‘তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। দুই মাস পর, তিনি এখন মৃত।’
বার্তা সংস্থা রয়টর্সের সিনিয়র সাংবাদিক মার্ক ট্রিভেলিয়ান ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন ইস্যুতে একটি লেখা শুরু করেছেন এভাবেই। ট্রিভেলিয়ান রাশিয়া ও কমনওয়েলথ বিষয়ে রয়টর্সের প্রধান লেখক। নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে সাংবাদিকতায় কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।
রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের মৃত্যুর পর পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গিই মূলত তার এই বাক্য দুটোতে ফুটে উঠেছে। মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবাগ যাওয়ার পথে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রিগোঝিনের মৃত্যুর পর কালবিলম্ব না করেই পশ্চিমা গণমাধ্যম, রাজনীতিক, বিশ্লেষকরা এটিকে ভ্লাদিমির পুতিনের ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেষ্টা করছেন। এমনকি খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টও বিষয়টির পেছনে পুতিনের জড়িত থাকা নিয়ে কথা বলেছেন।
পুতিনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, অতীত ইতিহাস ও তার কৌশল বিবেচনা করলে পশ্চিমাদের এই তত্ত্ব উড়িয়ে দেয়া যায় না। বরং এর পক্ষে জোরালো সমর্থনই মেলে। বিশেষ করে দুই মাস আগে ওয়াগনার প্রধানের বিদ্রোহের পর থেকেই পুতিনের সম্ভাব্য ‘প্রতিশোধ’ আলোচনায় ছিলো। এর পক্ষে প্রধান যুক্তি হলো, প্রিগোঝিন পুতিনের বেঁধে দেয়া ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করেছেন এবং পুতিন কখনোই বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করেন না।
কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠেও কিছু রাজনৈতিক সমীকরণ রয়েছে। যেগুলোকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। ওয়াগনার গ্রুপ নিজেদের অবস্থানকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেটি দেশের সীমানার বাইরে রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষায় অনেকভাবে কাজ করছে। রাশিয়া সরাসরি সৈন্য পাঠাতে পারেনি, এমন অনেক দেশে ওয়াগনার ক্রেমলিনের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে। ওয়াগনারের সাথে রাশিয়ার সামরিক, ভূরাজনৈতিক এমনকি অর্থনৈতিক স্বার্থও জড়িত ছিলো। সিরিয়া থেকে লিবিয়ার পর- সুদূর পশ্চিম আফ্রিকা মহাদেশে পুতিনের হয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া দুই মাস আগের বিদ্রোহের ঘটনার পরও প্রিগোঝিনের অবাধে রাশিয়া, বেলারুশ, আফ্রিকায় যাতায়াতের ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, পুতিনের সাথে তার একটি বোঝাপড়া হয়েছে। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেও তিনি এক ভিডিওতে আফ্রিকায় অভিযান জোরদার করার কথা বলেছেন।
প্রিগোঝিন ও ওয়াগনার
ডাকাতির দায়ে জেল খেটে বের হয়ে শুরু করেছিলেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়। এরপর সেন্ট পিটার্সবার্গের মেয়রের মাধ্যমে পরিচয় হয় ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে। পরিচয় থেকে সখ্যতা। নিজের দূরদর্শীতা কাজে লাগিয়ে ক্রেমলিনের সাথে ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ জোরদার করেন ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন। শুরুতে ক্যাটারিং সার্ভিসই ছিলো তার ব্যবসায়। সে হিসেবে ক্রেমলিনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবার সরবরাহের ঠিকাদারি পেতে শুরু করেন। ‘পুতিনের বাবুর্চি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন প্রিগোঝিন। এরপর মিডিয়া ও ইন্টারনেট ব্যবসায় তার আগ্রহ তৈরি হয়। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে তার প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে বলে অভিযোগ আছে।
