অনেকে মনে করেন, বিএনপি গত ১৫ বছর ধরে বিরামহীনভাবে সরকার-বিরোধী আন্দোলন করছে এবং এই দীর্ঘ সময় জুড়ে সক্রিয় থেকেও দলটি আন্দোলনের ফল ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমি মনে করি, এ ধারণাটি ভুল।
গত ১৫ বছরে বিভিন্ন সময় বিএনপি সরকার-বিরোধী আন্দোলন করলেও তা দীর্ঘসময় জুড়ে বিরতিহীনভাবে চালু রাখেনি।
আমার মতে, গত ১৫ বছরের মধ্যে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত দলটি নিরবচ্ছিন্নভাবে অর্থপূর্ণ আন্দোলন করেছে। স্পষ্টভাবে বললে, গত দেড় বছর ধরে তারা সিরিয়াস আন্দোলন করছে। আর এই দফা বিএনপি আত্মবিশ্বাস সহকারে মাঠে নামতে শুরু করেছে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের ওপর আরোপিত স্যাংশনের পর।
কম-বেশি দেড় বছরের আন্দোলনের ফল বিএনপি ঘরে তুলতে না পারলেও এ সময়ে বিএনপির অর্জন বিশাল। লেখার শেষে সেগুলো উল্লেখ করবো। তার আগে বলে নেই, কেন আমি মনে করি, ২০২২ সালের আগে বিএনপি অর্থপূর্ণ সরকার-বিরোধী আন্দোলন করেনি।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা অনেক বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেন, এই শাসন আমলে আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি।
ওয়ান ইলেভেনের পর পরিস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল, প্রধান দুটি দলের মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। তারা উভয়ে মনে করেছে, অনির্বাচিত বা সেনাসমর্থিত বা সেনাশাসন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য শুভ ফল বয়ে আনে না। ফলে, ভবিষ্যতে এ ধরনের শাসন-ব্যবস্থা আসার সম্ভাবনা তারা যৌথভাবে প্রতিহত করবে। সে সময় দুই দলের পক্ষ থেকে অনির্বাচিত ব্যবস্থার বিপক্ষে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দেওয়া হতো। দলের সংস্কারপন্থীদের ব্যাপারে দুই দলই একই মনোভাব পোষণ করেছে।
হয়তো বিএনপি ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগের মতো করে এ ধরনের শাসন-ব্যবস্থা যাতে ফিরে না আসে সে ব্যবস্থা করতো। সেসময় বিএনপি বিরোধী দলে ছিল। ফলে, আওয়ামী লীগই সক্রিয়ভাবে অনির্বাচিত শাসন-ব্যবস্থা যাতে ফিরে না আসে তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা করেছে এবং তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বন্ধ করে দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের ক্ষমতাও পাকাপাকি করে নিয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে তারাও ওয়ান-ইলেভেনের মতো অনির্বাচিত সরকার আসার পথ বন্ধ করতো বলে আমার ধারণা। তবে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বন্ধ করে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চাইতো কী? বা পারতো কী? ২০২৪ সালের বিএনপি চাইতো না নিশ্চিতভাবে। কিন্তু ২০১১ সালে ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি হয়তো সেটা করতে চাইতো। ২০০৬-২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দলটির মনোভাব থেকে এর বাইরে কিছু ভাবা কঠিন।
সম্ভবত, এ কারণেই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বড় ধরনের কোনো ওজর-আপত্তি ও প্রতিবাদ কর্মসূচির দেখা পাইনি। বরং, সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে তখন এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের ব্যর্থতা ও ক্ষমতা অপব্যবহারের কারণে সিভিল সোসাইটির ওজর-আপত্তিও বড় ধরনের জনসমর্থন পায়নি। তখন না বুঝলেও, জনগণের বড় একটি অংশ ও বিএনপি বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝতে পারে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর। স্পষ্ট হয়ে যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো সম্ভানাই নেই। এই উপলদ্ধিটি অনেক দেরিতে এসেছে এবং উপলদ্ধি আসার পরপর কিছু করারও ছিল না। কেননা, বৈশ্বিক কভিড-১৯ মহামারী পরবর্তী দুটি বছর বাংলাদেশকে বিপর্যস্ত করে রেখেছিল। কিন্তু মহামারী কেটে যাওয়ার পর বিএনপি খুব বেশি দেরি করেনি। যথাযথভাবে বিষয়গুলো জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছে এবং জনসমর্থন নিজেদের পক্ষে টানতে পেরেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ যখন সরকারে থেকে ভারতের সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে তুলতে দীর্ঘমেয়াদী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করছিল তখন বিএনপির ভূমিকা কী ছিল? ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচিগুলোর ধরন খেয়াল করলে সেটার উত্তর পাওয়া যাবে। সে সময় বিএনপির কর্মসূচির কেন্দ্রে ছিল আদালত পাড়া। দলটির মূল লক্ষ্য ছিল, ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের দেওয়া মামলাগুলো থেকে দলের নেতাদের মুক্ত করে আনা। সেসময়ের চলমান বিষয়গুলো নিয়ে দলের পক্ষ থেকে বিএনপি কোনো শক্তিশালী ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে পারেনি। জনগণের সমস্যা নিয়ে খুব কম কর্মসূচি দিয়েছে।
