গত ৬ ডিসেম্বর ছিল স্বৈরাচার পতন দিবস। ১৯৯০ সালের এ দিনে গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়। তার পরম্পরায় ভোটের অধিকার ফিরে পায় জনগণ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো ৩৩ বছর পর আবারো আজ আমরা আরেক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়ছি। আজো আমরা ভোটের অধিকারের জন্য লড়ছি। আজো এই রাষ্ট্রে আমাদের জান-জবান-সম্মানের অধিকার নাই।
কেনো এমন হলো? আর কতো স্বৈরাচারের পতন আমাদের ঘটাতে হবে? মুক্তির উপায় কী?
এরশাদ পতন আন্দোলনে সবচেয়ে উচ্চারিত একটি স্লোগান ছিল-
এক দফা, এক দাবী
এরশাদ /স্বৈরাচার তুই কবে যাবি।
ভাবা হচ্ছিল, এরশাদ গেলেই বুঝি মানুষের মুক্তি নিশ্চিত। তিন জোটের যে রূপরেখার ভিত্তিতে সে আন্দোলন একটা পরিণতি লাভ করে, সেখানে মূলত এরশাদের পতন, পতন-পরবর্তী সরকার ও নির্বাচন কেমন হবে, সেসবই প্রাধান্য পায়। সে রূপরেখার ৪টি ধারার মধ্যে ৩টিই ছিল সে সম্পর্কিত। কিন্তু যে ব্যবস্থায়, আইন-কানুনের সুযোগে এখানে সরকারগুলো জনগণের ওপর জুলুম করে, লুটপাট করে, জনগণের সম্পদ পাচার করে এবং এসব করার জন্য স্বৈরাচার হয়ে উঠে, সে স্বৈরতন্ত্রের অপসারণের বিষয়ে খুব স্পষ্ট কোনো দাবি বা পরিকল্পনা সে রূপরেখায় ছিল অনুপস্থিত। ৪র্থ ধারায় জনগণের সার্বভৌমত্ব, মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন এসব কথা বলতে হবে তাই বলা হয়। যার প্রতিফলন হলো, ৯০-এর পর তিন জোটের প্রায় প্রতিটি দলই একাধিকবার ক্ষমতায় গেলেও বা ক্ষমতার অংশ হলেও কোনো জোট বা দল সেসব নিয়ে সিরিয়াস কোনো পদক্ষেপ নেয় নাই, নিতে বাধ্য হয় নাই।
এরশাদই এ দেশে প্রথম স্বৈরাচার ছিলেন না। বলা বাহুল্য শেষ স্বৈরাচারও তিনি নন। আগেও বিভিন্ন সময় আমরা এদেশে – এভূখণ্ডে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। পাকিস্তান আমলে ইয়াহিয়াকে বলা হতো সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার। তার পতনও মূলত এ ভূখণ্ডের লোকেরা আন্দোলন সংগ্রাম করে, জীবন দিয়ে করেছে। এর পরম্পরায় পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় এবং আমরা অকাতরে জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি।
স্বাধীন দেশে তৎকালীন অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় গণপরিষদকে অকার্যকর করে দেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে সংবিধান কার্যকরের আগে প্রস্তাবিত সংবিধানের ওপর গণভোটের যে সাধারণ ও সার্বজনীন একটি রীতি, তাও মানা হয় নাই। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তাই জনগণের অধিকারের রক্ষাকবচ না হয়ে, হয়ে উঠে শাসকের শোষণের একটি মোক্ষম, অব্যর্থ হাতিয়ার। মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে দুই দুই বার স্বাধীনতা অর্জন করেও ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এদেশের জনগণ আবারো বৃটিশ ও পাকিস্তান উপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোর প্রজা হতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্রের মালিকানা আবারো হারায় তারা। হারায় তার জান, জবান, সম্মানের অধিকার; তার গণতান্ত্রিক অধিকার। বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একটা ইন্টারভিউতে স্বীকার করেছিলেন, ব্রিটিশ উপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলে করা ৩৬৯টি আইন এখনো বাংলাদেশে চালু আছে।
