বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যেকটা দিন কাটছে তুমুল উত্তেজনায়। উথাল-পাতাল দ্রব্যমূল্যের বাজারে জীবন চালাতে খাবি খাওয়া মানুষগুলো নানা রাজনৈতিক আলোচনায় ব্যস্ত। আলোচনাগুলো তৈরি হচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের সময় চলছে এখন। একদিকে গণতন্ত্রে যাত্রা, অন্যদিকে গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে একনায়কতন্ত্রের ধারাবাহিকতা। মানুষের ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এবং খেয়ে-পরে বাঁচার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখন। প্রতিটি দিনই নানা উত্তেজনায় কাটছে।
নির্বাচন ঘিরে ঢাকার রাজনৈতিক নানা কর্মসূচি, পরাশক্তিগুলোর নানা ধরনের মন্তব্য-পর্যবেক্ষণ, বাজার ব্যবস্থা, অর্থনীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ- প্রত্যেকটিই গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার সপ্তাহগুলো কেমন যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের? গত সপ্তাহটি কেমন গেল?
প্রধানমন্ত্রীর ধমক
গত সপ্তাহটা শুরু হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ধমক দিয়ে।
আগের সপ্তাহের অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামার প্রসঙ্গ নিয়ে। বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ নিয়ে কথা বলেছেন। দেশের রিজার্ভ কমার পেছনে সংবাদমাধ্যমগুলোতে দুটো বিষয় আলোচনায় আসে। প্রথমত, রেমিটান্স প্রবাহ কমে যাওয়া; দ্বিতীয়ত, রপ্তানি আয় কমে যাওয়া।
এই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমাকে বেশি কথা বললে সব বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব। ইলেকশনের পরে, যদি আসতে পারি, আবার করব। তারপর দেখি কে সাহস পায় নিতে…ক্ষমতা। সব গুছিয়ে দেওয়ার পরে এখন ইলেকশনের কথা, ভোটের কথা, অর্থনীতির কথা, পাকা পাকা কথা শুনতে হয়। আমি তো শুনতে রাজি না। …যদি বলেন রিজার্ভ বাড়াতে হবে, তাহলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিই। পানি দেওয়া বন্ধ করে দিই। সার বন্ধ করে দিই। সব বন্ধ করে বসিয়ে রাখলে রিজার্ভ ভালো থাকবে।” (৬ অক্টোবর, প্রথম আলো)।
একই সময়ের মধ্যে আলোচ্য ছিল- খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার সংবাদও। এছাড়া আইএমএফের শর্তপূরণ করতে না পারার খবরও।
খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা
গত ৯ অগাস্ট থেকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতির জন্য ২৪ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হলে এখন যে সাজা স্থগিত করে তাঁকে বাসায় থাকার অনুমতি দিয়েছি, তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। আবার তাঁকে জেলে যেতে হবে, আদালতে যেতে হবে। আদালতের কাছ থেকে তাঁকে অনুমতি নিতে হবে।”
গত ৪ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “কিছুদিন ধরে আমরা খালেদা জিয়াকে দেখছি, তার অসুস্থতার বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছি ও আন্দোলন করছি। আমরা জানি ভয়াবহ এই ফ্যাসিস্ট সরকার দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে না। কারণ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তারা (সরকার) তাকে হত্যা করতে চায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায়।” (৪ অক্টোবর, ঢাকা ট্রিবিউন)
খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে সবশেষ বড় আলোচনা তৈরি হয় মেডিকেল বোর্ডের সংবাদ সম্মেলন হলে। ৯ অক্টোবর এভায়কেয়ার হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসকরা জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা নাজুক। তাকে দ্রুত বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা। চিকিৎসকদের দাবি, “সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ‘মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে গেছে’। চিকিৎসায় দেশে যা কিছু করার, তা শেষ হয়ে এসেছে। ‘কোনো ওষুধে কাজ করবে না’, এই রকম একটা অবস্থায় চলে যেতে পারে পরিস্থিতি।” (৯ অক্টোবর, বিডিনিউজ)।
