অন্যদের জিজ্ঞেস না করে ‘বিএনপি এখন কী করবে?’- এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা নিজেরাই খুঁজতে থাকি, তবে কী কী উত্তর পাওয়া যাবে?
প্রধানত তিনটি উত্তর পাওয়া যাবে।
এক. বিএনপি আশা হারাবে না। আন্দোলন চালিয়ে যাবে। আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করবে। আরো বেশি সংখ্যক রাজনৈতিক দলকে কাছে টানবে। কঠোর থেকে কঠোরতর যুগপৎ ও ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত দাবি আদায় করবে।
দুই. আন্দোলনের পাশাপাশি দলটি সরকারের ওপর আরো বেশি আন্তর্জাতিক চাপ আসার অপেক্ষা করবে। আশা করে থাকবে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের আগে-পরে পর্যাপ্ত ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা কারণে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা নানা ধরনের স্যাংশন এলে নির্বাচনের আগে না হলেও নির্বাচনের পরে সরকারের পতন ঘটবে। তখন নির্দলীয় সরকার গঠিত হবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা হবে।
তিন. অর্থনৈতিক সংকট, রিজার্ভে ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি, বাজারে অস্থিতিশীলতা, আমদানী ও রপ্তানিতে ধ্বস, বৈদেশিক ঋণ, অভ্যন্তরীণ ঋণ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট ইত্যাদি কারণে সরকার শীঘ্রই বড় সংকটে পড়বে। সাধারণ মানুষ পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপির আন্দোলনে যোগ দেবে। আর এটা ঘটলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটবে।
এক কথায় বললে, বিএনপিকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে এবং কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
এখন পরের প্রশ্নে যাই।
বিএনপির চলমান আন্দোলন সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু এবং নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ ও রাজনৈতিক দল যুক্ত হয়ে কর্মসূচিগুলো আরো বেগবান হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
২০১৪-১৫ সালের দেশব্যাপী সর্বাত্মক আন্দোলনের পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বিএনপি আবার বড় আন্দোলনে ফিরে আসতে পেরেছে। সবগুলো বিভাগে বড় বড় সমাবেশ করার পর ঢাকার গোলাপবাগে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের মধ্য দিয়ে ওই দফার আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। যদিও ৭ ডিসেম্বর দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা করে নয়াপল্টন থেকে সমাবেশ গোলাপবাগে স্থানান্তর করতে বাধ্য করা হয় দলটিকে। কিন্তু আন্দোলনের মাঠে বিএনপির প্রত্যাবর্তন সেই দফা সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। বিএনপি কখনোই আর কর্মসূচি থেকে পিছু হটেনি। ২০২৩ সালের ২৮ জুলাই আবারও ঢাকায় মহাসমাবেশের মাধ্যমে তারা নিজেদের জনসমর্থন ও শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেছে। সরকারী দল ও পুলিশের হামলায় পণ্ড হলেও সর্বশেষ ২৮ অক্টোবরেও তারা বিপুল লোকসমাগম করেছিল। ২৮ অক্টোবরের পর হরতাল ও অবরোধেও সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে বিপুল সাড়া দিয়েছে। নেতাকর্মীদের স্বল্প উপস্থিতি সত্ত্বেও কর্মসূচিগুলো সফলভাবে পালিত হচ্ছে।
বোঝা যাচ্ছে, বিএনপির জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। জনগণের বড় একটা অংশ তাদের সঙ্গে আছে। তা সত্ত্বেও বিএনপি এই জনসমর্থনের সফল ঘরে তুলতে পারছে না। অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি আদায় হচ্ছে না। এরই মধ্যে তফশিল ঘোষণা হয়ে গেছে। অনেকেই ধারণা করছেন, প্রায় বিনাবাধায় এবারও সরকার নির্বাচন করে ফেলতে পারবে।
দেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপির আন্দোলন কেন সফল হচ্ছে না?
কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপির কর্মসূচি ও কৌশলে ভুল আছে। কেউ মনে করেন, নেতাদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি নেই। কেউ মনে করেন, বিএনপি’র মধ্যে সরকারের লোক আছে।
এ অনুমানগুলোর মধ্যে হয়তো কিছু সত্য আছে। কিন্তু এই দফায় কর্মসূচি ও কৌশলে বিএনপি গুরুতর ভুল করেছে বলে মনে হয় না। শীর্ষ নেতারা যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আন্দোলন পরিচালনা করছেন। দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন । নেতাদের কেউ কেউ সরকারের কথা শুনতে পারেন, কিন্তু যারা শোনেন তারা দলকে খুব বেশি প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন বলে মনে হয় না।
তাহলে বিএনপিকে ঠেকিয়ে রাখছে কী?