এ ভূখণ্ডে প্রথম আইন বানিয়েছিল বৃটিশরা, এদেশের মানুষকে জিম্মি করে শোষণ করতে এবং শোষণকৃত সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করতে। লুট শব্দটা ইংরেজি ডিকশেনারিতে ঢুকেছিল ভারতবর্ষে বৃটিশদের অবিশ্বাস্য লুটপাট থেকেই। আজো আমাদের পুলিশ আইন ১৮৬১ সালের, জেলকোড ১৮৬৪ সালের বৃটিশদের তৈরি। এখানে উল্লেখ্য ১৮৬১ সালে এখানে যে পুলিশ আইন হয়, তা ছিল সে সময়ে লন্ডন পুলিশ আইনের চেয়ে ভিন্ন। কারণটাও স্পষ্ট, এখানকার পুলিশ আইনটি ছিল বৃটিশদের লুটপাট এবং পাচারে যিনি বাধা হয়ে উঠতে পারেন, তাকে ঠেঙ্গানোর জন্য। আর লন্ডনের আইনটি ছিল সেখানকার নাগরিকদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য। বৃটিশ বিদায়ের পর পাকিস্তান সরকার সেই আইন বহাল রাখে, যেহেতু তাদেরও লক্ষ্য উদ্দেশ্য একই ছিল- এখানকার সম্পদ লাহোরে পাচার নির্বিঘ্ন করা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানেও সেই বৃটিশ উপনিবেশিক আইনকে কেবল বৈধতাই দেওয়া হয় নাই, সাথে অবিকলরূপে বহাল রাখা হয়। কেন? এদেশের মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ বিভিন্ন দেশে অবারিত পাচার করে বেগম পাড়া তৈরির অফুরন্ত সুযোগ নিশ্চিত রাখতে?
একদমই তাই।
এদেশের রাষ্ট্র কাঠামো, আইন-কানুন ক্ষমতাসীনদের অফুরন্ত লুটপাট ও পাচারের অবারিত সুযোগ নিশ্চিত করে। এবং এখানে যারা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তারা থাকেন আইনের উর্দ্ধে। এমনকি আইনের ব্যাখ্যা, প্রয়োগ তাদের সুবিধায় পরিবর্তিত হয়ে যায়, কিন্তু তারা আইন মানতে বাধ্য থাকেন না। ফলাফল একসময় সরকার হয়ে উঠেন স্বৈরাচার। তা যদি তিনি ভোটে নির্বাচিত কোন জনপ্রতিনিধিও হোন। আর যদি সরকার হয় বিনা ভোটের বা রাতের ভোটের, তাহলে তো কথাই নাই। স্বৈরাচার তখন এমনকি ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে।
এবং এই লুটপাট ও পাচারের অবারিত সুযোগ ধরে রাখতে এবং নিজেদের আইনের উর্দ্ধে রাখতে তারা যেকোন মূল্যে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখে। তার জন্য জনগণের যত রক্তই ঝরাতে হোক, যত নিপীড়নই করতে হোক না কেন। এখন যেমন আমরা দেখছি।
এদেশে তাই কোনো গণতন্ত্র নাই। আছে স্বৈরতন্ত্র। এ রাষ্ট্র কাঠামো, এখানকার আইন-কানুন, ব্যবস্থা স্বৈরাচার তৈরির একটি কারখানা মাত্র।
৩৩ বছর পর আজ আবার তাই আমাদের আরেক স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। আশার কথা হলো, এবার আমরা কেবল স্বৈরাচার পতন নয়, একই সংগে স্বৈরতন্ত্রের পতনের লক্ষ্যে লড়ছি। আজকের একদফা কেবল সরকার পতন নয়, বরং একই সঙ্গে সরকার এবং শাসন ব্যবস্থা বদলের দাবি। সাথে ভরসা হিসেবে আছে ৩১ দফার রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব। ৬ দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ এবং বিএনপি অল্প কয়েকটি ধারায় মতানৈক্য সহ নিজ নিজ ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব জাতির সামনে তুলে ধরেছে। অন্যান্য দল ও জোটগুলোও রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে নিজ নিজ দলীয় প্রস্তাব জাতির সামনে হাজির করেছে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
কথা হলো, শেষ রক্ষা হবে কী? এ আন্দোলন সফল হবে কী? স্বৈরাচার সরকার এবং স্বৈরতন্ত্রের পতন কী এবার আসলেই সম্ভব হবে?
