নির্বাচনের সময়ে এই দলটির বয়স ছিল মাত্র ৬ মাসের মতো। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একটি অংশ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সাথে মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে গিয়ে ১৯৭২ সালের অক্টোবরে দলটি গঠন করে। এই দলের মূল নেতৃত্বের সবাই ছিলেন এক সময়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা ও শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠজন। এই দলের তাত্ত্বিকগুরু ও প্রধান ব্যক্তি সিরাজুল আলম খান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর; ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশে ফিরে আসেন তখন রাষ্ট্র পরিচলনা ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন সংক্রান্ত বেশ কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবের সাথে সিরাজুল আলম খানের মতের অমিল হয়। শেষ পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগ থেকে তার অনুসারীদের নিয়ে বের হয়ে গিয়ে জাসদ গঠন করেন। তিনি দলটির কোনো পদে ছিলেন না, তবে তিনিই ছিলেন জাসদের মূল রাজনৈতিক ব্যক্তি।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয় তারই এক সময়ের রাজনৈতিক শিষ্যদের সংগঠন জাসদ। দলটির প্রথম সারির নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ নেতৃত্বই ছিল তরুণ; যাদের গড় বয়স ২৫ থেকে ৪০ এর কোঠায়। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যক্তিক্রমও ছিল। এর বাইরে আরো কিছু দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও আওয়ামী লীগের মূল প্রতিযোগিতা হয় জাসদের সাথেই।
জাসদসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনে ভোট কারচুপি, রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগ আনে। শেখ মুজিবুর রহমানের এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার মুজিবনগর সরকারের পোস্টমাস্টার জেনারেল এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর বই ‘বাংলাদেশ: শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল’ বইয়েও প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কারচুপির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অন্তত ১৬টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে জয়লাভের অভিযোগও রয়েছে। এই ১৬টি আসনের অনেকগুলোতেই বিরোধী দলের প্রার্থীদের নমিনেশন জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও বিরোধী দলের প্রার্থীদের গুম করে ফেলার অভিযোগও উঠেছে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে। এছাড়াও ভোটের দিনে কারচুপির অভিযোগও রয়েছে। কয়েকটি আসনের ফল স্থগিত করে কেন্দ্র থেকে (ঢাকা) ফল ঘোষণার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জয়ীয় করা হয়। মওদুদ আহমদ তাই বইয়ে এসব বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
এরপর ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগসহ দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সব দলের সমন্বয়ের বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্য দিয়ে দেশ থেকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতি টানেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’; তাঁর ভাষায় শোষিতের গণতন্ত্র। তিনি মূলত বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক কাঠামো তৈরির জন্যই বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে দাবি করা হয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও মুজিব সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন। এরপর মুশতাককে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরায় চালু করেন। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জিয়াউর রহমান সে সময় তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার দল বিএনপি নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২০৭টি আসন লাভ করে।
একইভাবে ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। তিনি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এই নির্বাচনের আগে এরশাদ জাতীয় পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসন নিয়ে জয় লাভ করে। আগের নির্বাচনের বিজয়ী বিএনপি এই নির্বাচনটি বর্জন করেছিল। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। পরে তারাও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছিল।
চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয় এরশাদের শাসনামলেই। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৫১টি আসনে জয় লাভ করে। আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, জাতীয় আওয়ামী পার্টি (মুজাফ্ফর) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করে।
এরপর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। স্বাধীনতার পর সে বারই প্রথম সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। বাংলাদেশে এ নির্বাচনের মাধ্যমেই একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা উপহার পায়। নির্বাচনে দুটি প্রধান দল- আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা; বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের বিপরীতে ৪২৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ৭৫টি দল থেকে মোট ২৭৮৭ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জয় লাভ করে। তারা ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৪২টি আসন লাভ করে। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন না পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতা নিয়ে সরকার গঠন করে।
দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন ও দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার পথ মসৃণ করতেই সেই সময়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জানায়। এই ব্যবস্থাকে প্রথম প্রশ্নবিদ্ধ করে বিএনপি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করেছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছিল। দলটির সভাপতি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় বলেছিলেন, তিনি ও তার দল আজীবন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে থাকবেন।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল বিএনপির চেয়ারপার্সন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া কেউই নিরপেক্ষ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত ও অসাংবিধানিক সরকার। তাই এই ব্যবস্থার কোনো সুযোগ নেই। তারা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করবেন। কেউ নির্বাচনে না এসে জনগণের জানমালের ক্ষতি করলে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি আমলে না নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তবে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। সে সময় সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল করা হয়।
এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৩০০টি আসনের বিপরীতে ২৮১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ৮১টি দল থেকে মোট ২৫৭৪ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেয়। ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপি সুক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তুললেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের কাছে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়।
একইভাবে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি জয় লাভ করে। তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা দাবি করেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় তাকে নির্বাচনে হারানো হয়েছে। তিনি পরাজয়ের পর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার বলে দাবি করেন। তবে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিক মহল ও দেশের সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচন সুষ্ঠু হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়।
এরপর ২০০৬ সালে এই ইস্যুতে আবারও জটিলতা তৈরি হয়। বিএনপি নিজেদের অনুগত লোক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে আওয়ামী লীগসহ তাদের জোটসঙ্গী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সবশেষ আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সে সময় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক মহলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়।
এই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসনে জয়লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ৩০টি আসনে পায়। এই নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে সুক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তোলা হয়। বাংলাদেশে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনই ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ২০১২ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়। যদিও আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, সরকার চাইলে আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই বিষয়টি আমলে নেয়নি। আদালতের সংক্ষিপ্ত রায় পাওয়ার পরপরই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়।
এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। বিএনপির দাবি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আদালতের রায় ও সংবিধানের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল করেনি। নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন পেয়ে যায়। বিভিন্ন হিসাব মতে মাত্র ৩-৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল এই নির্বাচনে। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হওয়ায় সাধারণ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেনি, এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি।
এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বললেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এক সংলাপের পর তার দেওয়া আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন লাভ করে ‘ভূমিধ্বস বিজয়’ অর্জন করে। বিএনপি মাত্র ৫টি আসন পায়। জোটগতভাবে দলটি ৭টি আসন লাভ করে।
এই নির্বাচনকে বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল ‘রাতের নির্বাচন’ বলে অবহিত করে। বিরোধীদের দাবি ৩০ ডিসেম্বর সকালের আগেই তথা ২৯ ডিসেম্বর রাতেই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যালট ব্ক্স ভরে ফেলে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার ক্যামেরায় নির্বাচনের দিন ভোট শুরু আগেই ব্যালট বক্স ভরে রাখার চিত্রও ধরা পড়ে। চট্টগ্রাম-১০ আসনের শহীদ নগর সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে গিয়ে সকালে ভোট গ্রহণের আগে ব্যালটবাক্স ভরা দেখেন বিবিসি সংবাদদাতা। (সূত্র: বিবিসি বাংলা, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮)
দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান টিআই (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল) এর বাংলাদেশ শাখা টিআইবি তাদের এক জরিপে ৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে আগের রাতে ৩৩টিতে ভোট দেয়ার প্রমাণ পায়। (সূত্র: প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯)
কোনো কোনো কেন্দ্রে শতাভাগ ভোট পড়েছে, কোথাও কোথাও শতভাগের বেশিও ভোট পড়েছে।
এছাড়া ভোটের আগের বিরোধী দলের প্রার্থীদের ধরপাকড়, গ্রেফতার, নিপীড়ন, প্রচারণায় নামতে না দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখানোর ঘটনা ঘটে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সবগুলো শর্তই অনুপস্থিতি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এই নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ছিল না। এই নির্বাচনটিও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
ওপরের আলোচনা থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়।
এক. বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরের ইতিহাসের এখনো পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি।
দুই. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত ৪টি নির্বাচনই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। নির্বাচনগুলো সাধারণ মানুষ, আন্তর্জাতিক মহল ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।
তিন. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রবর্তন হয়েছে স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অংশ নেওয়া দেশের সব রাজনৈদিক দল, সংগঠন ও ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে। বিশেষ কোনো দলের পক্ষ থেকে এই রাজনৈতিক ঐক্যমত্য ভেঙে দলের একক সুবিধা নিশ্চিত করা রাজনৈতিক অসততা।
চার. আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আদালতের রায়ে বাতিল হয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই ব্যবস্থা ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানের চিরনিদ্রায় শায়িত। (সূত্র: সমকাল, ১৯ অক্টোবর ২০২৩) প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তারা এই ব্যবস্থার জন্য ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি কেন করেছিলেন? তাদের দলের সভানেত্রী সে সময় বলেছিলেন, তিনি আজীবন এই ব্যবস্থার পক্ষে থাকবেন। এখন তিনি কেনো থাকছেন না?