আমার মতে, বিএনপির প্রধান দুর্বলতা হলো পর্যাপ্ত সফট পাওয়ারের অনুপস্থিতি। বিএনপি সমর্থক সংবাদমাধ্যম বলে কার্যকর কিছু অবশিষ্ট নেই। নিজেদের বক্তব্য প্রচারের জন্য এখন দলটি প্রায় পুরোপুরি অলটারনেটিভ মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল। কয়েকদফা ক্ষমতায় থাকলেও ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে তাদের অংশীদারিত্ব গত ১৫ বছরে যথেষ্ট কমে গেছে। বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অধিকাংশই দল বদল করেছেন বা নিরাপদ অবস্থানে চলে গেছেন। আমলা-পুলিশ ও অন্য কৌশলগত জায়গাগুলোতে বিএনপিপন্থীদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে। তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যথেষ্ট স্পেস ধরে রাখতে পারেনি। চোখে পড়ার মতো থিংক ট্যাঙ্ক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন তাদের নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক পরিসরে তাদের কথা বলার মতো মানুষ নেই বললেই চলে। আর এসব কারণে শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় তাদের কর্মসূচিতে লাখ লাখ কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সমাগম দেখা গেলেও শহুরে মধ্যবিত্তদের দেখা মেলে না। শহুরে মধ্যবিত্তরা যাদের কথা শোনে তারা বিএনপির পক্ষে কথা বলে না।
এ কারণে ঢাকায় অসংখ্য বড় সমাবেশ ও তিনটি মহাসমাবেশ করে ফেললেও বিএনপির সমর্থনে বিপুল মানুষের উপস্থিতিগুলো ঢাকা শহরের মানুষকে রোমাঞ্চিত করতে পারেনি। হাজারো সংকটে জর্জরিত থাকলেও তারা সেই সমাবেশে যোগ দিতে, এমনকি দেখতে পর্যন্ত যায়নি। ফলে, সমাবেশগুলো শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। আগামীতেও পারবে বলে মনে হয় না। এমনকি চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয় তৈরি হলেও ঢাকার মধ্যবিত্ত রাস্তায় নামবে, এমন আলামতও দেখা যায় না। অনেকেই গণঅভ্যুত্থানের নানা সম্ভাবনার কথা বললেও আমি এখনো ঢাকা শহরে কোনো গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা দেখি না।
তবে আশাব্যঞ্জক ঘটনাও আছে। ২০২২ সালে নতুন করে আন্দোলন শুরুর পর বিএনপি অনেক নতুন মিত্র জোগাড় করতে পেরেছে। নানা আলোচনা থাকলেও পুরনো জোটসঙ্গীরা তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ যুক্ত হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও জামায়াতে ইসলামী প্যারালাল কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি ও অন্যদের যুগপৎ কর্মসূচিতে না এলেও অনেকের বক্তব্য পরিবর্তিত হয়েছে। এমনকি জাতীয় পার্টি, ছয় ইসলামী দল, কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, ইসলামী আন্দোলনের বক্তব্যেও বিস্ময়করভাবে সন্তোষজনক পরিবর্তন এসেছে। তফশিল ঘোষণার পরদিন পর্যন্ত ১৪ দলের শরিকরা আর দলছুট দলগুলো ছাড়া কার্যত কোনো দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তীব্র আগ্রহ ব্যক্ত করেনি। আপাতত এটা বিএনপিসহ সরকার-বিরোধীদের জন্য বড় অর্জন। কিন্তু এটুকু কি সরকার বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করে সরকারকে অবাধ নির্বাচনে বাধ্য করতে পারবে?
