বেগম খালেদা জিয়া হাসপাতালে। প্রতিবার তিনি যখন হাসপাতালে যান তখন সবার মাঝে উদ্বেগ দেখা যায়। কিন্তু আমার কেন জানি না সব সময় মনে হয়, তিনি ফিরবেন। এমন অনুভূতি আমার বাবা অসুস্থ হলে হয়! মনে হয় তিনি সুস্থ থাকবেন। তেমনই মনে হয়, এই রেজিমের পতন দেখতে বা পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়ে দেশ ও মানুষকে উদ্ধার করার জন্য হলেও সৃষ্টিকর্তা তাঁকে সুস্থ রাখবেন। বিএনপির রাজনীতি না করেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমার এই টান আত্মিক। আমি আমার দেশকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি দেশের প্রতি ডেডিকেটেড একজন নেতার প্রতি এটা আমার এক ধরনের দুর্বলতা বলা যায়। বেগম খালেদা জিয়াকে আমি বাংলার অবিসংবাদিত নেতাদের একজন মনে করি। আমি যে সময়টায় বেড়ে উঠেছি, মূলত আমাদের কৈশোরকালটা এক তুমুল আন্দোলনের ভেতরে কেটেছে। এবং এটা ঘটেছে দীর্ঘ সময় ধরে।
শুধু যে ৯০-এ তা নয়, ১৯৮৭/৮৮/৮৯ এই দীর্ঘ সময় বাবার রাজনৈতিক সংগ্রাম, জেল-জুলুমের পরোক্ষ প্রভাব আমাদের ওপরে ওই সময়টাতেই পড়েছে। আর সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। সঙ্গে ছিল তাঁর আপোষহীন ভূমিকা।
প্রথম যখন আমি তাঁকে দেখি, এক হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো মনে হয়েছিল। যেন অন্ধকার আকাশে তীব্র বিদ্যুতের চমক। একটা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগদান শেষে তিনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। চিকন পাড়ের সাদা শাড়িতে তাঁর যে সৌন্দর্য, সেটা শুধু সৌন্দর্য নয়। তাঁর যে বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল, তা হলো তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। সেই ছাপ তাঁর আচরণে ছিল বলেই একটি পুরুষশাসিত সমাজে, একজন নারী শক্ত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু প্রয়াত স্বামীর জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেননি। বরং প্রেসিডেন্ট জিয়া যে দল তৈরি করেছিলেন, সেই দলের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভিত গড়ে দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি যখন বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন বিএনপি ক্ষমতাহীন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু জেনারেল এরশাদ সত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন। কাণ্ডারিহীন বিএনপির নেতাকর্মীদের অনুরোধে দলের হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া।
এরশাদ তার স্বৈরাচারী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সব স্বৈরশাসকের মতো দেশের একশ্রেণীর কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সহ রাজনৈতিক নেতাদের একে একে কিনে ফেললেন। শুধু পরাস্ত হলেন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। যে কারণে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এতটা বেগবান হতে পেরেছিল।
আর খালেদা জিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ আপোষহীন ভূমিকা তৎকালীন রাজনীতি বিশ্লেষকরা বুঝতে না পারলেও, জনগণ ঠিকই বুঝেছিল। সে কারণে খালেদা জিয়ার বিএনপিকে ১৯৯১-এর নির্বাচনে ভোট দিয়ে তারা ক্ষমতায় নিয়ে আসে। ব্যক্তি খালেদা জিয়ার তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ- তিনি কোনোদিন কোনো আসনে নির্বাচন করে হারেননি। এদেশে নিজেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা কোনো সহজ বিষয় নয়। এর পেছনে নিশ্চই তাঁর উদার গণতান্ত্রিক মনোভাব ভূমিকা রেখেছে। তার সরকার ক্ষমতাসীন অবস্থায় সরকারের সব রকম সমালোচনা করতে পেরেছে মিডিয়া। আর তাই হয়তো একজন নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া এ দেশে সবচেয়ে বেশি মিডিয়া প্রপাগাণ্ডার শিকার হয়েছেন। ১/১১’র সরকার তাঁর বিরুদ্ধে যেসব মামলা করে ওগুলো ছিল ভিত্তিহীন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কথা কম বেশি সবাই জানে, আর নাইকো দুর্নীতি মামলা যেটা হয়, সেটা দুই নেত্রীর বিরুদ্ধেই হয়েছিল। কারণ নাইকো দুই সরকারের সময়ই গ্যাস উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছিল।
কিন্তু ১/১১ সরকারের পর আওয়ামীলীগ সরকার এসে ওই মামলাগুলোয় তাঁকে সাজা প্রদান করা হয়। বেগম খালেদা জিয়া নির্বাহী আদেশে জেলের বাইরে থাকলেও কার্যত তিনি এখনো কারাবন্দি। তবে কথা হচ্ছে,
তিনি গুরুতর অসুস্থ। বলতে গেলে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। এই বয়সে তিনি তাঁর পরিবার-পরিজন থেকেও বিচ্ছিন্ন।
তাঁর উন্নত চিকিৎসা দরকার। কিন্তু তাঁকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে দেয়া হচ্ছে না।
জেলে থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়াকে সরকারের অনেক ভয়। কারণ তাঁর আপোষহীন মনোভাব। তিনি একটু নমনীয় হলেই হয়ত উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারতেন। তিনি যদি এ সরকারের অধীনে একটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে শামিল হতেন, তাহলে হয়তো অনেক সমীকরণ বদলে যেত! কিন্তু না, এখন পর্যন্ত তিনি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও অনড় অবস্থানে আছেন। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। এদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রাণ দিতেও প্রস্তুত।
কিন্তু আমার মনে হয়, খালেদা জিয়ার চিকিৎসাকে রাজনৈতিক দেন-দরবারের বিষয় করে তোলা উচিত নয়। সরকারের দায়িত্ব, উন্নত চিকিৎসার জন্য অবিলম্বে তাকে বিদেশ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া। এক্ষেত্রে তার দল ও আত্মীয়-স্বজনের সিদ্ধান্তকে সম্মান করা উচিত। সব কিছুকে রাজনীতির বিষয় করে তুললে আদতে রাজনীতিটাই থাকে না।
Discussion about this post