একপর্যায়ে ওয়াগনার গ্রুপের সাথে জড়িত হন সেন্ট পিটার্সবার্গে জন্ম নেয়া প্রিগোঝিন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল এবং ডোনবাস অঞ্চলে বিদ্রোহী তৎপরতা জোরালো হতে শুরু করলে ওয়াগনার গ্রুপের নামটি সামনে আসে। ডোনবাসের বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহে ক্রেমলিনের হয়ে কাজ করে ওয়াগনার। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা রুশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকতা দিমিত্রি ভালেভিচ উতকিন। তবে এরপর গ্রুপটির কমান্ডার হয়ে ওঠেন প্রিগোঝিন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধে যোগ দেয় ওয়াগনার।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘সামরিক অভিযান’ শুরুর কিছুদিন পর ওয়াগনারের যোদ্ধারা প্রবেশ করে ইউক্রেনে। বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে লড়াই করে আলোচনায় আসে গ্রুপটি। বিশেষ করে বাখমুতে কয়েক মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে শহরটিতে রাশিয়ার পতাকা ওড়ায় ওয়াগনার যোদ্ধারা। এর আগে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সরকারের হয়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে ওয়াগনার। লিবিয়ায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার খলিফা হাফতারের ত্রিপোলি অভিযানেও যুক্ত ছিলো দুই হাজারের বেশি ওয়াগনার যোদ্ধা (লিবিয়ায় ওয়াগনার যোদ্ধাদের খরচ জুগিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত)।
যুগ যুগ ধরে বিশ্বে ভাড়াটে যোদ্ধা ব্যবহারের যে রীতি চলে আসছে সেটিই ছিলো ওয়াগনার গ্রুপের ব্যবসায়ীক নীতির ভিত্তি। নিয়মিত সৈন্যদের প্রাণহানী এড়াতে অনেক দেশ যুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধা ব্যবহার করে। যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টর বা নিরাপত্তা ঠিকাদার। আর যোদ্ধাদের বল হয় মার্সেনারি। ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধার সঠিক সংখ্যা কত তা স্পষ্ট নয়। তবে গ্রুপটিতে ৩০ হাজারের বেশি যোদ্ধা আছে বলে মনে করা হয়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার অনেক জেলখাটা দাগী আসামীকে এই গ্রুপটি রিক্রুট করেছে বলে শোনা যায়।
ওয়াগনারের বিদ্রোহ
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রায় দেড় বছরের মাথায় জুন মাসের ২৩ তারিখে ওয়াগনার প্রধান প্রিগোঝিন বিদ্রোহ করে বসেন পুতিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। যদিও তিনি বলেছেন, তার বিদ্রোহ ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে নয় বরং রাশিয়ার সেনা কমান্ডারদের বিরুদ্ধে। ওই বিদ্রোহের কিছুদিন আগ থেকেই প্রিগোঝিন বিভিন্ন বক্তব্যে রাশিয়ার সেনা কমান্ডারদের প্রতি নিজের অসন্তোষ জানিয়ে আসছিলেন। ওয়াগনার যোদ্ধাদের পর্যান্ত গোলাবারুদ সরবরাহ না করা, যুদ্ধ কৌশল নিয়ে অসন্তুষ্টি এবং সেনা কমান্ডারদের ব্যর্থ হিসেবে আখ্যায়িত করা এক সময় তার রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সশস্ত্র বাহিনী প্রধান তার সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলেন।
এক পর্যায়ে ২৫ হাজার যোদ্ধা নিয়ে প্রিগোঝিন বিদ্রোহ করেন। রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রোস্তভ অন ডন শহরের সেনা কার্যালয় দখল করার পর তিনি বাহিনী নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করেন। যদিও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট ও পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্ততায় ওয়াগনার গ্রুপ ক্ষান্ত দেয় এবং যোদ্ধাদের নিয়ে বেলারুশে চলে যেতে রাজি হয়। ওই বিদ্রোহের পর পুতিন ঘটনাটিকে ‘পেছন থেকে ছুরি মারা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