২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিএনপি কোনো অবস্থান নিতে পারেনি, নিজস্ব বক্তব্য তৈরি করতে পারেনি অনেকদিন পর্যন্ত। অনেক পরে অবশ্য একটা ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে।
২০১০ সালে খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উৎখাতের পরও তারা শক্ত প্রতিবাদ করতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর তাদের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর নেতারা অভিযুক্ত হতে থাকলে সেটা নিয়ে বিএনপি কোনো স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেনি। তারা এর পক্ষে-বিপক্ষে কোথাও নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি।
এমনকি ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হলে, এই মঞ্চ বিষয়েও বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার ছিল না। কখনো মনে হয়েছে তারা মঞ্চকে স্বাগত জানাবে, কখনো মনে হয়েছে তারা এর বিরোধিতা করবে। গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন শুরু হলে সে বিষয়েও তারা স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেনি। একবার মনে হয়েছে, তারা হেফাজতের আন্দোলনে যোগ দেবে আরেকবার মনে হয়েছে যোগ দেবে না। শেষ পর্যন্ত তারা যোগ দেয়নি। রক্তাক্ত পথে হেফাজেতের সমাবেশ ভণ্ডুল করে দেওয়ার পরপর বিএনপি কার্যকরভাবে খুব স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে বলে মনে পড়ে না।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত বিষয়ে একই কথা। বর্জন করে নির্বাচনটি ঠেকাতে পারবে কি না সে বিষয়ে তাদের কোনো হিসাব-নিকাশ ছিল বলে মনে হয় না। যদি থাকতো, তবে দুটি ট্রাক বসিয়ে খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা কি সম্ভব হতো? সে সময় বিএনপির অল্প কিছু নেতাকর্মী গুলশানের দিকে গেলে কি ট্রাকগুলো যথাস্থানে থাকতে পারতো? এই নির্বাচনের আগে-পরে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটিকেও তারা অব্যাহত রাখেনি। সরকার যে নির্বাচনকে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলেছিল সেই নির্বাচন বাতিল করে মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায় করতে না পারাকেও একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবেই দেখতে হবে।
২০১৫ সালের পর ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচির ধরন দেখে মনে হয়েছে সরকারকে মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে দেওয়ার ব্যাপারে তারা একরকম রাজি হয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তোলেনি। বরং দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতকে পাশে রেখে ঐক্যজোট গঠন করে এরকম আপোষ-আলোচনার নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাতের ভোটের পথ করে দিয়েছে। নির্বাচনের দিন রাতের ভোটের কথা স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। কিন্তু পরে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও বিএনপি শক্ত প্রতিবাদ গড়ার চেষ্টা করেনি বরং ওই নির্বাচনে বিজয়ী গুটিকয় সদস্যকেই সংসদে পাঠিয়েছে। মুখে অবৈধ বললেও এর মাধ্যমে কার্যত সরকার ও সংসদকে বৈধতা দিয়েছে তারা।
আমার মতে, নতুন দফার আন্দোলনে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দেরিতে হলেও তারা ভুল সংশোধন করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে হিসেবে এ দফা বিএনপির সিরিয়াস আন্দোলনের বয়স ১ বছর।
গত ১৫ বছরে বিএনপির সব ব্যর্থতাকে নানা যুক্তিতে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু পরিবারতান্ত্রিক দল হিসেবে খালেদা জিয়ার জেল হওয়ার পর বিএনপি যে নিষ্ক্রিয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। ২০০৮-২০০১৮ পর্যন্ত ১০ বছর বিএনপির কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে ছিল মামলা থেকে খালেদা জিয়ার অব্যাহতি। এজন্য তারা কখনোই শক্ত কর্মসূচি দেয়নি। এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ ও সরকারকে মেনে নিয়েছে। খালেদা জিয়ার জেল হওয়ার পর সেই দলটি যে কোনো প্রতিবাদই দাঁড় করাতে না পারার ঘটনা দল হিসেবে বিএনপিকে অনেক দুর্বল করে দিয়েছে।
দীর্ঘ ফিরিস্তি দিয়ে ওপরে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করলাম তাতে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট :
১. বিএনপি তাদের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার অনন্ত তিনটি বড় বিপদে তার পাশে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
২. জোটসঙ্গী জামায়াতের ব্যাপারে গত ১৫ বছরে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি।
৩. দেশের রাজনৈতিক গতিমুখ পরিবর্তনকারী তিনটি ঘটনায় নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি।
৪. জনগণের সমস্যাকে তারা নিজেদের কর্মসূচির কেন্দ্রে স্থান করে দিতে পারেনি।
৫. বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সঠিক অবস্থান নিতে বা নিজেদের ন্যারেটিভ তৈরি করতে অনেক বেশি সময় নিয়েছে।
প্রশ্ন হলো, এ সমস্যাগুলো কেন তৈরি হয়েছে?
