গতকাল এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল।
তিনি বললেন, রাজনীতিতে ভিসা নিষেধাজ্ঞার খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।
আমি বললাম, এই জিনিসটা আমাদের মতো গরিব লোকদের পক্ষে বোঝা একটু কঠিন। আমাদের সহায়-সম্পদ নেই, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেগুলো সুখে-শান্তিতে ভোগ করার বাসনাও নেই। যাদের আছে তাদের চিন্তা-ভাবনা আমরা বুঝবো না। ধরুন, কেউ একজন দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে গেছেন। বয়স কম থাকতেই সেখানে বাচ্চাদের পাঠিয়েছেন। বাচ্চারা সেখানে পড়াশোনা করে বড় হয়েছে। চাকরি-ব্যবসা করে সুখে আছে। তিনি বাড়ি-গাড়ি, জমিজমা কিনেছেন। নানা জায়গায় বিনিয়োগ করেছেন। একসময় স্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। নিজে ভাবছেন, অনেক তো চাকরি, ব্যবসা, রাজনীতি হলো। ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে ছবির মতো দেশটিতে গিয়ে নিজেও জাঁকিয়ে বসবেন। সেখানে সবই গোছানো আছে। এক কাপড়ে গেলেও সমস্যা নেই। কিন্তু হঠাৎ যদি এক সকালে তিনি মেইল খুলে দেখেন, তার ভিসাটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তবে কেমন লাগবে তার? এত কষ্ট করে যে টাকা-পয়সা জমা করেছেন, সে তো এই ধুলোবালি আর জ্যামে ভরা শহরে থাকার জন্য নয়। এখানে বাতাস দূষিত, শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার দশা, কোথাও কোনো শান্তি নেই। এখানে থাকলে আয়ু কমে যাবে দিনকে দিন। ছবির মতো কোনো দেশে ছবির মতো সাজানো গোছানো বাড়িতে জীবনের শেষ কটা বছরের আনন্দ তিনি যে আর উপভোগ করতে পারবেন না, সেটা কিন্তু তার জন্য অনেক বড় দুঃসংবাদ। শুধু তার জন্য নয়, সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী সকলকে হয়তো ওই সব দেশে সুখ, সম্পত্তি রেখে দেশে ফিরতে হবে প্রায় খালি হাতে।
এই বিষয়টা কেমন জানেন?
বন্ধু বললেন, কেমন?
আমি বললাম, আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্পটা জানেন তো? ডাকাতরা নানা জায়গায় ডাকাতি করে একটা পাহাড়ের গুহায় সোনা দানা হিরা জহরত সব এনে জমা করে। পাহাড়ের গুহার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এর সামনে দাঁড়িয়ে একটা পাসওয়ার্ড বললে গুহার দরজা খুলে যায়। গুহা থেকে বের হয়ে পাসওয়ার্ড বললে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। নিশ্চিন্তে সেখানে জমা করা যায় ডাকাতির সমস্ত সম্পদ। ওখানে রেখে রেখে জমিয়ে ভোগ করার অবারিত সুবিধা ডাকাতদের সামনে। কিন্তু হঠাৎ একদিন ডাকাতরা এসে দেখল, সেই পুরনো পাসওয়ার্ড ‘খুল যা সিম সিম’ আর কাজ করছে না। কে বা কারা পাসওয়ার্ডটা বদলে দিয়েছে।
কী হবে ডাকাতদের অবস্থা তখন?
ডাকাতদের যে অবস্থা হবে সেই অবস্থায় পড়েছে এখনকার ভিসা নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিরা। ধরা যাক, কোনো একজন কর্মকর্তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মতপ্রকাশের অধিকারে বাধা দিয়েছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। তিনি আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবেন না। তার স্ত্রী সন্তানরাও যেতে পারবে না। তাতে কী যায় এলো?