১৪ অক্টোবর খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে সারাদেশে অনশন করে বিএনপির নেতাকর্মীরা। অনশন চলাকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার জন্য আমরা আবেদন করেছি, নিবেদন করেছি, কথা বলেছি। কিছুতেই কাজ হয়নি। হত্যার উদ্দেশ্যেই খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিদেশে পাঠানো হলে খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিংয়ের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাবে, তাই সরকার তাকে মুক্তি দিতে রাজি নয়।”
ইউরেনিয়াম প্রসঙ্গ
গত ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি “ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল” বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করে রাশিয়া। এ নিয়ে নানা ধরনের খবর প্রকাশিত থাকে। ইউরেনিয়াম শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছানো তারপর সেটি রূপপুরে পৌঁছানোকে কেন্দ্র করে সংবাদ হতে থাকে। ইউরেনিয়ামকেন্দ্রিক আলোচনা চলার মধ্যেই আওয়ামী লীগের সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি নেতাদের মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে দেওয়ার কথা বলেন। বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে ৯ অক্টোবর। এদিন গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় এক সমাবেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন ক্ষমতায় গেলে তারা নাকি রূপপুর পারণমাণবিক কেন্দ্র বন্ধ করে দেবেন। দুই চালান ইউরেনিয়াম এসেছে। বেশি লাফালাফি করলে কিছু মির্জা ফখরুল, কিছু মঈন খান, কিছু মির্জা আব্বাস এবং কিছু রিজভীর মাথায় দিয়ে দেব। এখন ডাণ্ডা মেরে নয়, ইউরেনিয়াম দিয়ে ঠাণ্ডা করে দেব।” (৯ অক্টোবর, সমকাল)
এর জবাবে পরদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী কথা বলেন। ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনেন মির্জা আব্বাস; আর রিজভী ওবায়দুল কাদেরকে “ক্যামিকেল কাদের” নামে বর্ণনা করেন।
আদিলুর-এলানের জামিন ও জাহান্নাম প্রসঙ্গ
২০১৩ সালের ৫-৬ মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় মানবাধিকার সংগঠন “অধিকার”। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর এই মামলায় অধিকারের আদিলুর রহমান খান ও এএসএম নাসিরউদ্দিন এলানের ২ বছরের করে কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। পরে ২৫ সেপ্টেম্বর আইনজীবীদের মাধ্যমে তারা আপিল আবেদন জমা দেন। আবেদনে নিম্ন আদালতের রায় বাতিল এবং অভিযোগ থেকে খালাস চাওয়া হয়।
গত ১০ অক্টোবর আইসিটি আইনে করা মামলায় কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আদিলুর ও নাসির উদ্দিন এলানকে জামিন দেয় হাইকোর্ট।
জামিন শুনানির সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) মো. রেজাউল করিম জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেন।
এ সময় বিচারপতি মো. ইমদাদুল হকের আদালত ডিএজিকে বলেন, “আবেদনকারীর আইনজীবীদের আগে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করতে দিন। তারপর আপনি আপনার যুক্তি দেবেন। পিটিশনকারীদের আইনজীবীরা যুক্তি দেওয়ার আগেই আপনি কেন লাফিয়ে উঠলেন? (আপনারা) দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন।” (১০ অক্টোবর, ডেইলি স্টার)
বিচারপতির মন্তব্য ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে আলোচনা তৈরি হয়। পরে বিচারপতি মো. ইমদাদুল হককে ডেকে কথা বলেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ইমদাদুল হককে কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল হতে পরামর্শ দেন প্রধান বিচারপতি। (১১ অক্টোবর, আজকের পত্রিকা)
মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি যাচাই করতে গত ৭ অক্টোবর ঢাকায় আসে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টির থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। তারা ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় সরকার, বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধি, নির্বাচন কমিশন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
বাংলাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ও তাদের সমমনাদের নিয়ে দুটি প্রধান স্রোতধারা তৈরি করেছে। একদিকে বিএনপি ও সমমনা ৩৫টি দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলছে, ২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালে ভোটের নামে প্রতারণা করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও সমমনা ১৪ দলীয় জোট শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে।
এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন সরকারের অর্থায়নে ঢাকা সফরে এসেছে দলটি। তারা ঢাকা থেকে ফিরে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। তাতে সমঝোতার জন্য সংলাপে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক
গত ৯ অক্টোবর দুপুরে বনানীর শেরাটন হোটেলে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে প্রায় তিন ঘন্টা বৈঠক করে আওয়ামী লীগ। বৈঠক শেষে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশে নির্বাচনের পরিবেশ, ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কতটা গণতান্ত্রিকভাবে দেখা হচ্ছে- এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছে মার্কিন প্রতিনিধি দল।
তিনি বলেন, “তারা কোনো প্রস্তাব দেয়নি, আলোচনায় উঠে এসেছে বিএনপির দাবি। তারা কথায় কথায় বলেছে ‘আপনাদের মধ্যে কি এখানে কোনো কম্প্রোমাইজের পথ খোলা আছে কিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অ্যাডজাস্টমেন্টের কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় কি না?’ আমরা বলেছি, সেই পথ বিএনপি ব্লক করে রেখেছে। আমরা বলেছি সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।” (৯ অক্টোবর/বণিক বার্তা)
বিএনপির সঙ্গে বৈঠক
গত ৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপি চেয়ারর্পাসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয় গুলশানে মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি।
বৈঠক শেষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমরা স্বাভাবিকভাবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলেছি, শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এটার তো কোনো উন্নয়ন হয়নি, বরং আরও অবনতি হয়েছে। গত কয়েকটি নির্বাচনে তারা ভোটাধিকার হরণ করেছে। ভোট চুরির প্রকল্প এখন আরও শক্তিশালী হয়েছে। দমন নিপীড়ন আরও বেড়েছে।” (৯ অক্টোবর, জাগো নিউজ)
জাপাসহ পাঁচ দলের সঙ্গে বৈঠক
৯ অক্টোবর বিকেলে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। দলটির পক্ষ থেকে মার্কিন দলকে জানানো হয়, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু বা পক্ষপাতদুষ্ট, এর কোনোটাই বোঝা যায় না। প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কোনো একটি নির্বাচনে অংশ না নিলে সে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না।
একই দিনে সন্ধ্যায় নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন ও এবি পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি। মার্কিন প্রতিনিধি দলটিকে এই দলগুলো বলেছে, “তাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, কোনো দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। শুধু নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা গেলে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। দলগুলো বলেছে, তারা দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে যাবে না।” (১০ অক্টোবর, প্রথম আলো)
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক
১১ অক্টোবর দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, “৯ সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধি দল আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা জানতে চেয়েছে, নির্বাচনে ভায়োলেন্স হবে কিনা। প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারবো কিনা। প্রার্থীরা তাদের প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবেন কিনা। আমরা বলেছি, নির্বাচন আমাদের দেশে একটি উৎসবের মতো। এখানে সবাই সবার মতো প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেন। আমাদের দেশের মানুষ শান্তি চায়। আমাদের যেসব বাহিনী আছে, তারা ওয়েল ট্রেইন্ড, ওয়েল ইনফরমড থাকেন। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা পাঁচ হাজার ৩০০ নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন।”(১১ অক্টোবর, দেশ রূপান্তর)
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক
১০ অক্টোবর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী বিষয়ক পর্যবেক্ষক দল মূলত বাংলাদেশের প্রি-অ্যাসেসমেন্ট করতে এসেছে। তাদের মূল ফোকাস হলো সুষ্ঠু, স্বাধীন, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। তারা আমাদের রোল, দায়িত্ব, কর্মকাণ্ড, সরকারের সঙ্গে ইসির কো-অর্ডিনেশন ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তারা আমাদের কাছে যা যা জানতে চেয়েছেন, আমরা সবকিছু জানিয়েছি। এরপরে তারা কী করবেন আমরা জানি না। তারা হয়তো দেশে ফিরে গিয়ে পর্যালোচনা করে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা, এর সিদ্ধান্ত নেবেন। (১০ অক্টোবর, ঢাকা পোস্ট)
মার্কিন প্রতিনিধি দলের ৫ সুপারিশ
প্রতিনিধিদলটি সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলসহ অন্য নির্বাচনী অংশীজনদের বিবেচনার জন্য পাঁচ সুপারিশ রেখেছে মার্কিন প্রতিনিধি দল। ১৪ অক্টোবর এক বিজ্ঞপ্তিতে সেটি জানানো হয়। সুপারিশগুলো হলো-
১. সহনশীল বক্তৃতা ও নির্বাচনী মুখ্য ইস্যুতে খোলামেলা-অর্থবহ সংলাপে বসা।
২. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা ও নাগরিকদের জন্য খোলামেলা পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে ভিন্নমতকে সম্মান করা হয়।
৩. সহিংসতার বিরুদ্ধে অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
৪. স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনাকে শক্তিশালী করাসহ সব দলের অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করা।
৫. নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সক্রিয় নির্বাচনী অংশগ্রহণের সংস্কৃতি প্রচার করা।
হামাসের হামলা ও ইসরায়েলের যুদ্ধ ঘোষণা
গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস আক্রমণ করে ইসরায়েলে। ইসরায়েলের গোয়েন্দাদের নজরদারি ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে তেল আবিবকে চ্যালেঞ্জ জানায় তারা। ইসরায়েলের দিকে প্রায় ৫ হাজার রকেট ছোঁড়ে তারা। পরে পাল্টা হামলার মাধ্যমে যুদ্ধের ঘোষণা দেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। সেখানে এখনো যুদ্ধ চলছে। প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে মৃত্যুর সংখ্যা। এই মৃত্যু উভয়পক্ষের। গাজাকে অবরুদ্ধ করেছে ইসরায়েল। খাদ্য, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও হাসপাতালে হামলা অব্যাহত রেখেছে তেলআবিব। তেল আবিবকে সমর্থন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা। অন্যদিকে ফিলিস্তিনির পক্ষে সংহতি জানিয়েছে ইরান, তুরস্কসহ আরব বিশ্বের কিছু দেশ।
বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। ৮ অক্টোবর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান সশস্ত্র সংঘাতের নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দেয়। নিরপরাধ বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ও হতাহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে সংঘাত বন্ধে জরুরি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে। বিবৃতিতে বলা হয়, “সংলাপ ও কূটনীতিই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের স্থায়ী সমাধান ঘটাতে পারে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতিকে “দ্বিচারিতা” বলে মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন জোটের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
১২ অক্টোবর “বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ”-এর এক সমাবেশে মেনন বলেন, “আমাদের সরকার সব সময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী যখন ফিলিস্তিনি শিশুহত্যার বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার, তখন এ ঘটনার ব্যাপারে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছে, তা দ্বিধান্বিত বিবৃতি। এই দ্বিধান্বিত সমর্থনের কোনো জায়গা নেই।” (১২ অক্টোবর, প্রথম আলো)
এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দেশের নানা জায়গায় ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সংহতি সমাবেশ করা হয়। বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বেশ সরব হয়ে ওঠে।
পিটার হাসের মুরব্বি
১২ অক্টোবর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আবারও আলোচনায় আসেন। গোয়েন্দা ও দলীয় সূত্রের বরাতে সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, পিটার হাস ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকটি আমেরিকান ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
