বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সবধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। সঙ্গে আশানুরূপ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় না আসায় এবং বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে বাংলাদেশ। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগ প্রত্যাহারও বেড়েছে। এসব কারণে বিদেশি বাণিজ্যিক ঋণে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নাধীন থাকায় প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম জোগান দিতে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। সেই তুলনায় রপ্তানি আয় বাড়েনি।
গত অর্থ বছর থেকে ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতির পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমে এলেও গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতিতে ছিল বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) ৬ হাজার ৯৪৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এ সময় রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ২৩৪ কোটি ডলারের পণ্য। ১ হাজার ৭১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। এ বছরের শুরুর বিনিময় হার ধরলে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ১ ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা ধরে) এর পরিমাণ ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা।
আগের বছরের ধারাবাহিকতায় এই অর্থ বছরের শুরুতে বাণিজ্য ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাসেই বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। গত জুলাইয়ে এই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। দেশীয় মুদ্রায় প্রতি ডলারের বর্তমান দাম ১১০ টাকা ধরে হিসাব করলে স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। গত ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাইয়ে ৪৩৫ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ সময় আমদানি হয়েছে ৪৯৯ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য। ফলে অর্থবছরের প্রথম মাসেই ৬৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ।
গত বছর (২০২২-২০২৩) থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে নানা ধরনের শর্ত দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় বা বিলাসী পণ্যের ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ এলসি মার্জিনও দিতে হচ্ছে। বড় এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি বাড়িয়েছে। এরপরও বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না।
সাধারণভাবে কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু দেশে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স এখন ঋণাত্মক হয়েছে।
বর্তমানে সামগ্রিক লেনেদেনেও (ওভার অল ব্যালান্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। গেল অর্থবছরের সামগ্রিক লেনেদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২২ কোটি ২০ লাখ ডলার। এই সূচকটি আগের বছর একই সময় ঘাটতি ছিল ৬৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগের বছর পাঠিয়েছিলেন ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি ২.৭৫ শতাংশ। এ বছরে শুরুর ডলারের দাম খোলা বাজারে হু হু করে বাড়ছে এবং তৈরি হয়েছে তীব্র ডলার সংকট। প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রবণতাও কম লক্ষ্য করা গেছে, ফলে রেমিটেন্স প্রবাহও কমে গেছে।
দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) সামান্য বেড়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ যেখানে ৪৬৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল, গেল অর্থবছরে তা কমে ৪৫০ কোটি ডলারে নেমেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। এই সূচকটি আগের বছরের চেয়ে ১১.৮২ শতাংশ কমে ১৬১ কোটি ডলার হয়েছে। আগের অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৮২ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
একইসঙ্গে আলোচিত সময়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগে (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) নেতিবাচক অবস্থা অব্যাহত আছে। গত অর্থবছরে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তা থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার চলে গেছে। তার আগের অর্থবছরের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল (ঋণাত্মক) ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় চলতি হিসাবের ভারসাম্যও ঋণাত্মক হয়ে গেছে। কারণ, আমদানির তুলনায় রফতানি আয় কমে গেলে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়ে যায়। চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হওয়ার অর্থই হলো বিদেশী বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোনো দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি হলে আর সেই সাথে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। এতে তাদের বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ কারণেই চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হলে বিদেশী বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
তাছাড়া সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বৃদ্ধি মানে বিভিন্ন উৎসে দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, পরিশোধ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তার আগের অর্থবছরে বিক্রি করে আরও ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ডলার বিক্রির কারণে ধারাবাহিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। সর্বশেষ ২ সেপ্টম্বর ২০২৩ পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৩.০৬ বিলিয়ন ডলারে এবং যা এ মাসের শেষে ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে যাবে। সামনের দিনগুলোতে এ ধারা অব্যাত থাকলে সামনের আমাদের জন্য অনেক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সেবা ঘাটতিও বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, এক দিকে পণ্য বাণিজ্য ও সেবা আয়ে ঘাটতি বাড়ছে অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবের ভারসাম্যে। তাছাড়া বিদেশী নাগরিকদের বেতনভাতাসহ বিভিন্ন সার্ভিসের জন্য বিদেশে প্রচুর অর্থ চলে গেছে। কিন্তু তার বিপরীতে বিদেশ থেকে গত অর্থবছরের প্রত্যাশিত আয় হয়নি।
চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হওয়ার অর্থই হলো বিদেশী বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাবসহ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়া। বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক দায় মেটাতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করতে পারছে না। এর ফলে বাধ্য হয়ে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সামনে ডলারের দাম আরো বেড়ে যাবে। এতে পণ্য আমদানির ব্যয় বাড়বে, আর তাতে মূল্যস্ফীতিও আরো বেড়ে যাবে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে নানা উপায়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রেমিটেন্স বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ, স্বদেশি মুদ্রার অবমূল্যায়ন, আমদানি বিকল্পায়ন ও রপ্তানি বৃদ্ধির চেষ্টাও করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি আমদানি-নির্ভর দেশের জন্য কাজটি অত্যন্ত দুরূহ।
Discussion about this post