দৈনিক কালবেলা ও দৈনিক সমকালে প্রকাশিত বিশিষ্ট বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এম এম আকাশের সাম্প্রতিক পর্যালোচনা নিয়ে বামপন্থী রাজনৈতিক মহলে উত্থাপিত কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমাকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে।
যারা আমার মতামত জানতে চেয়েছেন, তাদের সবাই বৃহত্তর বাম রাজনীতি তথা সমাজতন্ত্রমুখী বৈপ্লবিক পরিবর্তনের রাজনীতির অনুসারী। তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে, তিনি লেখাটি একজন কমিউনিস্ট, একজন মার্কসবাদী, সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা বা বিশিষ্ট বাম বুদ্ধিজীবী হিসাবে লেখেননি। বলা যায়, এখানে তিনি ঢাকার রাজপথে ভ্রাম্যমান একজন অতি সাধারণ পর্যবেক্ষক অথবা পত্রিকার অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো একজন নিরপেক্ষ লেখক মাত্র।
বন্ধুরাও নাছোড়বান্দা। তারা আমার জবাবে সন্তুষ্ট নয়। কে তাদের বোঝাবে যে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা, বিশেষ করে ‘বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর’ তকমা যাদের স্থায়ীভাবে করায়ত্ত- এটা তাদের এক বিশেষ পারদর্শিতা। তারা প্রয়োজন মতো মার্কসবাদী হতে পারেন, সমাজতন্ত্রের নতুন নতুন ব্যাখ্যা দিতে পারেন এবং বামপন্থী আন্দোলনের প্রেসক্রিপশনও করতে পারেন। আবার প্রয়োজন মতো, আদর্শ-রাজনীতি জলাঞ্জলি দিয়ে, কথার মারপ্যাঁচে নিরীহ নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকও সাজতে পারেন। এতে হতাশার কিছুই নেই বরং মাঝে মাঝে ইন্দ্রজালের খোলস থেকে বেরিয়ে আসা এইসব বুদ্ধিজীবীদের চিনে নেবার সুযোগ পাওয়া যায়।
এম এম আকাশের পর্যবেক্ষণ নানা পরস্পর বিরোধিতায় ঠাসা। এই ক্ষুদ্র পরিসরে তার পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ আলোচনা অসম্ভব ও অপ্রয়োজনীয়। তবে তাঁর বাজারজাতকরা চিন্তার কয়েকটি দিকের উল্লেখ করা বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে দায়িত্ব বলে মনে করছি।
দ্বিদলীয় বৃত্ত এবং ‘অস্তিত্বহীন বাম বিকল্প’
এম এম আকাশের পর্যবেক্ষণের অধিকাংশই জুড়ে আছে ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি’, দ্বিদলীয় বৃত্তের অংশীদার দুই পক্ষের তুলনামূলক আলোচনা। বাংলাদেশের এই দুই লুটেরা ধনিকদের চরিত্র বিশ্লেষণে, ‘যে মৌলিক অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে একটি সরকারের চরিত্র নির্ধারিত হয় সেটি উভয়েরই এক’ ইত্যাদি কিছু সত্যি-সঠিক কথা বললেও সুচতুরভাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির জন্ম ও গড়ে ওঠার সর্বজনবিদিত গল্পের অজুহাতে আওয়ামী লীগকে তুলনামূলক ভালো বুর্জোয়া হিসাবে দেখানোটা শুনতে যতই সঠিক মনে হোক না কেন, এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হল-
একইসাথে, ক্ষমতাসীনদের রক্ষা করা আর সংগ্রামমুখী জনতাকে বিভ্রান্ত করা।
আর এই মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণেই আকাশের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের ৯৫% শোষিত-বঞ্চিত মানুষের স্ব স্ব শ্রেণী সংগ্রাম, পেশাজীবীদের সংগ্রাম, অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষের জন্য একটি ‘সম্ভাব্য বিকল্পের’ ভাবনা অস্তিত্বহীন। রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক অংশীদারদের তিনি দুই লুটেরা বুর্জোয়াদের কাছেই বন্ধক রাখতে চান, যা কিনা বিগত অর্ধ-শতাব্দীকাল ধরে চলে আসছে।
শেখ হাসিনাকে , ‘আমেরিকা বিরোধী’ হিসাবে দেখানো, আওয়ামী লীগের জন্য শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে পারাটা তাঁর জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজন এবং সর্বোপরি ‘এমন কোন অভ্যন্তরীণ শক্তি আজ দেখা যাচ্ছে না যেটা বর্তমান আওয়ামী সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে’ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ অবসম্ভ্যাবীরূপে শুধু ক্ষমতাসীন লুটেরা বুর্জোয়াদের আশ্বস্ত করেই থেমে থাকে না। আমূল ব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে একইসাথে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন(পড়ুন সকল) লুটেরা ধনিকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ‘বিপ্লবী’ স্লোগানের আড়ালে ক্ষমতাসীনদেরকে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের লক্ষবস্তু করার প্রয়োজনীয়তাকে বিভ্রান্তির মুখে ফেলে দেয়। এম এম আকাশের এই পর্যবেক্ষণ বাম-আন্দোলনকে সচেতনভাবে বিভ্রান্তির বেড়াজালে বেঁধে রাখার অপকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রকৃতপক্ষে, তুলনামূলকভাবে খারাপ ধনিকদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রোধে তুলনামূলক ভালো লুটেরা ধনিকদের বি-টিমের ভূমিকা নেয়াটা অতীত ভুলেরই নামান্তর মাত্র। এতে আর যাই হোক, একটি নিষ্ঠাবান স্বাধীন বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিচিতি এবং ৯৫% জনগণের প্রকৃত ‘রাজনৈতিক বিকল্প’ হিসাবে সমাজতন্ত্রমুখী বাম রাজনীতির প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। এম এম আকাশের পর্যবেক্ষণের চূড়ান্ত ফলাফল হল, ‘স্বল্পকালীন পেটি-বুর্জোয়া স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে ৯৫% মানুষের দীর্ঘ্যকালীন বিপ্লবী স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া।’
‘পন্থী রাজনীতির’ কূপমণ্ডুকতা
এম এম আকাশের নিরীহ পর্যবেক্ষণে বামপন্থী রাজনীতিতে অতীতের সকল ভ্রান্ত ‘পন্থী রাজনীতির’ প্রবণতা বর্তমানেও মূর্ত হয়ে উঠেছে। তার মতে, ‘চীনপন্থী’ বামেদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশগুলি আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমর্থকে পরিণত হয়েছে। এই বক্তব্যের সত্যতা অনস্বীকার্য। কিন্তু তিনিই আবার দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেছেন, ‘বামপন্থীরাও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে না।’ প্রশ্ন আসে তাহলে, এই বামপন্থীরা কি তাহলে ‘রুশপন্থী’ বাম? তিনি নিজে বর্তমানে কোন ‘পন্থী বামের’ অনুসারী তা খোলাসা করেননি। তবে যতদূর জানা যায়, তিনি নির্ভেজাল ‘রুশপন্থী’ ঐতিহ্যের অনুসারী। তবে, ১৯৯০ সালে রুশপন্থী বামেরা যখন ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ এবং ‘সমাজতন্ত্র’ বর্জন করে বাম আন্দোলনের ইতিহাসে ‘বিলোপবাদী’ হিসাবে চিহ্নিত হন, তখন এম এম আকাশ অবশ্য ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ রক্ষায় বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান বিভ্রান্তিকর। সে কারণেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তিনি কি এখনো সেই পুরানো ‘রুশপন্থী’ ঐতিহ্যকে ধারণ করে, ‘আওয়ামী লীগের’ বি-টিম হিসাবে যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন – তাকেই রক্ষা করতে চান?
এম এম আকাশের এই বিভ্রান্তিকর, পরস্পর বিরোধী, অস্পষ্ট পর্যবেক্ষণ তাই প্রকৃত বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করছে।
কেননা, বাংলাদেশের বাম-আন্দোলনে ৬০-এর দশকে জন্মনেয়া ‘পন্থী রাজনীতির’ বর্তমানে যে কোনো উপযোগিতা নেই তা বিতর্কহীনভাবেই স্বীকৃত। বাংলাদেশের বাম আন্দোলনে ‘পন্থী রাজনীতি’ ভ্রান্তি সকল ‘পন্থীদের’ জন্যই অমূল্য শিক্ষণীয় বিষয়। কিন্তু তাকে শিক্ষার বিষয় হিসাবে না দেখে একপাক্ষিকভাবে তুলে ধরাটা বর্তমান প্রক্ষাপটে বামপন্থীদের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এবং সম্ভাবনাকেই নাকচ করে। আর এটাও বুর্জোয়া দলগুলোর আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ‘পন্থী-রাজনীতিকে’ বাম-শক্তির অনৈক্যের হাতিয়ারে পরিণত করার বদলে – প্রয়োজন ৯৫% মানুষের বুর্জোয়া চৌহদ্দির বাইরে মানুষের প্রকৃত দাবির ভিত্তিতে ‘ইস্যু বা কর্মসূচি ভিত্তিক’, বর্তমান ক্ষমতাসীন ধনিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামকামী বামপন্থী শক্তি সমূহের ঐক্য।
এম এম আকাশের মত বাম তকমাধারীদের কৌশলী বিরোধিতার মুখোশ উন্মোচন করে বাংলাদেশের বাম আন্দোলনকে সেই ঐক্যের পথই নিতে হবে।
এম এম আকাশের পর্যবেক্ষণে ‘আদর্শবাদ’
