বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয়ে সক্ষমতা তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার, আর্থিক খাত শক্তিশালী করা, নীতি কাঠামো আধুনিক করে তোলা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কাজে ৩১ জানুয়ারি ২০২৩-এ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। এ কিস্তির পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার।
আইএমএফ জানিয়েছিল, আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৩ বছরে ৭টি কিস্তিতে ঋণের পুরো অর্থ ছাড় করা হবে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের জন্য আইএমএফ-এর ঋণের আরও ৬ কিস্তি বাকি রয়েছে। এই ঋণের গড় সুদ হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ। প্রথম কিস্তি ছাড়ের পরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) স্টাফ ভিজিট চলমান রয়েছে এবং সংস্থাটি ঋণের ব্যবহার এবং শর্তের অগ্রগতি নিয়েও তদারকি করছে।
আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আগামী নভেম্বর মাসে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। তবে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে শর্তের অগ্রগতি মূল্যায়ন করছে আইএমএফ স্টাফ মিশন। তাই শর্ত বাস্তবায়ন ও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আগামী ৬ অক্টোবর ঢাকায় আসছে আইএমএফ-এর একটি মিশন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য চলতি বছরের প্রথমার্ধে যে শর্ত দিয়েছিল এর মধ্যে ২টি প্রধান শর্ত পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। শর্ত মতে, বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। গুরুত্বপূর্ণ দুটি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় আইএমএফ-এর দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত অনুযায়ী গত জুনের শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা ছিল। অথচ ওই সময়ে নিট রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় চার বিলিয়ন ডলার পিছিয়ে। তবে পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে তারা বলেছে, জ্বালানি, সার ও খাদ্যদ্রব্য আমদানির জন্য সরকারকে রিজার্ভ থেকে ডলার দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য প্রতিশ্রুতি, যেমন– সুদের হার নির্ধারণে করিডোর সিস্টেম চালু, আইএমএফ-এর ব্যালান্স অব পেমেন্ট ম্যানুয়াল-৬ অনুসারে রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া মুদ্রাবিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি কর্মপরিকল্পনা শেষ করে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এই সব সংস্কারমূলক কার্যক্রমের কারণে রিজার্ভের পরিমান বাড়বে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন।
অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদেরকে ৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয় আইএমএফ। এনবিআর আহরণ করেছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়া প্রসঙ্গে এনবিআরের পক্ষ থেকে বৈঠকে জানানো হয়েছে, কভিড ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতি থাকায় কাঙ্ক্ষিত হারে শুল্ক-কর আদায় সম্ভব হয়নি।
এই প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বড় সমস্যা হচ্ছে রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া। অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাড় দিলেও আইএমএফ এ ক্ষেত্রে ছাড় দিতে চায় না। তা ছাড়া রিজার্ভ প্রতিনিয়তই কমছে।
যদিও ঋণের সুদহার ও মুদ্রাবিনিময় হারে যেটুকু সংস্কার প্রয়োজন, তা করা হয়েছে। আরেকটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে নতুন ফর্মুলাই চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। এটি করার কথা ছিল, দাম বেড়ে যাবে, তাই ফর্মুলা বাস্তবায়ন হচ্ছে না– এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তা ছাড়া বিশ্ববাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গত নভেম্বরে সরকার জ্বালানিতে যে দাম নির্ধারণ করেছে, বর্তমানে সমন্বয় করা হলে আর বাড়ার কথা নয়। তাছাড়া আইএমএফ-এর ঋণ বা কিস্তি ছাড়ে অবশ্যই আমেরিকার সম্মতি প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমেরিকার মতামতই বা কী তাও দেখার বিষয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফ মিশন আগামী ৬ থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। সংস্থাগুলো হচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে নভেম্বরের শেষ নাগাদ পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। নিয়ম অনুযায়ী, কিস্তি ছাড়ের জন্য পর্ষদের ১০০ ভোটের মধ্যে অন্তত ৭৫ ভোট পেতে হবে। পর্ষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাধিকার ক্ষমতা ২৬টি। তাই দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতির প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সম্প্রতি পাস হওয়া বেশ কিছু বিদেশি ঋণের কিস্তি শিগগিরই চলে আসবে। এতে রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে সন্তোষজনক অবস্থানে পৌঁছাবে। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবণতার পাশাপাশি প্রয়োজন মেটাতে নিয়মিত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভ ধরে রাখা কঠিন হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ নিট বৈদেশিক রিজার্ভ থাকার কথা, বাংলাদেশ ব্যাংক তা করে দেখাতে পারেনি এবং জিডিপি’র অনুপাতে ০.৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা এনবিআর আইএমএফ-এর সামনে তুলে ধরতে পারেনি। ফলে রিভিউয়ে খুব সহজেই বাংলাদেশ পার পাবে এমন সহজ নয়। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও আইএমএফ-এর মিশন অখুশি বলে মনে হচ্ছে। এসব সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি বদলাতে হবে।
দেশের এই মুহূর্তের সার্বিক অর্থনৈতিক সূচক পর্যালোচনা করে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আইএমএফ-এর শর্ত পূরণ করে দ্বিতীয় কিস্তির লোন ছাড় পাওয়া সহজ হবে না।
Discussion about this post