বিদ্রোহের পর থেকেই পুতিন প্রশাসনের সাথে ওয়াগনার প্রধানের সম্পর্ক ও ওয়াগনার গ্রুপের ভাগ্য নিয়ে ধোঁয়াশা ছিলো। দুই পক্ষের মধ্যে কী সমঝোতা হয়েছে, আদৌ কোন সমঝোতা হয়েছে কিনা- সেটি স্পষ্ট হয়নি। যদিও বিদ্রোহের ৫ দিন পরই প্রিগোঝিনের সাথে পুতিনের বৈঠক হয়েছে বলে জানা যায়। তবে সেই বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তা প্রকাশ্যে আসেনি। ওয়াগনার যোদ্ধাদেরও আর ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে দেখা যায়নি। বেলারুশের একটি সামরিক ঘঁটিতে তাদের জড়ো হওয়ার খবর পাওয়া যায়। রাশিয়ায় প্রিগোঝিনের কার্যালয়ে তল্লাশির খবরও পাওয়া যায়। এসব কারণে অনেকে সেখানেই ওয়াগনার ও প্রিগোঝিনের শেষ দেখে ফেলেছিলেন। যদিও তার অবাধে দেশে ও দেশের বাইরে চলা ফেরা বিপরীত মতটাকেও জাগিয়ে রেখেছিলো।
পুতিনের কর্তৃত্ববাদ ও ‘প্রতিশোধ’ তত্ত্ব
বিদ্রোহের ঘটনার পর থেকেই প্রিগোঝিনের ভাগ্যে কী আছে- সেটা নিয়ে অনেকে অনুমান করতে থাকেন। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে বেশ আগ্রহ নিয়ে পুতিনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অতীতে তার বিরোধীদের সাথে কী ঘটেছে সেসব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই ভ্লাদিমির পুতিন কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রবলভাবে ভিন্নমত দমন চলতে থাকে তার দেশে। সর্বশেষ বিরোধী রাজনীতিক অ্যালেক্সি নাভালনির পরিণতির কথা কারো অজানা নয়। নাভালননিকে ২০২০ সালে নভিচক নার্ভ এজেন্ট দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া নাভালানি এর জন্য পুতিনকে দায়ী করেন। জার্মানিতে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরার পর তাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়। বর্তমানে মস্কোর হাই সিকিউরিটি প্রিজনে ১৯ বছরের শাস্তি ভোগ করছেন তিনি। উগ্রবাদী তৎপরতাসহ অনেকগুলো অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে, যদিও নাভালনি এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মুক্ত অবস্থায়ও নাভালনিকে অনেক নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে। পুতিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার কারণে একাধিকবার গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে মস্কোর মেয়র নির্বাচন ও ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়।
পুতিনের বিরুদ্ধে ভিন্নমত দমনের অভিযোগ তার শাসন ক্ষমতার শুরু থেকেই। এক সময় রাশিয়ার রাজনীতি ও প্রশাসনে অলিগার্ক বা ধনকুবেরদের বেশ দাপট ছিলো; কিন্তু পুতিন খুব কৌশলে তাদের ক্ষমতার বৃত্ত থেকে বের করে দেন। সব ক্ষমতা ক্রেমলিনে কেন্দ্রিভূত করেন। এক্ষেত্রে তার প্রথম ‘শিকার’ ছিলেন মিডিয়া মুঘল ভ্লাদিমির গুসিনস্কি। এই ধনকুবের ছিলেন রাশিয়ার এনটিভি চ্যানেলের মালিক। চ্যানেলটি ওই সময় পুতিনের চেচনিয়া যুদ্ধের কড়া সমালোচনা করতে থাকে। ক্রেমলিন এনটিভির সম্পাদকীয় নীতিতে প্রভাব খাটাতে চাইলে তা মানতে চাননি গুসিনস্কি। এর কিছুদিন পরই তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা হয় এবং গুসিনস্কি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
