অনেক দিন ধরে আলোচনায় অক্টোবর মাস।
অক্টোবরে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনকে নিয়ে যাবে বিএনপি- এমনটাই পত্রপত্রিকায় খবরে প্রকাশিত হচ্ছে।
মাঝে কিছু দিনের রুটিন কর্মসূচির পর সেপ্টেম্বরে আবার সিরিয়াস কর্মসূচিতে ফিরে এসেছে বিএনপি। সভা-সমাবেশে দলটির পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে অক্টোবরের কথা।
বসে নেই সরকারও। বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি তো আওয়ামী লীগ ঘোষণা করছেই, সঙ্গে সরকারের অন্যান্য পরিকল্পনার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্যান্য দলও। যুগপৎ নাম দিয়ে একই দিনে প্রায় একই ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছে দলগুলো। সবশেষ গত জুলাইয়ে তারা এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে।
কয়েকটি ধাপে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে বিএনপি, এমনটা মনে হলেও বাস্তবে বোঝা যায়নি চূড়ান্ত কর্মসূচি ঠিক কোনটা। বিশেষ করে, গত ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। তবে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করে বেশ কয়েকটি দফার ঘোষণা এবং এমপিদের পত্যাগেই সব উত্তেজনার পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর ২৮ জুলাই নয়াপল্টনে সমাবেশকে কেন্দ্র করেও উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সেদিন এক দফার ঘোষণা দিয়ে ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশ মুখগুলোতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি দেয় বিএনপি। সে দিন পর্যন্ত পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল। মনে হচ্ছিল, চূড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলন শুরু হয়েছে।
তবে এরপর আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচি ছিল সাদামাটা। সর্বশেষ ১৮ সেপ্টেম্বর একগুচ্ছ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি, যা চলবে ১২ দিন। এরপরই শুরু হবে আলোচিত অক্টোবর মাস। এই মাসে কী ধরনের কর্মসূচি তারা দেবে এখন পর্যন্ত বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়ে যাবে। অতএব, সেই সময়ে তাদের আন্দোলনের গতি অর্জন করা কঠিন হবে। সুতরাং তার আগেই নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি মেনে নিতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে এবং জানুয়ারির শুরুতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ২৪তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়ও একই হিসাব পাওয়া যায়। সেদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, অক্টোবরের অধিবেশনই শেষ অধিবেশন। এরপরই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচনে জনগণ ভোট দিলে এদিকে (সরকারি দলে) থাকবেন, না দিলে ওদিকে (বিরোধী দলে) যাবেন। কোনো অসুবিধা নাই। জনগণের ওপর তারা সব ছেড়ে দিচ্ছেন। জনগণ যেটা করবে। সেটাই তিনি মেনে নেবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কেউ জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে। গণতান্ত্রিক ধারাটা যেন ব্যাহত করতে না পারে। কোনো চক্রান্তের কাছে বাংলাদেশের জনগণ আর মাথানত করবে না। সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে যখন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এ অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে। বিশ্বব্যাপী বাঙালি যে মর্যাদা পেয়েছে সেই মর্যাদা অব্যাহত রেখে আমরা এগিয়ে যাব। আবার দেখা হবে।’
অক্টোবরের কোন দিন সংসদ অধিবেশন শুরু হয়ে কতদিন চলবে তা জানা যায়নি। এ ছাড়া অক্টোবরে রয়েছে দুর্গা পূজা। যা চলবে ১৪-২৪ অক্টোবর পর্যন্ত। এ সময়ের আগে থেকেই দুর্গাপূজার আয়োজন ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার নজরে থাকবে। আগের কোনো কোনো বছরের মতো এ সময়ে তাদের কেউ আক্রান্ত হলে বা পূজা আয়োজনে বিঘ্ন ঘটলে পরিস্থিতি সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের জন্য সংকটজনক হতে পারে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পলাশী মোড়ে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রা ও মিছিল উদ্বোধনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে একটি বছর কুমিল্লাসহ ২৫টি জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছিল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় হিন্দু ভাই-বোনেরা কিন্তু নিরাপদে আছেন। তবে সময় খারাপ। এবার ভয় পাচ্ছি। এবার অশুভ শক্তি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ (বাংলানিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম)
