কয়েক সপ্তাহ ধরেই ভারত-কানাডা সম্পর্কে টানাপোড়েনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে তোলপাড় চলছিল হয়তো; কিন্তু প্রকাশ্যে এলো কানাডা সরকার কর্তৃক ভারতীয় কূটনীতিক বহিষ্কারের পর। খলিস্তানপন্থী আন্দোলনের নেতা হারদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ পেয়েছে বলে জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। এ হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে বহিষ্কার করা হয়েছে কূটনীতিকের ছদ্মবেশে কানাডায় ভারতীয় দূতাবাসের গোয়েন্দা প্রধানকে।
রাষ্ট্রীয় মদদে কোনো দেশের নাগরিককে হত্যা সেই দেশের সার্বভৌমত্ব ওপর আঘাত হিসেবে দেখা হয়। এ ঘটনায় জল যে অনেকদূর গড়াবে তাতে সন্দেহ নেই। কানডাও বেশ আটঘাঁট বেধেই মাঠে নেমেছে তা বোঝা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। যদিও ভারত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এক কানাডীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
হারদীপ সিং হত্যাকাণ্ড
ঘটনার নেপথ্যে একটি হত্যাকাণ্ড। জুন মাসের ১৮ তারিখ কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের সারে শহরে একটি শিখ মন্দিরের বাইরে খালিস্তানপন্থী আন্দোলনের নেতা হারদীপ সিং নিজ্জারকে গুলি করে হত্যা করে দুজন মুখোশধারী। ওই হত্যাকাণ্ডের পর কানাডায় বসবাসরত ভারতীয় শিখ সম্প্রদায় বিশেষ করে খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থনকারীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা বিক্ষোভ করে, এমনকি ভারতীয় কনস্যুলেটে হামলার ঘটনাও ঘটে। কয়েকজন ভারতীয় কূটনীতিককে হুমকিও দেয়া হয় বলে অভিযোগ।
তাৎক্ষণিকভাবে কানাডার পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের দায়ে কাউকে গ্রেফতার করতে না পারলেও তদন্ত করতে গিয়ে ‘কেঁচো খুড়তে সাপ’ পাওয়ার দাবি করে তারা। তাদের অভিযোগ, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে ভারতের সংযোগ রয়েছে এমন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা পেয়েছে। স্থানীয় সময় সোমবার কানাডার পার্লামেন্টে বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। সেই সাথে জানান ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত কর্মকর্তাকে বহিষ্কারের কথা। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি জানিয়েছেন, ওই শীর্ষ কূটনীতিক কানাডায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ছিলেন।
দূতাবাসে কূটনীতিকের ছদ্মবেশে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাজ করার ঘটনা একটি ওপেন সিক্রেট। বিশ্বের প্রায় সব দূতাবাসেই এমন গুপ্তচর থাকেন। তারা সংশ্লিষ্ট দেশে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজ করেন। স্বাগতিক দেশ বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে। তারা ঠিকই জানে কে গোয়েন্দা, আর কে কূটনীতিক। সাধারণত সম্পর্ক খারাপ হলে বহিষ্কারের সময় বেছে বেছে গোয়েন্দাদের বহিষ্কার করা হয়। তবে কানাডা এবার যেভাবে সরাসরি বহিষ্কৃত কূটনীতিককে গোয়েন্দা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে এমনটা সাধারণত দেখা যায় না।
ভারত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তারাও আগামী ৫ দিনের মধ্যে এক কানাডীয় কূটনীতিককে ভারত ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছে।
খালিস্তান আন্দোলন
১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে ভারতে খালিস্তান আন্দোলন বেশ রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছিলো। তবে ভারত সরকার পরে তা দমন করতে সমর্থ হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়া পাঞ্জাব প্রদেশে শিখদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে শুরু হয়েছিল ওই আন্দোলন। এক পর্যায়ে তা সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়। তবে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিশেষ অভিযানের পর তা দমে গেলেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খলিস্তানপন্থী শিখ গ্রুপগুলো রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় রয়েছে।
নিহত হারদীপ সিংকে খালিস্তানপন্থী আন্দোলনের একজন হিসেবে সাব্যস্ত করে ২০২০ সালে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে ভারত। তাকে খালিস্তানি টাইগার ফোর্স নামে একটি বাহিনীর মাস্টারমাইন্ড মনে করা হয়। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় ছিলেন হারদীপ। বিভিন্ন সময় তার প্রাণনাশের হুমকির বিষয়ে হারদীপকে কানাডার নিরাপত্তা বাহিনী সতর্ক করেছে বলেও জানা যায়। হত্যাকাণ্ডের দিন দু’জন মুখোশধারী তাকে ট্রাকে বসা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। এরপর কানাডার পুলিশের বিশেষ একটি শাখা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত শুরু করে। সেটা করতে গিয়েই তারা ভারতের ‘সংযোগ’ আবিষ্কার করে।
এরপরই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। কয়েক সপ্তাহ আগে কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী ভারতে একটি বাণিজ্য মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিতের কথা জানান। দুই দেশের মধ্যে প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও আলোচনা থেমে যায়। ওদিকে, কানাডায় ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনে একাধিক হামলার ঘটনায় নরেন্দ্র মোদি সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানানো হলেও অটোয়া কার্যকর কিছু করেনি। যা ক্ষুব্ধ করে নয়া দিল্লিকে। ভারতের অভিযোগ, কানাডা পরোক্ষভাবে শিখ বিক্ষোভকারীদের মদদ দিচ্ছে। যদিও কানাডা বলছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করার অধিকার রয়েছে নাগরিকদের।
পর্দার আড়ালে দৌড়ঝাঁপ
গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই কানাডার সাথে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন টের পাওয়া যাচ্ছিল। জি-২০ সম্মেলনের সময় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো হত্যাকাণ্ডের সাথে ভারতের ‘সংযোগের’ বিষয়টি মোদির সামনে তুলেছিলেন। যদিও তখন তা প্রকাশ্যে আসেনি। এরপর বিমানে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে ট্রুডো নির্ধারিত শিডিউলের চেয়ে বেশি কয়েকদিন ভারতে থাকলেও তাকে যথাযথ আতিথিয়েতা দেয়া হয়নি, এমন অভিযোগও উঠেছে। নরেন্দ্র মোদি এমনকি জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও মিলিত হতে চাননি।
১২ সেপ্টেম্বর ট্রুডো ভারত ত্যাগ করেন। তবে তার সাথে কানাডায় ফিরে যাননি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোডি থমাস। শোনা যায়, খুব নিরবে তিনি ভারত থেকেই ব্রিটেন যান। থমাস ব্রিটিশ সরকারকে হারদীপ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারতের সাথে টানাপোড়েনের বিষয়ে ব্রিফ করেন। তিনি সেখানে তুলে ধরেন এই হত্যাকাণ্ডে ভারত সরকারের সংযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে ভারত সফরের সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তিনি ব্যক্তিতগভাবে সরাসরি এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কানাডার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একজন কানাডীয় নাগরিকের হত্যাকাণ্ডের সাথে কোন বিদেশী সরকারের যুক্ত থাকা গ্রহণযোগ্য নয়, এটি আমাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।
এছাড়া ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ মিত্র দেশগুলোর সাথেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে ট্রুডো সরকার।
কানাডায় বিশাল ভারতীয় অভিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস। যাদের সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি। এই জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শিখ সম্প্রদায়ের। পাঞ্জাবের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ ধর্মাবলম্বীদের বসবাস কানাডাতেই। কানাডার রাজনীতিতেও তাদের বড় প্রভাব রয়েছে। যে কারণে এই দুই দেশের সম্পর্কে বরাবরই গুরুত্ব পেয়েছে শিখরা।
কানাডায় শিখদের কট্টরপন্থা নিয়ে ভারত সরকার বরাবরই উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। ১৯৮৪ সালে শিখ দেহরক্ষীদের হাতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হয়েছিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে গত জুন মাসে কানাডার খলিস্তানপন্থী শিখরা একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। নরেন্দ্র মোদি নিজেও কানাডার কাছে খলিস্তানপন্থীদের নিয়ে নয়া দিল্লির উদ্বেগের কথা তুলেছেন।
২০১৮ সালে জাস্টিন ট্রুডো ভারতকে আশ্বস্ত করেছিলেন কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাকে প্রশ্রয় দেবেন না বলে। তবে তিনি বারবারই বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কানাডা সব সময় সম্মান করে। যদিও এতেও ভারতের আপত্তি ছিল। কারণ ভারত মনে করে, কূটনৈতিক মিশনগুলোতে হামলার ঘটনা বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি কানাডা।
আন্তর্জাতিক চাপে ভারত
এবারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বোমা ফাটানোর আগে কানাডা বেশ ভালোভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছে বোঝা যায়। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের সূত্রে জানা যায়, কানাডার রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম সিবিসি নিউজ সরকারি এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ঘটনা প্রকাশ করার আগে কয়েকটি ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশের রাষ্ট্রনেতাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন জাস্টিন ট্রুডো। তার মধ্যে আছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
কানাডার জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ডমিনি লেব্ল্যাঙ্ক বলেছেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান গত কয়েক সপ্তাহে এই ইস্যুতে ভারত সফর করেছেন একাধিকবার। তারা বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেছেন।
এছাড়া কানাডার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোডি থমাস নিজেই নিরবে ব্রিটেন সফর করেছে জি-২০ সম্মেলন শেষে। নিউ ইয়র্কে চলমান জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর কাছেও বিষয়টি তুলে ধরবে কানাডা। অর্থাৎ ভারতের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশনে’ যাওয়ার আগে জাস্টিন ট্রুডো সরকার যে প্রচুর ‘হোমওয়ার্ক’ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আটঘাঁট বেধেই তারা মাঠে নেমেছে এই ইস্যুতে।
এসবের প্রমাণ পাওয়া যায়, ঘটনা প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বিবৃতিতে। দেশগুলো এই হত্যাকাণ্ডে ভারতের যুক্ত থাকার ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র আড্রিয়েন ওয়াটসন সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো যে অভিযোগ তুলেছেন সে বিষয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বিষয়টি নিয়ে আমরা কানাডার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছি। কানাডার তদন্ত এগিয়ে চলা এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং-এর একজন মুখপাত্র বলেছেন, এ বিষয়ে ক্যানবেরা তার উদ্বেগের কথা নয়া দিল্লিকে জানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া মনে করে সব দেশের উচিত সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা এবং আইন মেনে চলা।
গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বিষয়ক ৫ দেশের জোট ‘ফাইভ আই’স’ এর সদস্য কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। কাজেই এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারত হয়তো বড় ধরনের আন্তর্জাতিক চাপে পড়তে চলেছে আগামী দিনে। নয়া দিল্লি কীভাবে সেই চাপ সামলাবে সেটির ওপর নির্ভর করতে পারে তাদের সাথে পশ্চিমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যত।
Discussion about this post