নিঃসন্দেহে পিনাকী ভট্টাচার্য এ সময়ের একজন আলোচিত বুদ্ধিজীবী। তবে তাকে শুধু আলোচিত বললে কম বলা হবে। তিনি ‘ইফেকটিভ’ বু্দ্ধিজীবী। তার সমসাময়িক এত পরিচিত ও প্রতিক্রিয়া তৈরিতে সক্ষম বুদ্ধিজীবী আর নেই বললেই চলে। দেশে থাকা অবস্থায়ও তিনি রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিলেন। তখনও নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিলেন। তাকে কেন্দ্র করে তরুণদের জটলা সব সময় ছিল। এখন পিনাকী ভট্টাচার্য ফ্রান্সে বাস করছেন। ফ্রান্সে তিনি সাধ করে যাননি। চলমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের রোষানলে পড়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল।
পিনাকী ভট্টাচার্য দেশ ছেড়ে গেলেও নিজ জন্মভূমির রাজনীতি, শাসন ব্যবস্থা, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বগ্ন থাকেন। বিভিন্ন বিশ্লেষণ, পরামর্শ, দিকনির্দেশনা দিয়ে ভিডিও তৈরি করেন। বলা বাহুল্য তার ভিডিওর প্রতিক্রিয়া ব্যাপক, এককভাবে তার ধারে-কাছে আর কেউ নেই। মিলিয়ন ভিউ কোনো বিষয়ই না। তিনি চেষ্টা করেন যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত, যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে; পদ্ধতিগতভাবে নিজের বিশ্লেষণ হাজির করতে।
গত বুধবার (২৩ আগস্ট,২০২৩) তিনি একটি ভিডিও তার ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়েছেন, যার বিষয় ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় রাখতে ভারতের দেনদরবার সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ও বিএনপির প্রতিক্রিয়া।
গত ১৮ আগস্ট ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইনে ‘হাসিনাকে দুর্বল করলে ক্ষতি সবার, বার্তা আমেরিকাকে’ শিরোনামে একটি না মন্তব্য প্রতিবেদন, না সংবাদ প্রকাশিত হয়। কোনো ধরনের সূত্র, মন্তব্য, দিন-তারিখের উল্লেখ ছাড়াই লেখাটি প্রকাশ হয়। যে কারণে একে সংবাদ বলার সুযোগ নেই। আবার এটি মন্তব্য প্রতিবেদনের মতো করেও লেখা নয়। এর লেখক অগ্নি রায়।
তবে লেখাটি প্রকাশের পর থেকে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক অংশ ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানায়। আওয়ামী লীগপন্থীরা লেখাটি শেয়ার করতে থাকেন খুশির সঙ্গে। যারা বর্তমান সরকারের পদত্যাগ চান তারা কেউ উপহাস, কেউ উদ্বেগের সঙ্গে নিজেদের মতামত জানান।
তবে ধীরে ধীরে এর গুরুত্ব বাড়তে থাকে যখন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে লেখাটি প্রকাশ হতে থাকে। প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই লেখাটি প্রকাশ করে যার যার মতো করে। এর আগেও বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দেনদরবার সংক্রান্ত নানা খবর প্রকাশ হলেও এতটা প্রতিক্রিয়া বোধহয় আর তৈরি হয়নি।
তবে অগ্নি রায়ের লেখাটি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায় যখন ডয়চে ভেলে’র বাংলা ভার্সনে এটি প্রায় হুবহু প্রকাশ করা হয়। একই তারিখে, তবে কয়েক ঘণ্টা পরে প্রকাশিত ডয়চে ভেলে’র শিরোনাম ছিল ‘হাসিনার পক্ষ নিয়ে অ্যামেরিকাকে বার্তা ভারতের’। এর লেখক স্যমন্তক ঘোষ, নামের পাশে লেখা নতুন দিল্লি।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মন্তব্য ডয়চে ভেলে’র প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই ছিল। যা পিনাকী ভট্টাচার্য উপক্ষো করেছেন অথবা জানতেনই না।