গত ২৯ অক্টোবরে পৃথিবীর ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল প্রমাণ করেছে এই আন্দোলনের ন্যায্যতা ও এর পক্ষের জনমত। তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ নভেম্বরে সরকারের একেবারে যুদ্ধ সাজে তফসিল ঘোষণা প্রমাণ করেছে তাদের ভীতি, দুর্বলতা।
শত প্রলোভন, ভীতি, জুলুম, নিপীড়নের পরও ওবায়দুল কাদের সাহেবের প্রতিশ্রুত শত ফুল যে ফোটে নাই, দুই একটি দুর্গন্ধযুক্ত বাসী ফুল ছাড়া, এটা এই আন্দোলনের একটা বড় বিজয়। ব্যর্থ মনোরথ শেখ হাসিনা ডামি প্রার্থী দিয়ে ডামি নির্বাচন করার কৌশল গ্রহণ করেছেন, যা এরই মধ্যে জনগণ ধরে ফেলেছেন এবং প্রত্যাখ্যান করেছেন। সামাজিক মাধ্যম এবং চায়ের দোকানের আড্ডায় কান পাতলেই সেই রায় শোনা যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি প্রায় সকল পরিবেশ – পরিস্থিতি আন্দোলনের পক্ষে আছে। দরকার কেবল রাজপথের শক্ত প্রতিরোধ।
গুলি, গ্রেফতার, হামলা-মামলা, লোভ-লালসা অতিক্রম করে জনগণ যখন রাজপথের দখল নেবে, এই স্বৈরাচার সরকারের পতন সাথে সাথেই হবে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই সরকারের পতন হলেই কি স্বৈরতন্ত্রেরও পতন হবে?
উত্তর হলো, না। সরকার পতন প্রথম ধাপ। এটা ছাড়া স্বৈরতন্ত্রের পতন সম্ভব নয়। তাই এটা লাগবেই। এরপর আমাদের কাজ হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা। সেই সরকারের অধীনে রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গণপরিষদ (সংবিধান সংস্কার সভার) নির্বাচন করা। যেমনটা আমাদের দেশে ৪৬ ও ৭০ সালে হয়েছিল।
গণপরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত ৩০০ সদস্য আন্দোলনে বিজয়ী সকল দলের সাথে আলাপ করে সংবিধান সংস্কারের একটি খসড়া বানাবেন। এরপর সারাদেশে বিভিন্ন সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপের মাধ্যমে তারা সেই সংস্কার প্রস্তাব পোক্ত করবেন। সর্বশেষ তারা একটি গণভোটের আয়োজন করবেন। গণভোটে পাশ হলে সেই পাশকৃত, সংশোধিত সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে তারা নতুন সরকার গঠন করবেন। এ পুরো কাজে ৩ মাস থেকে বড়জোর এক বছর সময় লাগতে পারে। এসময় রাষ্ট্র পরিচালনা করবে অন্তর্বর্তীকালীন সেই সরকার।
এবার আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, স্বৈরতন্ত্রের পতনে গণপরিষদ কেন লাগবেই?
লাগবেই দুই কারণে। এক. এদেশে ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাট ও পাচারের অবারিত সুযোগ পেয়েও কেউ নিজের ক্ষমতা কমাবে, এটা কখনো হয় নাই; হবে বলেও কেউ বিশ্বাস করে না। কাজেই সংস্কার চাইলে তা করতে হবে নির্বাচিতদের ক্ষমতা প্র্যাকটিস করতে পারার আগে। সেটাই গণপরিষদ। দুই. গণভোটের মাধ্যমে কোনো সংস্কার সম্পন্ন হলে ৫ বছর, ১০ বছর, ২০ বছর পর কেউ আবার কলমের খোঁচায় তা বাতিল করে দিতে পারবে না। যেমনটা ঘটেছিল রক্ত দিয়ে অর্জিত কেয়ারটেকার সরকার আইনের বেলায়। একবার গণভোট হলে পরবর্তী সকল সংস্কার কেবল গণভোটের মাধ্যমেই কার্যকর হবে। এছাড়া নয়।
কাজেই গণপরিষদের মাধ্যমেই স্বৈরতন্ত্রের পতন এবং সমূলে উৎপাটন করে স্বৈরাচারের বার বার ফিরে আসা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব। এই মুহূর্তে যেটা আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট। ৪৬-এর গণপরিষদের পর যেমন ৪৭এ বৃটিশ থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম, ৭০-এর গণপরিষদের পর যেমন আমরা ৭১-এ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, এবার গণপরিষদের পর নিশ্চয় আমরা স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি পাবো। এই মুহূর্তে যেটা আমাদের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা।
দিদারুল ভূঁইয়া : অর্থনৈতিক সমন্বয়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
[email protected]
Discussion about this post