এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় প্রায় ৮০ লক্ষ নতুন ভোটার। এই বিপুল সংখ্যক তরুণদের হাতেই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ। এদের দেশপ্রেম, এদের রাজনীতি সচেতনতাই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে! সরকার কাঠামো কেমন হবে। তারা যদি রাজনীতি সচেতন হন, তাহলে তারাই প্রস্তাব করবেন কেমন বাংলাদেশ তারা দেখতে চান। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এদেশের বেশিরভাগ তরুণের মধ্যে খুব বেশি রাজনীতি সচেতনতা এখন আর দেখা যায় না। রাজনীতি মানেই যে কোনো নির্দিষ্ট দলের সমর্থন বা লেজুড়বৃত্তি করতে হবে এমন নয়। রাজনীতি মূলত মানুষের রক্তের স্রোতের মধ্যে প্রবাহমান। কারণ মানুষ রাজনৈতিক জীব। অন্য সব জীবের সাথে মানুষের পর্থক্যটাই এখানে।
গত কয়েকবছরের যে রাজনৈতিক বাতাবরণ তাতে রাজনীতিকে ঘৃণা করার যথেষ্ট কারণ এদেশের তরুণদের থাকতে পারে। তারা বড়-ই হয়েছে প্রতিহিংসার রাজনীতি আর হানাহানি দেখে। আবার তাকে বড় করার সাথে সাথে পরিবারসহ নানা পরিসরে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং মুর্খ করে রাখা হয়েছে। এতে কী লাভ হয়েছে? আজ সে তার মৌলিক অধিকার হারিয়েছে, প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি তার খাদ্য তালিকায় প্রোটিনের পরিমাণ কমিয়েছে, প্রতিনিয়ত তার শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে, পরিবহন ভাড়া বাড়ছে, ডেঙ্গু জ্বরে মরে যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। একটা রাজনীতিবিমুখ তরুণ সমাজ কীভাবে তৈরি হয়!
তারুণ্য সাহসের প্রতীক। সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো রকম লাভ লোকসানের হিসেব না করে ঝাপিয়ে পড়ার নাম তারুণ্য। কিন্তু কীভাবে যেন দিনে দিনে এক আত্মমগ্ন, আত্মকেন্দ্রিক তরুণ সমাজ গড়ে উঠেছে। ‘আই হেট পলিটিক্স’ প্রজন্ম কি বুঝতে পারে না যে তাদের এই নির্লিপ্ততার জন্য পদে পদে সে হারছে! ভালোমানুষ হয়ে ঘাড়গুজে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করে যেতে যেতে প্রাইভেট সেক্টরেও তার চাকরি হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশি কর্মীরা। বেকার সমস্যায় জর্জরিত এই দেশে সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি বিদেশী কর্মী কাজ করছে। ব্যবসা করতে গেলে চাঁদাবাজি, সরকারি বেসরকারি সেক্টরে ঘুষ, মাসোহারা প্রদান ছাড়াও পদে পদে ঘাড়ধাক্কা খেতে হচ্ছে।
রাষ্ট্র মূলত একটি শোষণ যন্ত্র। যে
সব সময় চায় তার নাগরিকের সাথে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চালিয়ে যেতে। শাসক সুযোগ পেলেই জনগণের মাথায় হাত বুলিয়ে হোক বা শোষণ নির্যাতন করে হোক, তার স্থায়ীত্ব, অস্তিত্ব দীর্ঘায়িত করতে চায়। তবে জনগণের কাজ হলো প্রতিনিয়ত লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে জবাদিহিতার মধ্যে থাকতে বাধ্য করা। সরকার যখন তার নাগরিকের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করে, তখন নাগরিকেরও অধিকার থাকতে হয়, তাকে বদলে দেয়ার।
এটি একটি অনন্ত চলমান প্রক্রিয়া।
আর সেই প্রক্রিয়া চলমান থাকে রাজনীতি সচেতনতায়, লড়াই সংগ্রামে। যেদিন লড়াই সংগ্রামের প্রবণতা শেষ হয়ে যায় সেদিন থেকেই রাষ্ট্রের গণবিরোধী থাবা মানুষের বুকে চেপে বসে। মানুষ হারায় তার ন্যূনতম অধিকার।
তাই রাজনীতি সচেতন না হয়ে মানুষের উপায় থাকে না।
আর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটাররাই নির্ধারণ করে তারা কেমন সরকার চায়। তাই নাগরিক হিসেবে একটি জনবান্ধব রাষ্ট্র চাইলে, মাফিয়াতন্ত্র, বাজার সিন্ডিকেট, আমলাতান্ত্রিক শাসন, ঋণের বোঝা, শিক্ষা ও চিকিৎসার করুণ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি চাইলে, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক অধিকার চাইলে সবার আগে তাকে তার ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটা নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগী হতে হবে।
কারণ বাংলাদেশের মানুষের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষমতার পালাবদলটা গুরুত্বপূর্ণ। নইলে জবাবদিহিতাহীন, জোর জবরদস্তির একটা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে বসে। ভোটের মাধ্যমে দুর্নীতিতে জর্জরিত সিস্টেমগুলোর মূলোৎপাটন করতে না পারলে কোনো পরিবর্তনই আসবে না।
নতুন ভোটারকে ভাবতে হবে যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের নির্দিষ্ট শর্তাবলীর মধ্যে থেকে রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই নাগরিকের প্রকৃত স্বাধীনতা। শুধু নতুন ভোটার হয়ে বছরের পর বছর ধরে তা প্রয়োগ করতে না পারার ব্যর্থতা বয়ে বেড়ানোর মধ্যে আর যা-ই থাক তারুণ্যের গৌরব নেই।
Discussion about this post