আমি তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখি না।
কেউ কেউ মনে করেন জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন ইত্যাদি দল মিলে রাস্তায় নেমে একটা গণবিক্ষোভের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
আমার মনে হয়, সে সম্ভাবনা খুবই কম। প্রথমত মুখে যাই বলা হোক, এই দলগুলোর শক্তিমত্তা আগের পর্যায়ে নেই। আর তারা শেষ পর্যন্ত ডু অর ডাই ম্যাচে নামবেও না।
তারও চেয়ে বড় কথা, ঢাকার বিশাল মধ্যবিত্ত, তাদের ছেলেমেয়েরা, তাদের বন্ধুবান্ধব কখনো ইসলামপন্থীদের কথায় মাঠে নামবে না। বরং ইসলামপন্থীরা নামলে তারা সংশয়ে পড়বে, সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে। সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যম সহজেই তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারবে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালালে ঢাকার লোকেরা সেটি মেনে নেবে। যেখানে বিএনপি মতো উদার, লিবারেল, জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের সমাবেশে দমন অভিযান মধ্যবিত্তকে প্রত্যাশিত মাত্রায় নাড়া দিতে পারেনি সেখানে ইসলামপন্থীদের বেলায় কী ঘটতে পারে সেটা হেফাজতের সমাবেশে অভিযানের ঘটনা থেকে মনে করা যেতে পারে। ফলে, বিএনপি ও আন্দোলনরত দলগুলোর পক্ষ থেকে ঢাকায় আরো জোরদার আন্দোলন করে গণঅভ্যুত্থান করা প্রায় অসম্ভব। হরতাল আরো তীব্র হতে পারে, অবরোধ কার্যকর হতে পারে। মিছিল বড় হতে পারে। কিন্তু সরকারকে বাধ্য করার মতো কর্মসূচি নির্বাচনের আগে ঢাকায় পালিত হবে এমন আশা নেই। আর ঢাকায় সফল কর্মসূচি দিতে না পারলে ফল আসবে না। বিএনপির কর্মসূচি পর্যালোচনা করে আমি যতটুকু বুঝেছি, তারা কোনোভাবেই সহিংস আন্দোলনের পথে যেতে চায় না। ফলে, বিএনপির পক্ষ থেকে ঢাকা বা ঢাকার বাইরে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করার কোনো চেষ্টা থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে।
অন্যদিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এলেও ঢাকার রাস্তায় তীব্র বিক্ষোভ হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া একথা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ আছে যে, নির্বাচন পর্যন্ত নিজস্ব ক্যাপাসিটিতে সরকার অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকিয়ে রাখার আয়োজনগুলো ইতিমধ্যে সেরে রেখেছে। ফলে, নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে বড় কিছু ঘটবে না।
ফলে, ঢাকায় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচি খুব বেশি ফল তুলতে পারবে না। অন্যদিকে, ঢাকার বাইরে পরিস্থিতি একেবারেই উল্টো। কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মেহেনতি মানুষ সরকার-বিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন দিচ্ছে। ঢাকার বাইরে বিএনপির সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবসময়ই বেশি।
এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ প্রসঙ্গে আসি।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারপন্থী রাষ্ট্রগুলোর পদক্ষেপ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনে খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের জন্য র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ও গুম উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে পেরেছে। বলা চলে, এই পদক্ষেপ প্রথম বিএনপিসহ বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা নিরাপত্তার বোধ তৈরি করেছে এবং তারা আবার ন্যায্য দাবি আদায়ে রাস্তায় নামার সাহস পেয়েছে। এটা বড় অগ্রগতি। কিন্তু, বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ও গুম কমলেও বিরোধী দলের কর্মসূচিতে হামলা, প্রকাশ্য মিছিলে গুলি, গায়েবী মামলা, গণগ্রেপ্তার ইত্যাদি মোটেও বন্ধ হয়নি। গত দুই বছরে বিএনপি সহ বিরোধী নেতাকর্মীদের অনেকে হত্যা ও হামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু এগুলোর বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ আসেনি। একটি নিষেধাজ্ঞার ফলে গুম ও বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড শুধু কমে এসেছে। এমনকি ওই নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। ফলে, নিষেধাজ্ঞাটি সফল হয়েছে একথা বলা যায় না। বরং বলা যায়, ভবিষ্যৎ নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কিছুটা সতর্ক হওয়া ছাড়া নিষেধাজ্ঞাকে সরকার বিশেষ আমলে নেয়নি।
