গত ২৮ অক্টোবর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপির মহাসমাবেশ ভণ্ডুল করে দেওয়ার পর থেকে দলটি ধারাবাহিকভাবে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে, তাদের হরতাল-অবরোধ অনেকাংশে সফল হচ্ছে। মানুষ রাস্তায় নেমে তাদের কর্মসূচিতে যোগ কম দিলেও মন থেকে বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন যে চায়, তা হরতাল-অবরোধে তাদের সমর্থন প্রমাণ করে। তবে এভাবে হরতাল-অবরোধ কতদিন চালিয়ে নেওয়া যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রায় বিশ দিন ধরে অবরোধ ও হরতাল পালন করছে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো। এটা সামনে অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হয়। বিকল্প কর্মসূচিও খুব বেশি নেই বলে সাধারণ বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে। যদিও বিএনপি এবং তার সহযোগীরা অসহযোগ, ঘেরাও কর্মসূচি দেবে বলে জানাচ্ছে। কবে-কখন দেবে তা অবশ্য জানা যাচ্ছে না।
মহাসমাবেশ ভণ্ডুল করে দেওয়ার পর বিএনপির সব নেতাকর্মী কারান্তরীণ বা পলাতক। কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই ঘরে থাকতে পারছেন না। বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরতে গিয়ে পুলিশ সাধারণ মানুষকেও হয়রানি করছে। যা একটি নিত্য ঘটনা। যদিও এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি নেই খুব একটা। বুদ্ধিজীবীরাও তেমন কিছু বলছেন না। বিরোধী দলীয় ব্যাপকহারে নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করতে গেলে সাধারণ মানুষের হয়রানি হবেই। এটা এড়ানোর একমাত্র উপায়, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের যথেচ্ছ গ্রেপ্তার না করা। যদিও বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী সরকারি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন থেকে কবে বের হবে আর কবে নিরীহ মানুষ এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে, তার ঠিক নেই।
এসব দুরাবস্থা থেকে বের হওয়ার আপাত পথ হচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করা। প্রাথমিক এ কাজ না সারতে পারলে জনগণের স্বার্থের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দিকে আগানো যাবে না।
আলী রীয়াজ বলেছেন, অর্থনৈতিক সংকট হঠাৎ তৈরি হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সরকার তৈরি করেছে, তারই অনিবার্য পরিণতি আজকের অর্থনৈতিক সংকট। শাসনের যে অবস্থা, কারও জবাবদিহিতা নেই। যারা শক্তি প্রয়োগ করতে পারে, তাদেরকে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সবাই ধরে নিয়েছে, আগামী নির্বাচনে বর্তমান সরকারের আবার ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত। সরকার সহিংসতাকে উৎসাহিত করেছে। বিরোধীরা গত দেড় বছর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছে। (সরকার সমর্থকরা) একে ক্রমাগত তামাশা করেছে। এখন সহিংসতাকে কী আন্দোলন বলবেন? ক্ষমতাসীনেরা ধরেই নিয়েছে, দমনের মধ্য দিয়েই অব্যাহত শাসন বজায় রাখবেন।
সরকারের উদ্দেশ্যে আলী রীয়াজ বলেছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হওয়ার একটাই পথ। সবাইকে ভোট দিতে দিন। অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা ছাড়া অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি হবে না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি হবে না। অর্থনৈতিক সংকটকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারবেন না। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাই সংকট থেকে বের হওয়ার পথ। (সমকাল)
তার কথার সঙ্গে আমিও একমত। আমাদের আগাতে হবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে। যেখানে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। তবে এ কথা সত্য যে, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু ভোট হবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে সম্ভব সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা। আর এ দাবিতেই বিএনপিসহ বিভিন্ন দল আন্দোলনে আছে। নাগরিক সমাজের কিছু সদস্যও এ দাবিতে কথা বলছেন এবং কর্মসূচি পালন করছেন। তারা আলাদাভাবে কর্মসূচি দিলেও এ রাজনৈতিক সত্য অস্বীকারের উপায় নেই যে, সবকিছুর কেন্দ্রে আছে বিএনপি। তাদের ব্যর্থতায় এ আন্দোলন ব্যর্থ হবে, তারা সফল হলে সবাই সফল হবে।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি মহাসমাবেশের পর বিশ দিনের অধিক সময় যেভাবে রাজপথ ছেড়ে দিয়ে রেখেছে, তাতে আন্দোলন সফল হওয়ার সুযোগ কম। আন্দোলনে জিততে হলে অবশ্যই বিএনপিকে রাজপথে ফিরতে হবে বিপুল জমায়েত নিয়ে। দিনের পর দিন মিছিল করে যেতে হবে। পুলিশের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে দাঁড়াতে হবে। কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করলেই যদি বিএনপিকে কাবু করে ফেলা যায়, তাহলে এতবড় আন্দোলনে তাদের নামারই প্রয়োজন ছিল না।
কথা হলো, রাজপথে নামলেই কি ফয়সালা হবে? এর উত্তর হলো, রাজনীতির স্বার্থে ও দেশের স্বার্থে বিএনপিকে রাজপথে ফিরতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বা বাইরের বিশ্ব বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করুক বা করতে না পারুক, রাজনীতিকে মাঠেই থাকতে হবে। না হলে অরাজনৈতিক শক্তির হাতে দেশ চলে যাবে। রাজনীতিবিদদের কথা কেউ শুনবে না, বিএনপির কথা কেউ শুনবে না। বিএনপিকে কাউন্ট করবে না। আর যদি আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থেকে যায়, তাহলে বিএনপি দাঁড়ানোর জায়গা কোথাও পাবে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় বলতে পারি, যত দ্রুত সম্ভব ধীরে ধীরে রাজপথে ফিরে আসার দিকে বিএনপি নজর দেবে, এটাই কাম্য। এতে করে রাজনৈতিক উত্তাপ বিরাজ করবে দেশে। সরকারের পক্ষে একের পর এক ক্র্যাকডাউন চালানো সম্ভব হবে না।
যদি রাজপথে গণ্ডগোল থাকে, তখন বিদেশি শক্তিও একে কেন্দ্র করে তাদের কূটনৈতিক উদ্যোগ নেবে। কিন্তু রাজপথ ঠাণ্ডা থাকলে বিদেশিরা তাদের মওকা মতো বিধিনিষেধ আরোপের সুযোগ পাবে। তাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে দেশের। তখন হয়তো আমরা ভোটাধিকার ফিরে পাবো, বিএনপিও হয়তো ক্ষমতায় চলে আসবে; কিন্তু পরিস্থিতি সুখকর হবে না কারো জন্য। যে কারণে বিএনপিকে শিগগিরই তাদের অফিসে ফিরতে হবে, রাজপথে ফিরতে হবে।
আরেকটি প্রশ্ন সাংবাদিক সাহেদ আলম তার ফেসবুক ভিডিওতে উল্লেখ করেছেন। এটিকেও আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সেটি হলো, দলটির নেতা তারেক রহমানের ভোকাল হওয়া। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে সরকার যে অমানবিকতা দেখিয়েছে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তাকে কথা বলতে দেখা যায়নি। রাজপথেও থাকবে না, দেশি সংবাদমাধ্যমেও তাদের নিয়ে বিরূপ সংবাদ প্রকাশ হবে আবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও যদি বিএনপি নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে এ আন্দোলনে কামিয়াব হওয়া অসম্ভব বলে মনে করছি।
Discussion about this post