আকাশের আপাত দৃষ্টিতে আলা-ভোলা পর্যবেক্ষণে ‘রাজনৈতিক আদর্শবাদিতায়’ শীর্ষ স্থান পেয়েছেন ধর্ম ব্যবসায়ীরা। এটা কে না জানে যে, প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপদ রাজনীতির এক সংগঠিত শক্তি হল ধর্মের আবরণে পরিচালিত রাজনীতি। চূড়ান্ত বিচারে এই শক্তি দেশি-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের নির্ভরযোগ্য মিত্র, সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্বপুঁজিবাদ এবং বর্তমান নিওলিবারেল অর্থ ব্যবস্থার ধারক-বাহক। অতীত ও বর্তমানের জিও-পলিটিকাল রাজনীতির পর্যালোচনায় এর ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। ইতিহাসের শিক্ষা হল, সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ‘আদর্শবাদিতা’ টিকে থাকা তো দূরের কথা বরং তার ফ্যাসিস্ট রূপ নিয়ে জনগণের উত্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং ৯৫% জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের অগ্রগতির ধাপে ধাপে পুঁজিবাদের সহযোগী অন্যান্য শক্তির মতোই ক্রমাগত বিলীন হতে থাকে। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ‘বিকল্প’ হবার আদর্শগত ভিত্তি তাদের নেই। সুতরাং ধর্মপন্থীদের এই অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতাকে হালকা করে ‘আদর্শবাদিতার’ সার্টিফিকেট প্রদান এক নির্ভেজাল মূর্খতা।
অন্যদিকে তাঁর মতে, ‘উল্টো দিক থেকে আদর্শবাদী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বামপন্থীদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম। তারা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চায়। সুতরাং তাদের যতই মারা হোক তারা ধনিক শ্রেণীর সঙ্গে থাকবেন না।’ কিন্তু বামপন্থীদের আদর্শবাদিতার প্রতিশ্রুতিগত ভিত্তির ব্যাখ্যাও এখানে অনুপস্থিত। বামপন্থীদের আদর্শবাদিতা অন্যান্য সকল রাজনৈতিক শক্তির আদর্শবাদিতা থেকে মূলগতভাবে পৃথক। কারণ বামপন্থীরা সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে বিশ্বাসী, তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে ৯৫% মানুষের সার্বিক মুক্তির প্রতিশ্রুতিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই আদর্শবাদিতার ব্যাখ্যা উপেক্ষা করে যেনতেন প্রকারে তার টিকে থাকার কথা বলাটা প্রকৃতবিচারে মেহনতি মানুষের ‘বিকল্প শক্তি’ হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলা এবং ক্ষমতা দখলের রাজনীতির ‘নতুন’ দাবিদার হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে আড়াল করার শামিল।
এম এম আকাশ বিস্তর সময় ব্যয় করে ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপির’ ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতায় আসীন হবার নানা সম্ভাবনা ও উপায় বর্ণনা করেছেন, কৌশলী উপদেশ খয়রাত করেছেন। লুটেরা ধনিকদের ক্ষমতার পরিবর্তনে আমেরিকা, চীন, ভারতের ভূমিকার চুলচেরা পর্যবেক্ষণ তিনি তুলে ধরেছেন, অভ্যন্তরীণ শক্তির পক্ষে ক্ষমতাসীনদের কিছুই করতে না পারার সম্ভাবনার দিক নির্দেশ করেছেন কিন্তু দুঃখজনকভাবে যে বামপন্থার ‘শীর্ষ বুদ্ধিজীবীর’ মর্যাদা তিনি এনজয় করেন, সেই বামপন্থার নেতা-কর্মী-সংগঠক এবং বিশেষ করে বামপন্থার একমাত্র লক্ষ্য ৯৫% জনগণের প্রতি এবং চলমান গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তাদের ভূমিকা, করণীয় সম্পর্কে তার কোনো বক্তব্য নেই! এমনকি বর্তমানের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে, যত ক্ষুদ্রই হোক, বাম গণতান্ত্রিক জোটের লুটেরা ধনিকশ্রেণীর বৃত্তের বাইরে একটি স্বাধীন বিকল্প গড়ার প্রচেষ্টার উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তাও তিনি বোধ করেননি।
এম এম আকাশের এই হতাশাব্যঞ্জক, দায়িত্বহীন, পরষ্পরবিরোধী পর্যবেক্ষণের পর বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী মহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে – কোনটি আসল আকাশ? যিনি বুর্জোয়া রাজনীতির নিরীহ পর্যবেক্ষক নাকি ৯৫% মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের বার্তাবাহক শীর্ষ ‘বামপন্থী বুদ্ধিজীবী’?
সে যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনে ঘাপটি মেরে থাকা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, এনজিওর বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতাদের মুখোশ উন্মোচনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মাটিতে বামপন্থা তথা সমাজতন্ত্রমুখী ‘শ্রমজীবী জনতার বিকল্প’ গড়ার সংগ্রাম এগিয়ে যাবে।
লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা, বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী
Discussion about this post