যে রাজনীতিক বা সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন, মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারেন বা মানবাধিকার লংঘন করতে পারেন তার অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় সহায়-সম্পদ থাকবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে না থাকলে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, দুবাই, সিঙ্গাপুর কোথাও না কোথাও থাকবে। যারা দিন-দুনিয়া চালায় তারা ভালো করেই জানে, কীভাবে দুনিয়াটা চলে। তারা জানে, কেন এবং কীভাবে লাখ লাখ ডলার একটি দেশ থেকে চলে যায়। সেরের ওপর সোয়া সের আছে। আর সোয়া সেররা সব জানে বলেই ঠিকমতো সব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোন জায়গায় চাবি দিতে হবে তারা জানে। এ কারণেই দেখবেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞা চালু করার ঘোষণা দিতে দিতেই বাংলাদেশে সভা-সমাবেশগুলো কেমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে থাকলো। পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তারা কেমন সাবধানী হতে থাকলেন। তবে সরকার বা সরকারি কর্মকর্তারা হয়তো ভেবেছিলেন, ভিসানীতির ঘোষণা দেওয়া হলেও নির্বাচনের আগে অন্তত নিষেধাজ্ঞার কাজ শুরু হবে না। নাইজেরিয়া ও কম্বোডিয়ার উদাহরণ তাদের সামনে ছিল। সম্প্রতি এরকম কয়েকটি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করেছে। নির্বাচনের পর কর্মকর্তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ফলে দেশগুলোর শাসকদের খুব বেশি ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি। নির্বাচন হয়ে গিয়েছে, ক্ষমতাসীনরা মসনদে বসেছেন। ভিসা নিষেধাজ্ঞায় সাময়িক কিছু সমস্যা হলেও ক্ষমতা থেকে নেমে যাবার মতো সমস্যায় তাদের পড়তে হয়নি। ব্যাপারটা তাদের জন্য অত বড় সমস্যা তৈরি করেনি। হয়তো সে অভিজ্ঞতা থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের আগেই, নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর সময়েই বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করলো।
সরকার অবশ্য আগে থেকেই এ নিয়ে বেশ সচেতন ছিল। কোন কর্মকর্তাদের কোথায় বাড়ি কেনা আছে, কাদের ছেলে-মেয়েরা বিদেশে পড়ছে সব হিসাব সরকার সংগ্রহ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। বলা হয়, এ কর্মকর্তাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা তাদের। কেননা যাদের সহায়-সম্পত্তি সন্তান-সন্ততি বিদেশে আছে, তাদের পিছুটান থাকবে। আর যাদের নেই তাদের সেই পিছুটান থাকবে না। ফলে তাদের দিয়ে নির্বাচনী কারচুপি করালে তারা নিষেধাজ্ঞার ভয় না পেয়ে কাজটি করতে পারবেন। এখন এই হিসাবে একটা সমস্যা হয়ে গেল। নির্বাচনের আগেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা চলে এলো। যাদের সন্দেহ করা হয়েছিল, তাদের হয়তো অনেকেই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকবেন। আবার নাও থাকতে পারেন। কিন্তু নির্বাচনী কাজে, বিরোধীদের দমাতে যারা কাজ করবেন তারা সক্রিয় হবেন তারা যে নিষেধাজ্ঞায় পড়বেনই তা নিশ্চিত হয়ে গেল।
বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, যারা নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন তারা কি সেটি প্রকাশ করবেন? এমন কি হতে পারে যে পাওয়া রাজনীতিক ও কর্মকর্তারা একজোট হয়ে গেলেন? যেহেতু তারা জেনেই গেলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর যেতে পারছেন না, সেখানে রাখা সহায়-সম্পত্তি ভোগ করতে পারছেন না, সেহেতু দেশেই নিজেদের জন্য একটা ভালো পরিস্থিতি তৈরি করে সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজনদের ডেকে নিয়ে এসে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার একটা ব্যবস্থা কি তারা করবেন না?
আমি বললাম, সেটা তো তারা করতেই পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো, ক্ষমতা তো চিরস্থায়ী নয়। হয়তো তারা একজোট হয়ে আরো কুড়ি বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। কিন্তু তারপর কী হবে? সবচেয়ে বড় কথা, এই দেশ কি তাদের থাকার উপযুক্ত? এই বসবাস অযোগ্য নগরীতে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাসে তারা কোন দুঃখে থাকবেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না হলে অন্য কোনো ঠান্ডা দেশে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতেই হবে। আর সেরকম ব্যবস্থা করতে না পারলে তারা হয়তো আরব আমিরাত বা তুরস্কের মতো গরম কোন দেশ বেছে নেবেন। তবে আমার মনে হয় না, যারা নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন বা পাবেন তারা কখনো নিজেদের নাম প্রকাশ করবেন। জোট করা দূরের কথা। এই নাম প্রকাশ্যে আসলে নানা সমস্যা। সাধারণ মানুষ তাদের চিনে ফেলবে, সংবাদমাধ্যম মুখরোচক গল্প ছড়াবে, ঘনিষ্ঠ সার্কেলে তাদের নিয়ে কথা হবে, এককান দুকান হয়ে অনেক জায়গায় ছড়াবে তাদের কথা। নাম না ছড়াতে না দিয়ে তারা বরং চাইবে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করে ফেলতে। তাছাড়া আইনের ফাঁকফোকর তো আছেই। আজ হয়তো তিনি নিষেধাজ্ঞায় পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছেন না, কিন্তু কাল পারবেন না তেমন তো কোনো কথা নেই। বড় সম্পত্তি হলে সেটা ফিরে পাবার চেষ্টা না করে, সব আশা ছেড়ে দিয়ে তিনি একেবারে নির্বাচনে কারচুপি করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এমনটি মনে হয় না।
ধরা যাক, একজন কর্মকর্তা চাকরি করছেন এখনো। তিনি ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন। সরকার তার কথা জানতে পারেনি। তিনি কিছুতেই চাইবেন না তার কথা সরকার জানুক। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পত্তি যা যাওয়ার তা তো গেছেই, তিনি চেষ্টা করবেন গোপনে অন্য কোথাও আরেকটা ব্যাকআপ তৈরি করতে। নাম প্রকাশ করলে সরকার তাকে পেয়ে বসবে। ইচ্ছামতো সব করিয়ে নেবে। নিজেকে বিপদে ফেলার কথা তিনি ভাববেন কেন?