পরে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সহায়তা করার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের জন্য একটি ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণাও দিয়েছে। এটিও সরকারকে দৃশ্যমানভাবে টলাতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্র এ যাবত নির্বাচনের আগে ও পরে যেসব দেশে ভিসানীতি প্রয়োগ করেছে সেগুলোর কোথাও এটি উল্লেখযোগ্য ও দৃশ্যমান কোনো ফল আনতে পারেনি। ভিসানীতির মতো নরোম উদ্যোগ দূরের কথা, স্যাংশনের মতো কঠোর উদ্যোগও এখন পর্যন্ত আফ্রিকা ও এশিয়ার কোনো দেশের শাসককে বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ থেকে সরিয়ে আনতে পেরেছে এমন উদাহরণ আমাদের সামনে নেই। বরং সত্য হলো, পৃথিবীতে অনেক দেশেই স্বৈরশাসকরা যুক্তরাষ্ট্রের ডজন ডজন স্যাংশন নিয়ে দিব্যি নিজেদের মতো চলছে। নতুন মেরুকরণের সুবিধা ব্যবহার করে মাথা উঁচু করেও রাখছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এসব তথ্য কি যুক্তরাষ্ট্রের অজানা? তাদের যদি জানাই থাকে যে, ডজন ডজন স্যাংশন ও শত শত ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েও কোনো দেশকে টলানো যাচ্ছে না, সেখানে তারা কীভাবে আশা করতে পারে মাত্র একটি স্যাংশন ও কিছু ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ১৫ বছর ধরে শক্তপোক্তভাবে ক্ষমতায় থাকা একটি দলকে তারা টলাতে পারবে? তিন তিনটি পরাশক্তির প্রত্যক্ষ সমর্থন সরকারের সঙ্গে থাকার পরও তারা এত সহজে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে রাজি হবে কেন?
ফলে, এ কথা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ আছে যে, মুখে বললেও বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত ও কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের জুনিয়র মন্ত্রীদের দল অনেকবার ঢাকা সফর করেছেন, ঢাকা ও ওয়াশিংটনে বসে অনেক ভাল ভাল কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে কাজের কাজ হয়নি। তফশিলের অব্যবহিত আগে ডোনাল্ড লু’র চিঠিতে সংলাপের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ১০,০০০ বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে, বিএনপির অফিস তালাবদ্ধ করে রেখে তফশিল ঘোষণার ঠিক আগে সংলাপের প্রস্তাব প্রায় পরিহাসের পর্যায়ে পড়ে।
অনেকে মনে করছেন, সংলাপের সম্ভাবনাও নেই। আর সংলাপ হলেও সেটি শুধু সরকারকে ব্রিদিং স্পেস দেবে। এখনকার গুমোট ভাবটা কাটিয়ে সংলাপের বাহানায় সরকার আরো বেশি সফলভাবে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।
নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর অনেকেই মনে করছেন, এ সময়ে ডোনাল্ড লু’র চিঠি স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা। নানা দপ্তর থেকে ভাল ভাল কথা বলা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কার্যত নির্বাচনের আগে কিছুই করবে না।
তাছাড়া এই চিঠিতে নতুন কোনো বার্তা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধি দল যা বলেছে, রাষ্ট্রদূত ও অন্যরা আগে যা বলেছেন নতুন চিঠিতে সেগুলোই পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। ফলে, এটি কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।
অনেকে বিএনপির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও কেউ কেউ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রতি পুরোপুরি আস্থাশীল হতে পারেনি। বিশেষ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে তাদের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের গুজব যুক্তরাষ্ট্রকে চিন্তিত করেছে। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দু’একটি জায়গায় সরকার-সংশ্লিষ্টদের অবস্থানও তাদের বিচলিত করেছে। তারা মনে করছে, বিএনপি কিছুটা আনপ্রেডিক্টেবলও। এ অবস্থায় তারা বিএনপির জন্য জানপ্রাণ দিয়ে মাঠে নামবে না। এমনকি বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির সক্রিয়তা ও কার্যকারিতার ওপরও যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি আস্থাশীল হতে পারছে না। ভারত-নিয়ন্ত্রিত সিভিল সোসাইটি ক্ষমতায় এলে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দেশের দায়িত্ব নিতে সিভিল সোসাইটি বা অন্য অরাজনৈতিক শক্তিগুলো বোধহয় খুব বেশি উৎসাহিত নয়। তাদের অবস্থা হলো, তুলিয়া দিলে খাইবো। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র হয়তো অন্য পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যার সঙ্গে সম্ভবত বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। যারা এভাবে দেখেন তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত পরিকল্পনা কী সেটা হয়তো আমরা এখনই ধারণা করতে পারবো না। হযতো তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে ভাবছে। তাদের কাজের পরিসরও হয়তো বড়।
ইওরোপীয় ইউনিয়নকে বিরোধীদের পক্ষ থেকে অনেক প্রশংসা করা হলেও ভাল ভাল কথা বলা ছাড়া ইওরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেয়নি, যাতে বোঝা যায় একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে বাধ্য করার ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সিরিয়াস।