এ ছাড়া অক্টোবরে অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করবে সরকার। মেট্টোরেলের আগারগাঁও-মতিঝিল অংশ, কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেলে একাংশ, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটি করে উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারিত আছে। স্বাভাবিকভাবে এসব উদ্বোধন ঘিরে দেশের সব সংবাদমাধ্যম ব্যস্ত থাকবে। উদ্বোধনের আগে-পরে বিভিন্ন খবরের আড়ালে বিএনপির কর্মসূচি চাপা পড়ে যাওয়াও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগেরও সমান্তরাল কর্মসূচি থাকবে।
এ সময় বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করা হতে পারে, যাতে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন।
নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে বিএনপির কিছু নেতাকে নির্বাচনে অংশ নিতে প্ররোচিত করতে পারে সরকার।
ইতিমধ্যে বিএনপির দলচ্যুত নেতারা তৃণমূল বিএনপিতে গিয়ে ভিড়তে শুরু করেছেন। মঙ্গলবার তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন শমসের মুবিন চৌধুরী এবং মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। তারা দুজনই একসময় বিএনপির ডাকসাইটে মন্ত্রী, নেতা ছিলেন। এ ছাড়া তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মেয়ে অ্যাডভোকেট অন্তরা সেলিমা হুদা দলের নির্বাহী চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। নাজমুল হুদা বিএনপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কারাগার এড়াতে বিদেশে রয়েছেন। আমানউল্লা আমান ইতিমধ্যে কারান্তরীণ। বিভিন্ন পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, দ্রুত রাজনৈতিক মামলা নিষ্পত্তির দিকে আগাচ্ছে সরকার। লক্ষ্য সম্ভবত, নির্বাচনের আগেই বিএনপির সব গুরুত্বপূর্ণ নেতার বন্দিত্ব। গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কারাগারে পাঠিয়ে মধ্যম পর্যায়ের নেতাদের নানা টোপ দেওয়া হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। উদ্দেশ্য, তাদের ভাগিয়ে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও বিএসপির মতো দলগুলোতে ভাগিয়ে দেওয়া এবং এ দলগুলোতে নির্বাচনে নিয়ে আসা। এটা করে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করা সম্ভব হবে, নির্বাচনকেও অংশগ্রহণমূলক দেখানো যাবে।
গত ৩০ আগস্ট গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাতেও আওয়ামী লীগের কৌশলের এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী ওই দিন বলেছিলেন, ‘অংশগ্রহণ বলতে কাদের অংশগ্রহণ? আমার কাছে অংশগ্রহণ হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ। জনগণ ভোট দিতে পারলে, সেই ভোটে যারা জয়ী হবে, তারা সরকারে আসবে।’
ভোটার উপস্থিতির প্রস্তুতিও রয়েছে আওয়ামী লীগের। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয় , আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের চিন্তায় এ–ও রয়েছে যে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা জাতীয় নির্বাচন প্রতিরোধ করতে পারে। আর তা মোকাবিলা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে। ভোটের আগেই বিএনপির অনেক নেতার সাজা হবে, গ্রেপ্তার হবেন। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে না বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, ‘বিএনপি ভোটে আসবে কি আসবে না—এটা তাদের ব্যাপার। তবে আমরা পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছি। প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে আমরা ভোটারদের প্রয়োজনে হাতে–পায়ে ধরে কেন্দ্রে নিয়ে আসব। প্রত্যেক ভোটারের মুখোমুখি হয়ে সরকারের অর্জন তুলে ধরব।’
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোট আছে, এর সঙ্গে আছে নানান সুফলভোগী। তাদের ঠিকমতো বোঝাতে পারলে কেন্দ্রে আসবেন। সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনে এর প্রমাণ মিলেছে।
এই পরিস্থিতিতে তীব্র আন্দোলনের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, চলমান আন্দোলনের তীব্রতা আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়বে। একটি বিষয় নিশ্চিত যে, এবার কোনো একতরফা নির্বাচন হবে না।
এখন দেখার বিষয়, সরকারের এই পূর্ণ প্রস্তুতির বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো ম্যাজিক দেখাতে পারে কি না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিকে এবার প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামতে হবে। ১০ ডিসেম্বর, ২৮ জুলাইয়ের পর অক্টোবরে তারা একই প্রক্রিয়ায় আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে সত্য, কিন্তু গত দুইবারের মতো ফল ছাড়া ঘরে ফিরলে তা সরকারকেই শক্তিশালী করবে। সরকার নিশ্চিন্তে বিএনপিকে ছাড়াই এক তরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যাবে। ফলে, বিএনপিসহ সরকার-বিরোধী আন্দোলনের শক্তিকে তার কর্মসূচি ও কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। আর সেটি হলে, সরকার ও বিরোধীরা মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসতে পারে। তাতে কিছুটা সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে রাজনীতি।
Discussion about this post