আমার মতে, বড় দল হিসেবে নানামতের লোকদের পারস্পারিক টানাটানিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দলটিকে বেশ দুর্বল করে দিয়েছে।
বড় ও ইনক্লুসিভ দল হিসেবে বিএনপির মধ্যে নানামতের মানুষের অংশগ্রহণ থাকবেই। উদাহরণ হিসেবে তুলনামূলকভাবে কম ইনক্লুসিভ আওয়ামী লীগের কথা বলা যায়। দলটি মোটাদাগে ভারতপন্থী। কিন্তু সেখানে কি পাকিস্তানপন্থী লোকেরা নেই? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের মধ্যেও আওয়ামী লীগে মার্কিনপন্থীরা শক্তিশালী ছিল না?
শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাযুক্ত বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির মধ্যেও ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, চীনপন্থী, রুশপন্থী, মার্কিনপন্থী সব লবিরই লোক থাকা স্বাভাবিক। শুধু স্বাভাবিক নয়, ফরেইন কমিটিতে ফরমালি নানা ডেস্ক করে একেকটি দেশের জন্য আলাদা গবেষণা ও লিয়াজোঁ কমিটি করা দরকার। প্রয়োজন অনুসারে, নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নির্দিষ্ট ডেস্কেকে কাজে লাগানোর প্রস্তুতি রাখতে হবে। কিন্তু বিএনপির মধ্যে কে ভারতপন্থী আর কে মার্কিনপন্থী সেটা খুঁজে বের করাই মুশকিল। একই ব্যক্তি চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সবার সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছেন। শেষ পর্যন্ত জানা যাচ্ছে, তিনি আসলে ভারতের খাস লোক। অর্থাৎ দলটির মধ্যে কে কোন লবির সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নীতিনির্ধারকদের নেই। ভূরাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে বিএনপিকে দুর্বল করে দিয়েছে এসব ঘটনা।
তবে, ২০০৮ থেকে গত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির স্লথগতি, নিষ্ক্রিয়তা বিশেষ করে খালেদা জিয়া বিষয়েও কিছু করতে না পারার দৃষ্টান্তগুলো থেকে ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, দলটিতে ভেতরে ভেতরে ভারতপন্থী ও সরকারপন্থী অংশ বেশ শক্তিশালী। তারা বিএনপিকে আশার ছলনায় ভুলিয়ে ভুলিয়ে তিন মেয়াদ পার করে ফেলেছে।
দ্বিতীয় যে প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা হওয়া দরকার সেটি হলো, গত ১৫ বছরে বিএনপি বারবার বুঝেছে তার জনসমর্থনে কোনো ঘাটতি নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারাই বিপুল ভোটে জিতবে। কিন্তু সত্য হলো, জনসমর্থন এখন আর আগের মতো করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে না। ক্ষমতায় আসার জন্য দরকার ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোকে নিজেদের জায়গা বাড়ানো। এর জন্য শহুরে বিশেষ করে ঢাকা শহরের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তাদের মোটিভেট করতে হবে। তাদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির আলোচনা করতে হবে। এই লোকগুলো যদি মনে না করে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার তাহলে কখনোই সুষ্টু নির্বাচন হবে না। কোটি কোটি মানুষের সমর্থন নিয়েও বিএনপি কিছু করতে পারবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই গোষ্ঠীটির বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার ন্যারেটিভে বিশ্বাস করে। দেশের ৯০-৯৫% মানুষ ৫ জানুয়ারি ভোট দিতে যায়নি। এরাও ভোট দিতে যায়নি। কিন্তু এরা মনে করে, আওয়ামী লীগ নতুন করে ক্ষমতা দখল করতে পারার ঘটনাটা আখেরে ভাল হয়েছে। কেননা, বিএনপির সঙ্গে এমন কিছু উপাদান আছে যা তাদের শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবনযাপনকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এর বিপক্ষে বিএনপির ন্যারেটিভ কী? বিএনপি সহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো একবছর আগে ৩১ দফা কর্মসূচিতে একমত হলো। কিন্তু ৩১ দফা ঘোষণার পরপরই কেন একদফার আন্দোলনে চলে গেল?