অনেকেই বিশ্বাস করেন, নির্বাচনের আগে না হলেও নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ আসবে। নির্বাচনের পর সরকার আর বেশি সময় পাবে না। দ্রুত তাদের পতন হবে। কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা থাকলেও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসবে, এটি অনেকেই মনে করেন না। এমন কোনো আলামত থাকলে আইএমএফ-এর ঋণের ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতো। কিন্তু প্রথম কিস্তির পর শর্ত পূরণ না হলেও সরকার দ্বিতীয় কিস্তির ঋণও পেতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, নির্বাচনের পর স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কি কোনো দেশে সরকারের পতন ঘটানো গেছে? আমাদের সামনে এখন পর্যন্ত কোনো উদাহরণ নেই।
ফলে, নির্বাচনের আগে বা পরে নিষেধাজ্ঞাসহ কঠোর পদক্ষেপ নিলেও নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে বা সরকার পদত্যাগ করবে এমন ভেবে নেওয়া খুব কঠিন। তবে এসব পদক্ষেপের সঙ্গে যদি জনগণের মধ্যে কোনো জাগরণ ঘটে এবং স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে ভিন্ন কথা।
আগেই আলোচনা করেছি, ঢাকায় এমন ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। ওয়ান ইলেভেনের মতো পরিস্থিতিও ঘটবে না। ওয়ান ইলেভেনের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। সিভিল সোসাইটি বেশ তৎপর ছিল। চীন-রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলো নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল। দ্রুততম সময়ে পুরো ব্যাপারটি গুছিয়ে এনে কার্যকর করা হয়েছিল। এবার তেমন ঘটনার আলামত একদমই নেই। যা শোনা যায় তার সবই গুজব।
যদি গণঅভ্যুত্থান না ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়াস পদক্ষেপ না নেয়। নিলেও তাতে বড় পরিবর্তন না ঘটে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে জনগণ মাঠে না নামে। ওয়ান ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি না ঘটে। তবে বিএনপি ও দলটির সঙ্গে আন্দোলনরতদের একমাত্র ভরসা নিজেদের শক্তিতে নির্বাচন পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়া এবং যে কোনো উপায়ে নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করা। নির্বাচনের পরেও জোরদার আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে নিতে হবে দলটিকে। এখন প্রশ্ন হলো, সে পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়ার পরিস্থিতি কি আছে?
বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যেই আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার প্রত্যয় আছে। ধারাবাহিক কর্মসূচি চালিয়ে নিতে তারা হয়তো আপত্তি করবে না। কিন্তু সেটা কতদিন?
আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে এত কথার পরও নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন, সরকার একতরফা নির্বাচন করে আবারও ৫ বছরের জন্য ক্ষমতা নিতে পারবে। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে সেটি সরকারের জন্য বিচলিত হওয়ার মতো কিছু হবে না। কেননা গত দুটি নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাতে মেয়াদ পূর্ণ করতে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি।
নির্বাচন করে ফেলার পর, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাকানিজমও সরকার যথেষ্ট জানে। গত দুই নির্বাচনের পরের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে সেটি স্পষ্ট বোঝা যাবে। ফলে, কোনো মিরাকল না ঘটলে আরো ৫ বছরের জন্য টিকে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা সরকারের আছে।
তফশিল ঘোষণার এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত হয়তো রাজনৈতিক দলগুলো হাওয়া বুঝতে চাইবে। দরকষাকষির জন্যও সময়টাকে কাজে লাগাতে চাইবে। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে দুই বড় দল জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে তা খুব বেশি বিস্ময়কর হবে না। এটি ঘটলে আবারও ২০১৪ সালের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। তফশিলের আগে বিএনপি থেকে লোক ভাগানোর চেষ্টা সফল না হলেও, ৫ বছরের জন্য সরকার গঠিত হওয়ার চিন্তা ভর করলে বিএনপির একটি অংশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হবে। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা ছোট দলগুলোর কোনো কোনোটি নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তারপরও এবার বেশিরভাগ দল নির্বাচনের বাইরে থাকবে।
কিন্তু তাতে কি সরকার নতুন কোনো সংকটে পড়বে?