পাঁচ. আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় এই ব্যবস্থা সংবিধানে নেই। পাকিস্তান বাদে বিশ্বের কোনো দেশেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নেই। এটি অসাংবিধানিক, অনির্বাচিত সরকার। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই সরকারের বৈধতা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধানের জন্য দেশের মানুষ, না কি মানুষের জন্য সংবিধান? মানুষ সৃষ্ট আধুনিক আইনের শ্রেষ্ঠত্ব তো এখানেই যে, মানুষের প্রয়োজনে ও দেশের জন্য এই আইন প্রয়োজন মতো সংশোধন করা যায়। যা ধর্মীয় বিধান বা ঐশ্বরিক ব্যবস্থার মতো অপরিবর্তনশীল নয়। ফলে দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য সংবিধান সংশোধন করা কোনো অগণাতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক ব্যবস্থা নয়।
ছয়. পাকিস্তান বাদে বিশ্বের কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই যেমন, তেমনি বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আমাদের দেশের মতো রাতে ভোট হয় না। রাতে ভোট হয় যে ব্যবস্থায় সেটা যদি বিশ্বের সব উন্নত দেশের ব্যবস্থার সাথে মিলেও যায় তবুও দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে সেই ব্যবস্থা বাতিল করে যে পদ্ধতিতে রাতে ভোট হবে না সে ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যে মরণযাত্রা শুরু হয়েছে, দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি যে সংকটে পড়েছে সেটা থেকে দেশ ও জনগণকে রক্ষা করা যাবে না। তাই বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে অবশ্যই দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন কাগজে-কলমে স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবে স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের আস্থার চূড়ান্ত ঘাটতি রয়েছে। ২০২২ সালের ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে (কুমিল্লা-৬) নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করার জন্য ইসি থেকে চিঠি দেওয়া হলেও তিনি তা মানেননি। তিনি বলে ছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের চিঠি এখতিয়ার বহির্ভূত।’ (দ্য ডেইলি স্টার, ১৫ জুন ২০২২) এমপি বাহার এলাকা ত্যাগ না করার পর ইসির কাছে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। একটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই ইসির এমন অপারগতা জাতীয় নির্বাচনে সংস্থাটির ওপরে ভরসার মাত্রা শূন্যের কোটায় নিয়ে এসেছে। এছাড়ও ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচনে গোপন কক্ষে ঢুকে অন্যের ভোট দিয়ে দেওয়ার দৃশ্য ভোট কেন্দ্রের ভেতরে থাকা সিসি ক্যামেরায় দেখার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলে ছিলেন, ‘গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনের উপনির্বাচন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আমরা স্বচক্ষে গোপন কক্ষে অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভোট দিতে দেখেছি।’ (সূত্র : ইত্তেফাক, ১২ অক্টোবর ২০২২)
একটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও একটি আসনের উপনির্বাচনে ইসির যে অক্ষমতা, ভোট নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাওয়া, এমন পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে তাদের প্রতি আস্থা রাখা যায় না। যেখানে এক সাথে ৩’শ আসনে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতার পালা বদলের মতো প্রশ্ন জড়িত সেখানে পুরো নির্বাচনই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কা শতভাগ রয়েছে। কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও ইসির ওপরে আস্থার রাখার মতো কোনো নজির আমাদের সামনে নেই। তাই দলীয় সরকারের অধীনে ইসি নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখে নির্বাচন করতে পারবে এমন সম্ভবনা একদমই শূন্যের কোটায়।
Discussion about this post