পিনাকী তার ভিডিওতে অগ্নি রায়ের পরিচয় নিয়ে অনেক সময় ব্যয় করেছেন। তিনি যেন মির্জা ফখরুলকে পড়াতে চাইছেন অগ্নি রায় সম্পর্কে। তবে রাজনীতিতে অগ্নি রায় লিখলেন নাকি বেগুন রায় লিখলেন তা খুব একটা তারতম্য তৈরি করে না। পিনাকী ভট্টাচার্যের রাজনীতি যেহেতু তথ্য নির্ভর, ফলে তিনি মাঠের উত্তাপ বা বাস্তব পরিস্থিতির আঁচ করতে পারেন না।
অগ্নি রায় সম্পর্কে মির্জা ফখরুলের জানা-বোঝা যা-ই থাকুক বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর জবাব ওনাকে দিতেই হতো।
পিনাকী হয়তো আলোচিত লেখার কিছুদিন আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপির শোক জানানোর ঘটনা ভুলে গেছেন। বিএনপির শোকবার্তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে আনন্দবাজার ওই লেখা ছেপেছে কি না তা নিয়েও কিন্তু আলোচনা আছে।
পিনাকী মির্জা ফখরুলকে দিয়ে যা বলাতে চেয়েছেন তার ভিডিওর মাধ্যমে, সেটা বিএনপি মহাসচিব কিন্তু বলেছেনও। ১৯ আগস্ট প্রকাশিত প্রথম আলোর সংবাদেই সেটা আছে। ফখরুল সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা পত্রিকায় দেখলাম আজকে ডয়েচে ভেলের বরাত দিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট করা হয়েছে…এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি ভারত কোনো পদক্ষেপ নেয়, সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা মনে করি, সেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য এবং এই অঞ্চলের মানুষের জন্য শুভ হবে না।’
তিনি বলেন, আজকে বাংলাদেশে যে সংকট, সেই সংকটের মূলে হচ্ছে এই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের মানুষের ওপরে যে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে রাষ্ট্রকে দিয়ে, বলা যেতে পারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস গড়ে তুলে ‘টোটালি একটা ডিপ স্টেট’ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ যারা গণতন্ত্রের কথা বলে সব সময়, তাদের কাছে এটা অপ্রত্যাশিত; যদি এই নিউজ সত্যি হয়ে থাকে।
তবে মির্জা ফখরুল এমন আশাও ব্যক্ত করেছেন যে বাংলাদেশের মানুষের যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষাকে ভারত মর্যাদা দেবে। এই দেশে সত্যিকার অর্থেই সব দলের অংশগ্রহণে, সবার সদিচ্ছায় একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের ব্যাপারে তারা পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করবে।
এর সবই বাদ দিয়ে পিনাকী মূলত ফোকাস করেছেন মির্জা ফখরুলের আরেকটি বক্তব্যকে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা এ কথা খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, কোনো মৌলবাদী দল এখানে ক্ষমতায় আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ দেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে, কখনোই কোনো মৌলবাদী দল ক্ষমতায় আসতে পারেনি। বরং তাদের যে শক্তি, সেই শক্তি ক্ষীয়মাণ হয়ে এসেছে।’
পিনাকীর ভিডিও প্রকাশের আগের দিন (২২ আগস্ট) আরেক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আপনারা দেখেছেন কিছুদিন আগে.. একটা পাড়া থেকে একটা গহীন জঙ্গলের কথা বলে নিরীহ সাধারণ মানুষজনকে জঙ্গি বলে তুলে নিয়ে আসলো। এটার প্রয়োজন আছে তাদের। কারণ, তারা দেখাতে চায় যে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আছে। জঙ্গি আছে, এটাকে দমন করবার জন্য শুধু তাদেরকেই দরকার। এটাই হচ্ছে তাদের মূল উদ্দেশ্যে। এবং সেটা দেখাতে চায় পশ্চিমা বিশ্বকে, ভারতকে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা তো জানি যে জঙ্গি আওয়ামী লীগ, জঙ্গি এই সরকার। তারা সাধারণ মানুষের ওপরে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ চাপিয়ে দিয়ে হত্যা করছে, ধবংস করছে, তাদের সব অধিকারগুলো কেড়ে নিচ্ছে।’ [সূত্র: বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম]