পড়বে না।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে অন্যদের নির্বাচনে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েও তারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। ১৫৩টি আসনে ভোটের আগেই জয় নিশ্চিত করে রেখেছিল। কারণ তারা জানতো, বিএনপি ভোটে এলে জিতে আসা অতো সহজ হবে না। শাহবাগ আন্দোলনের অব্যবহিত পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছয়টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবির পর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে অন্য দলগুলোকে নিয়ে তারা নির্বাচন করে ফেলবে এবং ক্ষমতায় আসবে। সে পরিকল্পনা প্রায় ভেস্তে যাচ্ছিল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের কারণে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং সেবার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি সামাল দেন। তারপরও সরকার নিশ্চিত ছিল না তারা একটি বিতর্কিত নির্বাচন করে সরকার টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না। সে কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলেছিল। এমনকি ভাল একটি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে যে দাবি আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছ থেকে আদায় করতে পেরেছিল সেই দাবি ২০১৪ সালের পর বিএনপি আদায় করে নিতে পারেনি। দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে হঠাৎ করেই তারা রাস্তা ছেড়ে ঘরে ফিরে গিয়েছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি কার্যত অংশগ্রহণ করেনি। সংলাপের নামে প্রহসন হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি বন্ধ, মুক্তি, জামিন কিছুই হয়নি। তারা মাঠে নেমে ভোটের জন্য কাজ করতে পারেনি। অন্যায়ভাবে বিএনপির প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। পর্দার আড়ালে ১২০ বা ৭০টি আসনের সমঝোতা হয়েছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পুলিশ-প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সেটিও ঘটতে দেয়নি। দৈবক্রমে ৭টি আসন পেয়েছিল বিএনপি। মজার ব্যাপার হলো, রাতের বেলা জেতার জন্য প্রয়োজনীয় ভোট পড়ার পরও ভোটকেন্দ্রগুলো থেকে দিনের বেলা অধিকাংশ ভোটারকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রাতে ব্যালটবাক্স ভরার পরও তারা ভোটারদের ভয় পাচ্ছিল?
২০১৪ সালে কৌশল ও বলপ্রয়োগ করে সরকার বিএনপিকে ভোটের বাইরে রেখেছিল। ২০১৮ সালে সমঝোতার নাটক করে বিএনপিকে ভোট প্রক্রিয়ার নিষ্ক্রিয় রাখতে পেরেছিল। কিন্তু বিএনপি যদি ভোটে যেত, সিরিরয়াসলি আসন ভিত্তিকভাবে, কেন্দ্রভিত্তিকভাবে লড়াই করতো তবে কি সরকার ওই দুই নির্বাচনে এভাবে জিতে আসতে পারতো? আমার মনে হয়, পারতো না। অনেকেই হয়তো বলবেন, জিতে এলেও সরকার তো অবৈধ। কিন্তু তাতে কি তাদের শাসন করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে? মেয়াদ পূর্ণ করতে কোনো বাধা এসেছে?
প্রশ্ন হলো, তাহলে এবার বিএনপি কী করতে পারে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কবে, কখন কী করবে সেগুলো স্রেফ কল্পনা ও স্পেকুলেশন বলেই মনে হয়। আর তারা কোনো পদক্ষেপ নিলে তার ফলে সরকারের পতন ঘটবে এমন নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোটামুটিভাবে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে সরকার।
দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে আর কোনো পথ নেই। তবে ১০ ডিসেম্বর, ২৮ জুলাই ও ২৮ অক্টোবর আন্দোলন যে চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠেছিল সেখান থেকে আরও ওপরে ওঠার সম্ভাবনা আপাতত নেই। অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি আরও দু’সপ্তাহ পর্যন্ত জনসমর্থন পাবে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বিএনপি ও সহযোগী দলগুলো কর্মসূচি পালনে একই মাত্রার সক্রিয় ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত রাখতে পারবে না।
নির্বাচন পর্যন্ত তাহলে কীভাবে কর্মসূচি টেনে নিয়ে যাবে বিএনপি?