রাজনীতিকদের বেলাতেও একই কথা খাটে। একজন রাজনীতি কেন নিজের নাম প্রকাশ করবেন? তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছেন না ঠিক আছে, কিন্তু ভোটারদের কাছে এ কথা প্রকাশ করবেন কেন? যদি সামনে কখনো একতরফা ভোট না করা যায়, যদি তাকে সত্যিকার অর্থেই ভোটারদের কাছে যেতে হয়?
বন্ধু বললেন, তাহলে মনে হচ্ছে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা যার যার ব্যক্তিগত গোপন দুঃখ হয়েই থাকবে।
আমি বললাম, সেটাই এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে এটি প্রকাশ করবে না। ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকের প্রকাশ করবে না। জনগণের রোষে পড়ার ভয়ে অনেকেই গোপন রাখবে। কিন্তু লোকে বিখ্যাত লোকদের কথা হয়তো কোনো না কোনোভাবে জেনে যাবে। ধারণা করবে কিন্তু নিশ্চিত হতে পারবে না। আবার মার্কিনিরা আরোপিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার টোপ দিয়ে কাউকে দলে টানার চেষ্টা করবে না তাও তো বলা যায় না।
বন্ধু বললেন, তারমানে পরিস্থিতি জটিল?
আমি বললাম, আমাদের বন্ধু রোকন রহমান একটা বই লিখেছিলেন তার নাম দিয়েছিলেন ‘জটিলের জটিলতা জনিত জটিলতা’। এখনকার পরিস্থিতি অনেকটা সেরকমই। ভিসা নিষেধাজ্ঞা এখন আর কাগুজে বাঘ নয়। অনেকেই নিষেধাজ্ঞা খেয়ে বসে আছেন। অনেকেই খাবেন। যারা খাননি, তারা তো চাইবেনই যেন না খান। ছবির দেশে গিয়ে শেষ বয়সটা কাটানোর স্বপ্ন কে না দেখে। ফলে সরকারের পক্ষে কারচুপি করে নির্বাচন করা একটু কঠিন হয়ে গেল। নিষেধাজ্ঞা পাওয়া লোকদের একজোট করে একটা ব্যবস্থা করা চিন্তা তাদের মাথাতেও থাকতে পারে। তবে এ দফা যারা নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন তাদের বেশিরভাগ মনে হয় সাবেক। সাবেকদের দিয়ে কাজটা হবে না। আর বর্তমান যদি কেউ থেকে থাকেন, তারা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করবেন।
বন্ধু বললেন, সরকার এবার কী করবে?
আমি বললাম, সরকার সম্ভবত কঠোর হবে। বিরোধীদের দমন করার নানা পরিকল্পনা আঁটবে। কিন্তু, সেটা করা ঠিক হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন নির্বাচনের আগেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা শুরু করেছে তখন সরকারের এটুকু বোঝা উচিত, কোথাও কিছু একটা বড় ধরনের গড়বড় হয়েছে। আর সে কারণেই মার্কিনিরা এতদূর এসেছে। বিষয়টি আমলে নিলে আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হবে। এবার সরকারের উচিত, দমনপীড়নের পথে না গিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে বসে সমঝোতার চেষ্টা করা। সামনের সংসদ অধিবেশনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল উঠিয়ে একটা ভালো নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। জল অনেকদূর গড়িয়েছে, এর বেশি গড়াতে দেওয়া উচিত নয়।
১৫ বছরের একটানা শাসনের পর আওয়ামী লীগ তো একটা কথা ভেবে স্বস্তি পেতেই পারে যে, একক দল হিসেবে এ দেশটা তারা সবচেয়ে বেশি সময় জুড়ে শাসন করতে পেরেছে। এখন একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করতে পারলে সামনে আবারও তাদের সুযোগ আসবে। কিন্তু এবার আর বেশি জলঘোলা করা ঠিক হবে না। জলের নিচে কিছু একটা বড় ধরনের গোলমাল তো হয়েছেই, নইলে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ব্রিটেনসহ পুরো পশ্চিমা দুনিয়া একসাথে মিলে এত চিন্তা করবে কেন?
Discussion about this post