৩১ দফা মানুষের কাছে পৌঁছানোর আগেই এক দফায় যাওয়া ভাল ফল দেয়নি। জনগণ বুঝতে পারেনি ক্ষমতায় এলে বিএনপি তাদের বিকল্প কী দেবে। বিএনপি যদি সরকারকে মেয়াদ শেষ করতেই দেবে তবে এক বছরই আগে কেন একদফা দিয়েছিল, ৩১ দফাকে সামনে না এনে? আমার মতে, ৩১ দফা থেকে ১ দফায় উল্লম্ফন, সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায়, বিএনপির আন্দোলনের রিচ বাড়িয়েছিল কিন্তু এনগেজমেন্ট তৈরি করতে পারেনি।
তৃতীয় বিষয়টি জামায়াত ও ইসলামপন্থীদের প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান। এ বিষয়ে আমি আলাদা করে লিখেছি। জামায়াত প্রসঙ্গটি বিএনপি বহু বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে। জামায়াত তাদের সঙ্গে আছে না নেই, সেটি স্পষ্ট নয়। বিএনপি হয়তো মনে করে, এটা তাদের কৌশল। কিন্তু এ কৌশল উপকৃত করার বদলে দলটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সমাজের মধ্যে দুটো ধারণা আছে। একদল মনে করে, বিএনপি যত কথাই বলুক জামায়াত তাদের সঙ্গে আছে। নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি জামায়াতের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেবে এবং সরকারের ভাগও তাদের দেবে। আরেক দল মনে করে, জামায়াতকে ভোটের হিসাবের জন্য ঝুলিয়ে রাখলেও শেষ পর্যন্ত সাথে রাখবে না বিএনপি। জামায়াত নিয়ে অস্পষ্ট অবস্থানের কারণে বিএনপির ইসলামপন্থী ও সেকুলার উভয় সমর্থক দলই দ্বিধায় থাকে। বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তারা জামায়াতকে ফাইনালি সঙ্গে রাখবে নাকি বাদ দেবে। ইসলামপন্থীদের বেলাতেও একই কথা। কেননা, দুই ক্ষেত্রে তাদের নীতি দুই রকম হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মিত্র ঠিক করার ক্ষেত্রেও এটি নির্ধারক ভূমিকা পালন করবে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সবাই সব খবর জানে। ফলে, কৌশল করে এ থেকে ফায়দা আর পাওয়া যাবে না।
জামায়াত ও ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার পর নীতি প্রণয়ন করতে হবে রাজনীতিতে ইসলাম প্রসঙ্গ তারা কতটুকু, কীভাবে অ্যাড্রেস করবে। কতটা করা বাস্তবসম্মত।
প্রতিবেশীদের প্রসঙ্গেও কিছু কথা বলা দরকার। একবার ভারতের কাছে চলে যাওয়া একবার দূরে সরে আসা, একবার চীনের কাছে যাওয়া একবার দূরে সরে আসার নীতি বিএনপির জন্য খুব ভাল ফল দিচ্ছে না। কৌশল হিসেবে কাছে যাওয়া বা দূরে সরা যেতেই পারে। কিন্তু বারবার এ ধরনের পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ আসলে ক্ষতিকর। কোনো পক্ষই কাউকে আস্থা ও বিশ্বাসের আওতায় আনতে পারে না। তবে ভারতের বেলায় এটা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, দেশটি বারবার বিএনপিকে ট্র্যাপ করেছে। ফাইনালি তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। কংগ্রেস বা বিজেপি ম্যাটার করে না। ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট কোনোভাবে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দিতে চায় না।
আবার সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রসঙ্গে আসি। এত কিছুর পরও গত দেড় বছরের আন্দোলন ৫টি কারণে সফল হয়েছে বলে আমি মনে করি।
১. বিএনপি দেখাতে পেরেছে জনসমর্থন তাদের দিকে আছে। জনগণ তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
২. সরকারের শত চেষ্টার পরও দলটির ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করা যায়নি। যারা দলটি থেকে বেরিয়ে গেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকে ব্যর্থ হয়েছেন।
৩. বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচি সফল হয়েছে। সিংহভাগ নেতাকর্মী সর্বোচ্চ চেষ্টা ও আত্মত্যাগ করেছেন।
৪. প্রথমবারের মতো বিএনপি শহুরে জনগোষ্ঠী, সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবীদের ছোট হলেও একটি অংশকে এনগেজ করতে পেরেছে।
৫. ৯০-৯৫% ভোটার বিএনপির ডাকে ভোট বর্জন করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো হলো না। বিএনপিও ক্ষমতায় আসতে পারলো না। এখন বিএনপি কি গত দেড় বছরের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা সামনের দিনে অব্যাহত রাখবে নাকি নতুন করে কৌশল সাজাবে?