মির্জা ফখরুলের এসব বক্তব্যে ধারাবাহিকতা আছে। যেকোনো রাজনীতি বোঝা ব্যক্তির কাছে মির্জা ফখরুলের রাজনীতি পরিষ্কার মনে হবে। তিনি জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, ভারত ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন। মৌলবাদ এবং জঙ্গিবাদকে আলাদা করেছেন।
যদিও পিনাকীর ভাষ্য আফগানিস্তান যুদ্ধের মাধ্যমে সেক্যুলাররা ‘মৌলবাদ’ শব্দটি এনডোর্স করেছে। পিনাকীর কথা অনেকটা আবদারের মতো শোনায় যে, সেক্যুলাররা বলেছেন বলেই ‘মৌলবাদের’ পক্ষ নিয়ে থাকতে হবে বিএনপি বা সরকারবিরোধীদের। পিনাকী গুগলে খুঁজে অগ্নি রায়কে আবিষ্কারের কৃতিত্ব হিসেবে বিএনপির রাজনীতিকে মোটিভেট করতে চান। যা আদতে ভুল পথ।
তার ‘গুগল সার্চ’ বা তথ্য সন্নিবেশকারী দলকে আরো চৌকস ও রাজনৈতিক হতে হবে। তাতে পিনাকীরও উপকার, জাতিরও উপকার। কারণ পিনাকী অনেক সময় অর্ধেক তথ্য হাতে নিয়ে বড় সিদ্ধান্তে চলে আসেন।
‘মৌলবাদ’ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরই এক সমস্যার নাম। ‘মৌলবাদ’ মানেই এখানে কখনো ইসলাম বা মুসলমান ছিল না। সেক্যুলাররা মৌলবাদকে আবশ্যিকভাবে ইসলাম বা মুসলমানের বিষয় হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। পিনাকীও তা-ই চাচ্ছেন। মৌলবাদ কারো আচরণে, স্বভাবে বা সংস্কৃতিতে থাকতে পারে। একজন সেক্যুলারও মৌলবাদী হতে পারেন, একজন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিও মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা নিয়ে থাকতে পারেন। তবে রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিকভাবে কোনো মৌলবাদেরই বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসা গ্রহণযোগ্য হবে না।
বাংলাদেশে এমন কোনো ইসলামি রাজনৈতিক দল নেই যারা নিজেদের মৌলবাদী বলে দাবি করে। মির্জা ফখরুলও বলেন নাই, অমুক-তমুক দল মৌলবাদী। কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদ আছে, জামায়াতেরও মৌলবাদী স্বভাব আছে। এসব বয়ান ভারতীয় বা শাহবাগের সেক্যুলারদের হলেও নিরপেক্ষভাবে সত্য। হেফাজতে ইসলামের যেসব দাবি তাতেও মৌলবাদ বিদ্যমান। তবে মৌলবাদ মানেই তাকে দমন করতে হবে তা না। শাহবাগের সঙ্গে গণতন্ত্রকামীদের বিরোধ ছিল এখানে। পিনাকী ভট্টাচার্য যা বলতে চেয়েছেন তা শাহবাগেরই অল্টার বয়ান। ভারতের হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে এখানে ইসলামপন্থীদের উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে। সে জন্য তাকে মৌলবাদী বলা যাবে না। অর্থাৎ কিছুই বলা যাবে না।
বাস্তবতা হলো, ভারতের হিন্দুত্ববাদ বিরোধিতার বিপরীতে এখানে যেন আবার (ইসলামি) মৌলবাদ প্রতিষ্ঠা না পায় তা অবশ্যই আমলে রাখতে হবে। রাজনীতিতে সেটা পরিষ্কার করে বলতেও হবে। কারণ কর্তৃত্ববাদী সরকারকে হঠাতে, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে এক হতে হবে-এটাই বিএনপির রাজনীতি এখন। ফলে সব পক্ষকে তার বার্তা দিতে হবে খোলামেলাভাবে। মির্জা ফখরুল সেটাই করেছেন।
Discussion about this post