আমার মনে হয়, একটা উপায়ে আন্দোলন কর্মসূচি কার্যকরভাবে অব্যাহত রাখা সম্ভব। সেটা হলো, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। আওয়ামী লীগ মুখে যা-ই বলুক, তারা কিছুতেই চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। অন্যদিকে বিএনপি বাদে অন্যদের নির্বাচনে আনার ব্যাপারে তারা সব চেষ্টাই করবে। কিন্তু মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এলে তারা ভয় পেয়ে যাবে। ঢাকায় ব্যর্থ চেষ্টা না করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সৃষ্টিশীলভাবে সরকার-বিরোধী আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। প্রতিটি সংসদীয় আসনে বিএনপি নেতাকর্মীরা সক্রিয় হতে পারবে।
তবে এই অংশগ্রহণ অবশ্যই ২০১৮ সালের মতো সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য হতে পারবে না। আলোচনা ও সংলাপের নামে আসন ভাগাভাগির আয়োজনও হতে পারবে না। সংলাপের উদ্দেশ্য থাকবে- নেতাকর্মীদের ওপর জেল-জুলুম, মামলা-হামলা-সাজা বন্ধ করা।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মানে হলো, সিরিয়াসলি নির্বাচনে অংশ নেওয়া। প্রতিটি বিষয় চ্যালেঞ্জ করা। জনগণের সামনে তুলে ধরা। বাইরের বন্ধুদের সজাগ করে তোলা। কেউ যেন মনোনয়ন বাণিজ্য করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা। ক্লিন ইমেজের, লড়াকু ও প্রকৃত জননেতাদের মনোনয়ন দেওয়া। যাতে তারা প্রতিটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে পারে। ভোট চুরির সমস্ত উদ্যোগ ভেস্তে দিতে পারে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপি জোটসঙ্গীদের মধ্যে ঐক্যও সংহত করতে পারবে। জামায়াতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী জোট গড়ার ব্যাপারে আমার আপত্তি থাকলেও নির্বাচনী জোটে আপত্তি নেই। জামায়োতের শক্ত ঘাঁটিগুলোতে তাদের প্রার্থীদের ধানের শীষ দিতে হবে। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা প্রতিটি ছোট দলের শীর্ষ নেতাদের ধানের শীষে মনোনয়ন দিতে হবে। বিএনপি নেতাকর্মীরা ওইসব আসনে তাদের পক্ষে কাজ করবেন। কিছু আসনে পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মনোনয়ন দেওয়া যেতে পারে। এতে বিএনপি নির্বাচনে জিতলে যে জাতীয় সরকার গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার ট্রায়াল হয়ে যাবে। জনগণের সামনে একটি রূপরেখা দাঁড়িয়ে যাবে।
ধরে নিতে হবে, আওয়ামী লীগ যে কোনো উপায়ে ভোট চুরি করে জিতে আসবেই। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তারপরও ভোটচুরি ঠেকাতে সব চেষ্টা করে যেতে হবে।
দলের শীর্ষ নেতাদের কারামুক্তির দাবির পাশাপাশি ৩১ দফা দাবি জনগণের কাছে হাজির করতে হবে। ভোটাধিকার-বঞ্চিত পৌনে চার কোটি তরুণ ভোটারদের কাছে টানতে তরুণ নেতৃত্ব সামনে আনতে হবে। বড় বড় মিছিল-সমাবেশ করার সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
ভোটের দিন প্রতিটা মুহূর্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং ভোটের পর নতুন কর্মসূচি দিয়ে মাঠে ফেরত আসতে হবে। প্রথম কর্মসূচি হওয়া উচিত ঢাকা ঘেরাও।
ডিসেম্বরে যদি কোনো মিরাকল ঘটে, তবে সেটা বিএনপি নির্বাচনের মাঠে থেকেও কাজে লাগাতে পারবে। কিন্তু অনুমান-নির্ভর কিছু বিষয়ের অপেক্ষা, গুজব-চর্চা এবং ক্রমশ ম্রিয়মান আন্দোলনের দিকে চলে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
Discussion about this post