আগুনে পুড়েছে বঙ্গবাজার, পুড়েছে নিউ মার্কেট; মোহাম্মাদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন তো লাগতেই পারে। এ আর এমন কী!
সংবাদপত্রে বড় বড় শিরোনামে নিউজ ছেপে কী হবে, ফেসবুকে দুঃখ জানিয়েই বা কী হবে? আগুন তো লাগতেই পারে!
আপনার শক্তি দুর্বল, আপনি প্রতিবাদ করতে অক্ষম। আপনার ভোটাধিকার পাড়ার সবল বড় ভাই জোর করে হরণ করতেই পারে, সিলটা অন্য প্রতীকে মেরে দিতেই পারে, এ আর এমনকী!
আপনার যে কোনো ধরনের মৌলিক অধিকার যে কেউ হরণ করতেই পারে, এ আর এমনকী!
মানুষের অসহায়ত্বের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে তার রুটি-রুজিতে। ছড়িয়ে পড়ছে নিত্যপণ্যের বাজারে। আগুন লাগছে সংসারে। আগুনে পুড়ছে কর্মজীবী মানুষের পকেট। আর আমরা কায়মনে বলে চলেছি, আগুন তো লাগতেই পারে—এ আর এমন কী!
কৃষি মার্কেটের আগে এই নগরীতে শত শত বস্তি, টিনশেডের ঐতিহ্যবাহী বাজার থেকে শুরু করে আগুনে পুড়েছে বহুতল ভবন। জীবন্ত মানুষ বহুতল ভবন থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছে বাঁচার আশায়। কিন্তু এই মানুষটাও হয়তবা কোনো দিন কারণ খুঁজতে যায়নি এই নগরীতে এতো আগুন লাগে কেন? কেন মানুষের কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে যায় মুহূর্তে। মানুষ কেন বারবার একই সুরে দোষারোপ করে রাষ্ট্রীয় অগ্নিনির্বাপক সংস্থা ফায়ার সার্ভিসকে। এর কোনো কারণ আমরা কখনওই জানতে পারি না। আমরা জানি যে, আগুনটি শর্টসার্কিট কিংবা মশার কয়েল থেকে লাগতে পারে। এজন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন হয়েছে বলেই আমাদের জানাশোনা সীমাবদ্ধ থাকে। পরে আরও একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটলে আমরা মনে মনে ধরেই নিই, আগুন তো লাগতেই পারে। কিন্তু একটাবারও আমরা প্রশ্ন তুলি না, এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো কী শুধু চিঠিতেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারে তার দায়িত্ব?
কৃষি মার্কেটের আগুনের পর কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। আর তার সেই বক্তব্য বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে দৈনিক ইত্তেফাক। হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের এই মার্কেটগুলো কাঁচা মানের অটোমেটিক গড়ে ওঠা মার্কেট। এগুলো পরিকল্পিত মার্কেট না, সেটা সবাই জানি। অনেক আধুনিক মার্কেটেও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে না। সিটি করপোরেশনের যে মার্কেটগুলো ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যে মার্কেটগুলো পাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, সেই মার্কেটগুলোই আগুনে জ্বলছে। এর আগে বঙ্গমার্কেটসহ অন্যান্য মার্কেট দেখলাম, এবার দেখলাম কৃষি মার্কেট।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে হেলাল উদ্দিন প্রশ্ন তোলেন, ‘আগুন লাগলেই সিটি করপোরেশন একটা তদন্ত কমিটি করে। ফায়ার সার্ভিস তদন্ত শেষে বলে দেয়, শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। সব মার্কেটের বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে আমরা বের হয়ে যাই। সেখানে আবার শর্টসার্কিট থেকে কীভাবে আগুন লাগে?’ হয়ত হেলাল উদ্দিনের এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে না সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। কিন্তু প্রশ্নটা জারি থাকতে হবে।
কয়দিন পরপরই শোনা যায় বাজারে আবার আগুন লেগেছে। এক ধাক্কায় কোনো কোনো পণ্যের দাম কয়েকগুণ পর্যন্ত হয়ে যায়। যে কাঁচা মরিচের দাম বছরে পর বছর ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে, সেই মরিচের দাম এক রাতেই হাজার টাকা ছুঁইছুঁই হয়ে যায়। আমরা নির্বিকার তখনো ভাবতে থাকি, বাজারে আগুন লাগতেই পারে! আমাদের পঁচাগলা সিস্টেম আর ভালো হওয়ার না! এই অসহায় আচরণের সুযোগ নিচ্ছে, অসাধু সিন্ডিকেট। তারাও এক রাতেই তাদের ১০ কোটিকে ২০ কোটিতে পরিণত করার অবাধ সুযোগ পাচ্ছে। এই অসহায়ত্ব চেপে বসেছে মন্ত্রীর ওপরও। আর তাই তো কত নির্বিকারভাবেই না বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলতে পারেন, ‘সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া কঠিন।’ এ অবস্থায় সাধারণ জনগণের মনে উদয় হতেই পারে; বাজারে আগুন লাগতেই পারে, এ আর এমনকী! তবে বাণিজ্যমন্ত্রীর ওই উক্তি নিয়ে বেশ উত্তপ্ত ছিল একাদশ জাতীয় সংসদের ২৪তম অধিবেশন। গত বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কঠোর সমালোচনা করেন বিরোধী দলের সদস্যরা। যার সূত্রপাত হয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী বাণিজ্য সংগঠন (সংশোধন) বিল উত্থাপনের পর। বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, ‘দেশে আলু পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত থাকার পরও দাম বেড়ে গেছে। কারণ একটাই, সিন্ডিকেট। বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী মানুষ, তিনি ব্যবসাটা ভালোই বোঝেন। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বহুবার সিন্ডিকেটের কথা অস্বীকার করেছিলেন। মানুষ যখন বলতে শুরু করেছিল বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের হোতা, তখন সত্য কথা বলতে (তিনি) শুরু করলেন যে সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না।’ মোকাব্বির খান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য কাঁচা মরিচ শুকিয়ে রাখা, ডিম সেদ্ধ করে ফ্রিজে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিচ্ছেন। এ পরামর্শগুলো আমরা আগে পেলে খুবই উপকৃত হতাম। কারণ, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।’ বিরোধী দলের এই সংসদ সদস্যের এই প্রশ্নের মুখে বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলবেন, এমনটা ভাবা কঠিন। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বাজারে অস্থিরতা কমাতে প্রথমবারের মতো ওইদিনই তিনটি কৃষি পণ্যের দাম বেঁধে দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। দাম বেঁধে দেওয়ার পরদিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা যায়, নির্ধারিত দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। এ অবস্থায় গত শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় অভিযান চালাতে যায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। খবর পেয়ে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম কমিয়ে দেন। দোকানে ঝুলিয়ে দেন মূল্য তালিকা। তার মানে প্রতিবাদের কিছুটা হলেও ফল মেলে। বাজারে আগুন লাগতেই পারে বলে বসে থাকলে আগুন কোনোদিনই থামবে না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের শতকরা ৯১ ভাগ মানুষ চান গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার। সেই দেশে ৩-৪ মাসের মধ্যেই আসছে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ এসব আগুন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সুযোগ পেতে যাচ্ছে আরেক দফা। একটি ভোটের শক্তিতেই তারা ভাঙতে পারে সিন্ডিকেটের শক্ত খুঁটি। কিন্তু এখানেও একদল মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণের বক্তব্য- ভোট এলেই কী, আর না এলেই বা কী…আমার ভোট কি আর আমি দিতে পারবো! আর এই সুযোগেই পাড়ার ভোটচোর বড় ভাই পেয়ে যান কর্মস্থলে, বাজারে ও সংসারে সিন্ডিকেট আগুন জ্বালানোর মন্ত্র।
যার যার ভোটের অধিকার তাকেই বুঝে নিতে হবে। সিন্ডিকেটের মেরুদণ্ড ভেঙে আগুন থামাতে জনগণের মালিককেই দেশের দায়িত্ব নিতে হবে। একটি সুষ্ঠু ভোটের স্বপ্ন দেখতে হবে। আর সেই স্বপ্নে জনগণ একা নয়। দেশের সরকার চাচ্ছে একটি সুষ্ঠু ভোট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন মানুষ ভোট দিতে পারে, ভোট দিতে আসে। দেশে একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক ভোট দেখতে চায় বিশ্বের বড় বড় গণতান্ত্রিক শক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট অনুষ্ঠানের তাগিদ অব্যাহত রেখেছে। কেউ যদি ভোটে বাধা হয়ে দাঁড়ান তার জন্য ভিসানীতি পাস করেছে। এই বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত বৃহস্পতিবার তাদের পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাবও পাশ করেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবটিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে ২০২৪ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এ অবস্থায় একটি সুষ্ঠু ভোট বুঝে নিতে রাষ্ট্রের মালিককেও কিছুটা দায়িত্ব পালন করতেই হবে। এর ব্যত্যয় হলে আপনার রুটি-রুজিতে, আপনার বাজারে, আপনার সংসারে আগুন লাগতেই পারে…
Discussion about this post