আবারো সংলাপ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে জোরেশোরে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ নিয়ে কথা বলছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের ঢাকা সফরের আগে ও পরে সংলাপ নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে। গত সোমবার প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সনে সংলাপকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিও সংলাপ নিয়ে কথা বলছে।
সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান এসেছে এমন নজির নেই। তারপরও একটি পক্ষ সবসময় মনে করে সংলাপ সংকট থেকে উত্তরণের সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। পশ্চিমা দেশগুলোও সংলাপকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ তাদের দেশের রাজনীতিতে সংঘাত-সংঘর্ষের পরিবর্তে সংলাপের সংস্কৃতিই বহমান। অপরদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সংঘাত, প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি নিয়মিত ঘটনা আমাদের দেশে। এসব এড়িয়ে যদি সংলাপের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসা যায়, সে প্রত্যাশা সংলাপ আহ্বানকারীদের ভাবনায় প্রভাবক ভূমিকা রাখে।
সংলাপের ক্ষেত্রে বিবদমান দু’পক্ষ ছাড় দেবে এবং পরস্পরের স্বার্থরক্ষা করে এমন একটা সমাধানে আসবে বলে ভাবা হয়। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমন সংলাপ কখনো হয়নি। বিভিন্ন সময় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সংলাপে বসলেও তাতে শুধু কালক্ষেপণই হয়েছে। কারণ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ছাড় দেওয়ার মানসিকতার অভাব রয়েছে। আর এক্ষেত্রে বেশি ছাড় দিতে হয় ক্ষমতাসীনদের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে ১৫ বছর ধরে। এবার যদি ছাড় দিতে হয় তাহলে ছাড় দিতে হবে তাদের। বিএনপি বা বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার বেশি কিছু নেই। ইতিবাচক মনোভাবটা সরকারকেই দেখাতে হবে।
সংলাপে বসার আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হতে পারে একটা ভাল পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপের পর বিএনপি সংলাপের আহবান ফেলতে পারবে না। রাজনীতি সচেতন মহলও একে গুড জেশ্চার হিসেবে দেখবে।
বিএনপি গত এক বছরের বেশি সময় ধরে টানা সরকারবিরোধী কর্মসূচি পালন করে আসছে। তাদের আন্দোলনের অন্যতম দাবি খালেদা জিয়ার মুক্তি। বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থাও আগের চেয়ে অনেকটা খারাপ হয়েছে। দীর্ঘদিন তিনি হাসপাতালে ভর্তি। কয়েকদিন পরপরই তাকে সিসিইউতে নিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় তার মুক্তির দাবি বিএনপিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এ অবস্থায় সংলাপের শর্ত হিসেবে বিএনপিও উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর দাবি তুলতে পারে।
সংলাপে কোনো ফলাফল আসার সম্ভাবনা অবশ্য নেই। ফল পাওয়ার আলামতও নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিএনপি প্রকাশ্যে সংলাপে বসলে সরকার মিডিয়ার মাধ্যমে এর পূর্ণ ফায়দা আদায় করে ছাড়বে। কিন্তু বিএনপি কিছু পাবে না। শুধু শুধু সময়ক্ষেপণ হবে।
খালেদা জিয়া ছাড়াও দলটির অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার রয়েছেন, তাদের নামে মামলা আছে। অনেক মামলা ‘গায়েবী’। গত কয়েকমাসে বিভিন্ন মামলায় বিএনপি নেতাদের সাজা ভোগের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এ অবস্থায় বিএনপি কতটা স্বচ্ছন্দে সংলাপে বসতে পারবে সে প্রশ্ন রয়েছে। তাই শর্তমুক্ত হয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে সংলাপে বসার অবস্থা নেই।
যদিও সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন শর্ত ছাড়াই সংলাপে বসতে তারা রাজি। মাঝে মাঝে অবশ্য তারা এও বলেছেন যে, কার সঙ্গে সংলাপে বসবেন? যারা ‘অগ্নিসন্ত্রাস’ করে, ‘ভোট ডাকাতি’ করে তাদের সঙ্গে কীসের সংলাপ! এখন পরিস্থিতির কারণে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংলাপে বসতে রাজি হলেও শর্ত দিচ্ছে শর্তহীন থাকার।
সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপে বসার পরিবেশ তৈরির একটা সুযোগ কয়েকদিন আগেই চলে গেছে। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারত। কিন্তু তারা সেটা করেনি। সরকারের মন্ত্রীরা তখন বলেছিলেন, আইনে সে সুযোগ নেই। তবে দেশের কয়েকজন আইনবিদ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সরকারের এ বক্তব্য ঠিক নয় বলে জানান। তারা খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতিও দেন।
যদি আওয়ামী লীগ সরকার তখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিত, তাহলে সংলাপে বসার একটা ক্ষেত্র আগে থেকেই তৈরি থাকত। সেই পরিবেশ তৈরিতে সরকারের আন্তরিকতা দেখা যায়নি। এখন নতুন করে তেমন একটা পরিস্থিতি তৈরির জন্য সময়ও কম। কারণ বারবার বলা হচ্ছে, নভেম্বরের শুরুতে তফশিল ঘোষণা করা হবে। সে হিসেবে সংলাপে বসার পর্যাপ্ত সময় হাতে নেই। তফশিল ঘোষণার এই তোড়জোড়ের মধ্যে সংলাপের আহ্বানে বিরোধীরা কেন সায় দেবে?
সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা কথায়-বক্তৃতায় বিরামহীনভাবে বিএনপিকে ঘায়েল করে আসছেন। তাদের কথায় নমনীয়তা নেই। বিরোধীদের আশ্বস্ত করার আহ্বান নেই। সংলাপের ইচ্ছা যদি সরকারের থাকত তাহলে তাদের কাথাবার্তায় তার আভাস পাওয়া যেত। তারা সুর নরম করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ইঙ্গিত দিতে পারতেন। সেসব কিছুই যখন নেই, তখন সংলাপ থেকে সফলতা আসার সুযোগও নেই বললেই চলে।
এজন্যই সংলাপ আহ্বানকারী পক্ষগুলো থেকে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা প্রয়োজন। তারা যদি সংলাপ বিষয়ে আন্তরিক থাকে, তাহলে তাদের বলা প্রয়োজন সংলাপের পরিবেশ তৈরির প্রধান দায়িত্ব সরকারের। বিএনপি বা বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু করার নেই। তারা কোনো সহিংস কর্মসূচি দিচ্ছে না। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছে। তাদের দিক থেকে এ বার্তাই সংলাপে বসার জন্য যথেষ্ট। সরকার উল্টো একই দিনে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে রেখেছে। বিরোধীদের কর্মসূচিতে নিয়মিত হামলা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে সংলাপের পক্ষের শক্তিগুলোকেও। নইলে সংলাপ থেকে ফল বের করা দূরে থাক, সংলাপে বসার পরিবেশও তৈরি হবে না।
Discussion about this post