একই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে তেল কোম্পানি ইউকোসের প্রধানকে- যিনি পুতিন ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন। প্রতারণা ও ট্যাক্স ফাঁকির মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে জেতে হয় তাকে। এভাবে রাশিয়ায় ভিন্নমতের অনেকেই পুতিনের আক্রোশের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। মিডিয়া কর্মী, রাজনীতিক, মানবাধিকার কর্মী, ব্যবসায়ী- সব সেক্টরের লোকের নাম আছে এই তালিকায়। ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের মৃত্যুও এরই ধারাবাহিকতা কি না সেই প্রশ্ন তাই ওঠা অযৌক্তিক নয়।
প্রিগোঝিনের মৃত্যুতে পুতিনের লাভ-ক্ষতি
ওয়ানগার প্রধানের মৃত্যুর পর পশ্চিমা দুনিয়া কোনো বিলম্ব না করেই ‘ষড়যন্ত্র ও প্রতিশোধ’ তত্ত্ব হাজির করেছে। কেউ বলছেন, রুশ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সারফেস টু এয়ার মিসাইল দিয়ে বিমানটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, বিমানের ভেতরে বোমার বিস্ফোরণ ঘটনানো হয়েছে। কীভাবে ঘটেছে সেটা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও ঘটনার জন্য পুতিনকে দায়ী করার ব্যাপারে তারা সবাই একমত।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এই ঘটনাকে রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির কাজ বলে সন্দেহ করছে। বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি ফ্রাঙ্ক গার্ডনারকে ব্রিটিশ মিলিটারি সূত্র বলেছে, এফএসবি যদি এই কাজের নেপথ্যে থাকে, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য হতে পারে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরসিমভের প্রভাব অটুট রাখা এবং আপাতত তাদের সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।
খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও যোগ দিয়েছেন এই দলে। তিনি বলেছেন, দুর্ঘটনায় প্রিগোঝিনের মৃত্যুতে আমি অবাক হইনি। বাইডেনের মতে, রাশিয়ায় এমন ঘটনা কমই ঘটে যার পেছনে পুতিনের হাত নেই।
বড় কোন ঘটনায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দ্রুততার সাথে এমন দোষারোপমূলক মন্তব্য সহসা দেখা যায় না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘বিদ্রোহের দুই মাস পর ওয়াগনার কমান্ডারের মৃত্যুর মাধ্যমে পুতিনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার এলিট সমাজের প্রতি ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। বার্তাটি হলো, ‘সতর্ক থাকুন, আনুগত্য না করার শাস্তি মৃত্যু।’
এসব অভিযোগের পক্ষে একটাই যুক্তি- পুতিন তার বিরোধীদের সহ্য করেন না, বিশেষ করে বিশ্বাসঘাতকদের কখনো ক্ষমা করেন না।
কিন্তু ওয়াগনার প্রধানের মৃত্যুতে পুতিনের কতটা লাভ-ক্ষতি হতে পারে সেটি বিবেচনা করলে আরো অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। কারণ ওয়াগনার ছিলো রাশিয়ার প্রক্সি মিলিটারি ফোর্স। যেখানে সরাসরি রাশিয়া সেনাবাহিনী পাঠাতে পারে না, সেখানে ওয়াগনার কাজ করে। এবং তারা যে ক্রেমলিনের নীতির প্রতি আনুগত্যশীল ছিলো সেটা নিয়েও তর্ক করার সুযোগ কম। তাই পিগোঝিনের মৃত্যু যদি ওয়াগনার গ্রুপের সমাপ্তি ডেকে আনে তাহলে ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণ বেশি হবে।
আাফ্রিকার দেশ মালি ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে ওয়াগনারের রয়েছে বড় ধরনের উপস্থিতি। দুটি দেশেই সরকারের হয়ে বিদ্রোহীদের বিপক্ষে লড়াই করছে গ্রুপটি। ওয়াগনারের মাধ্যমেই দেশ দুটির স্বর্ণ ও হীরার খনির ওপর রাশিয়া প্রভাব বিস্তার করছে। নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে দেশগুলো থেকে স্বর্ণ ও হীরা রফতানির কাজও চলতো ওয়াগনারের মাধ্যমে। পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবেলায় পশ্চিম আফ্রিকায় ওয়াগনারই রাশিয়ার অবস্থানকে ধরে রেখেছে। সর্বশেষ নাইজারের বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তারাও ওয়াগনারের সহযোগিতা চেয়েছেন। নাইজারে অভ্যুত্থানকারীরা ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রুজ্ঞান করে। অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে রাশিয়ার পক্ষে স্লোগান দিতেও দেখা গেছে জনতাকে। তাই সেখানে ওয়াগনার মানেই যে রাশিয়া সেটি কারো অজানা নয়। এর আগে সিরিয়া ও লিবিয়াতেও পুতিনের স্বার্থ রক্ষা করেছে ওয়াগনার যোদ্ধারা। সুদানে গত দুই মাস ধরে চলা সংঘাতে আধাসামরিক বাহিনী আরএসএফকে ওয়াগনার অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে বলে জানা যায়।
কিন্তু প্রিগোঝিনের মৃত্যুতে ওয়াগনার ভেঙে গেলে রাশিয়াকে এই ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ে অনেকখানি পিছিয়ে পড়তে হবে। কারণ বিধ্বস্ত হওয়া বিমানে প্রিগোঝিন ছাড়াও ওয়াগনারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন ছিলেন।
লন্ডন-ভিত্তিক আরইউএসআই থিংক ট্যাংকের গবেষক ও ‘আফ্রিকায় রাশিয়া’ বইয়ের লেখক স্যামুয়েল রামানি মনে করেন, প্রিগোঝিনের মৃত্যুতে আফ্রিকা জুড়ে পুতিনের বিশাল নেটওয়ার্ক ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে। পুতিনের জন্য বিষয়টিকে দীর্ঘমেয়াদে কৌশলগত লোকসান হিসেবেও আখ্যায়িত করেন তিনি। কারণ আফ্রিকায় ওয়াগনার গ্রুপের উপস্থিতি যেমন আছে, তেমনি প্রিগোঝিনের ব্যক্তিগত একটি সম্পর্কের নেটওয়ার্ক রয়েছ পুরো আফ্রিকা জুড়ে। যে নেটওয়ার্ক পুতিনের জন্য প্রক্সি নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করতো।
কাজেই পুতিন নিজেই নিজের এই ক্ষতি ডেকে এনেছেন কি না সেটি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার সুযোগ রয়েছে।
ওয়াগনারের কী এখানেই শেষ
পিগোঝিনের মৃত্যুর পর ওয়াগনার গ্রুপের কর্মকাণ্ড এখানেই শেষ হয়ে যাবে কি না সেই প্রশ্ন উঠছে চারপাশ থেকে। প্রিগোঝিনের সাথে ওয়ানগারের প্রতিষ্ঠাতা উতকিনসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি মারা যাওয়ায় গ্রুপটি এখন নেতৃত্বশূন্য বলা যায়। অনেকে বলছেন, ওয়াগনারের যে বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গ্রুপটির দ্বিতীয় স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে লড়াই শুরু হতে পারে। আবার গ্রুপটিকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অধীনে আনা হতে পারে- এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ ক্রেমলিনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে ওয়াগনার।
ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের স্কুল অব ল’র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর উইলিয়াম পারলেট এবিসি নিউজ অস্ট্রেলিয়াকে বলছেন, ওয়ানগারকে এখন রেডুত নামের বেসরকারি সামরিক কোম্পানির সাথে একীভূত করা হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রুপটি চাইছে ওয়াগনার যোদ্ধাদের দলে ভেড়াতে এবং আফ্রিকাসহ বিভিন্ন স্থানে ওয়াগনারের কার্যক্রম নিজেদের হাতে তুলে নিতে।
উইলিয়াম পারলেট বলেন, রাশিয়ার সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে যে ধরনের আলোচনা দেখছি এবং আমার ইন্দ্রিয় বলছে, ওয়াগনার এখানেই শেষ। গ্রুপটির পুরো নেতৃত্বই শেষ হয়ে গেছে।
প্রশ্ন আসতে পারে- পুতিন কি তাহলে ওয়াগনারের সমাপ্তি ঘটিয়ে একই ধরনের আরেক প্রতিষ্ঠান রেডুতের মাধ্যমে আফ্রিকাসহ বিভিন্ন স্থানে রাশিয়ার প্রভাব ধরে রাখতে চাইছেন? এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত পাওয়ার সুযোগ নেই। সামনের মাসগুলোতে ওয়াগনার ও তাদের বিশাল সাম্রাজ্য কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সেটা দেখেই পাওয়া যাবে এর উত্তর।
Discussion about this post