আমার মতে, বর্তমান ধারাটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু বিএনপির কয়েকটি দুর্বলতা স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে, যেগুলোর সমাধান করা দরকার।
১. কর্মসূচি গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও দীর্ঘসূত্রিতা। সঠিক সময়ে সঠিক কর্মসূচি নিতে না পারা। সরকারকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া। ভুল সময়ে কর্মসূচির ভুল লক্ষ্য নির্ধারণ।
২. নিজেদের সক্ষমতা ও শক্তি কাজে না লাগিয়ে বাইরের শক্তির পদক্ষেপের ওপর নির্ভরশীলতা।
৩. স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণে নেতাদের ক্ষমতায়ন না করা।
৪. ক্ষমতায় গেলে সরকার কাঠামো কী হবে, কারা শীর্ষ পদে থাকবেন সে বিষয়ে অস্পষ্টতা। ক্ষমতায় গেলে শরিক ও সহযোগীরা তো বটেই বিএনপির শীর্ষ নেতারা কী পাবেন সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা না থাকা।
৫. কর্মীদের স্পিরিট বোঝার ক্ষেত্রে গ্যাপ।
৬. সরকারের সক্ষমতাকে আন্ডারএস্টিমেট করা। যথেষ্ট কৌশলী না হওয়া। এবং কর্মসূচি ও কৌশল ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রবণতা।
৭. আত্মতৃপ্তি। সমালোচনা গ্রহণ না করে প্রশংসা ও আশাবাদের দিকে বাড়তি ঝোঁক।
এসব সমস্যা সমাধানের উপায় কী?
সমস্যাগুলোর ধরন থেকে বোঝা যায়, বিএনপির একটি বড় সমস্যা হলো যথেষ্ট গবেষণা, চিন্তা-ভাবনা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের সমস্যা।
সত্য হলো, বাইরে থেকে ধার করে দলটি এসব বিষয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান সংগ্রহ করতে পারবে না। ফলে, তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী থিঙ্কট্যাংক তৈরি করতে হবে। প্রচুর ডকুমেন্ট ও ডেটা তৈরি করতে হবে। পাবলিক ডকুমেন্ট তৈরি করতে হবে। আওয়ামী লীগের ন্যারেটিভের বাইরে শক্তিশালী ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে। এসবের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিকল্প পাওয়ার সেন্টারগুলোর সঙ্গে এনজেগমেন্ট বাড়াতে হবে।
তবে সবার আগে জরুরি, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়গুলোর মূল্যায়ন। কোন কোন পয়েন্ট থেকে ভুল সিদ্ধান্ত আসছে, সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, স্যাবেটাজ হচ্ছে তা বের করার জন্য ১৫ বছর যথেষ্ট সময়। সেগুলো রিভিউ করে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা জরুরি।
এত কথা বলছি একটা কারণেই, আমি মনে করি অতীতের নানা ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও দেশের গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে বিএনপি বড় শক্তি। এখনও রাজনৈতিক দল হিসেবে দলটি যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। সবচেয়ে বড় কথা, সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তাই বিএনপি সমর্থন না করেও স্বাধীন চিন্তার অংশ হিসেবে কথাগুলো বলে রাখলাম।
Discussion about this post