দিনব্যাপী আলোচনা শেষে সন্ধ্যার পর বিএনপি জানায়, এ ধরনের কোনো বৈঠক হয়নি। গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের বৈঠকের যে খবর বেরিয়েছে গণমাধ্যমে, তা বিভ্রান্তিকর। এ ধরনের কোনো বৈঠক হয়নি। সম্পূর্ণ মিথ্যা ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে।” (১২ অক্টোবর, বাংলা ট্রিবিউন)
এরমধ্যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন ওবায়দুল কাদেরও। গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে কাদের বলেন, “পিটার হাস কী করবেন? ভিসানীতি দেবেন, নিষেধাজ্ঞা দেবেন? পিটার হাসের মুরব্বিদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়ে গেছে। আমেরিকার মুরব্বি যারা, তাদের সাথে কথাবার্তা শেষ। উচ্চপর্যায়েও কথাবার্তা হয়ে গেছে। তলে তলে যখন সব শেষ, তখন আর এইসব করে লাভ নেই। পিটার হাসকে দেখিয়ে নির্বাচন বন্ধ করবেন, ঢাকায় তাণ্ডব করবেন, সেই খেলা খেলতে দেব না।” (১২ অক্টোবর, টিবিএস)
ডিসি-ইউএনওদের গাড়ি, সচিবদের প্লট
ডিসি-ইউএনওদের নতুন গাড়ি কেনার খবরটি বেশ পুরোনো। এবার সরকার গাড়ি কেনার অনুমোদন দিয়েছে। ১১ অক্টোবর বিভিন্ন এলাকার ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ২৬১টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করে সরকার।
পরে নতুন গাড়ির যৌক্তিকতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, “সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) অপরিহার্য। সে কারণেই তাদের জন্য নতুন গাড়ি কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।” (টিবিএস, ১২ অক্টোবর)
১৪ অক্টোবর দৈনিক দেশ রূপান্তরে ১৮ সচিবকে প্লট উপহার দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, “নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিবসহ সরকারের ১৮ জন সিনিয়র সচিব ও সচিবকে রাজধানীর অভিজাত আবাসিক প্রকল্প পূর্বাচলে প্লট উপহার দেওয়া হচ্ছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বরাদ্দের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে এখন বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। গত ২৯ আগস্ট রাজউকের ১১তম বোর্ডসভায় সচিবদের নামে বিশেষ কোটায় ১৩এ (১) সি ধারায় প্লট দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে গত ১৪, ১৬ ও ১৭ আগস্ট ছয়টি চিঠিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় রাজউক চেয়ারম্যানকে সচিবদের নামে প্লট বরাদ্দ দিতে নির্দেশ দেয়।”
জামায়াত আবারও সক্রিয়
জামায়াতের রাজনীতি গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনেকটা নিস্তেজ হয়েছিল। এ বছরের জুন মাসে সক্রিয় হয় জামায়াত। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, জামায়াত সরকারের সিগনাল পেয়ে মাঠে নামছে আর আওয়ামী লীগের পক্ষে বলা হয়, নাশকতা করতে জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে বিএনপি। গত ১০ জুন রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সমাবেশ করে জামায়াত।
গত ১৪ আগস্ট জামায়াতের সাবেক আমির ও যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যু হয়। সাঈদীর জানাজাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাঁধে।
গত ৮ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, দলের আমিরসহ গ্রেপ্তার নেতাকর্মী ও আলেম-ওলামাদের মুক্তি এবং সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে জামায়াত সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। (৮ অক্টোবর, বাংলাভিশন)
গত ১১ অক্টোবর একই দাবিতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে ইসলামী ছাত্রশিবির। ১৫ অক্টোবর একই স্থানে একই দাবিতে প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মী নিয়ে মিছিল ও সমাবেশ করে জামায়াত। (১৫ অক্টোবর, কালবেলা)
যে কোনো উপায়ে নির্বাচন
১৪ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিএনপি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। যেভাবেই হোক এ দেশে নির্বাচন হবেই। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দেবে। বিএনপি বিদেশে ধর্ণা দিচ্ছে। ওইসব ধর্ণা কাজে লাগবে না। জনগণের শক্তি বড় শক্তি। আমি জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করি, তাদের প্রতিই আমার আস্থা। আমার একটাই কথা, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছি। তারা ভোট দিলে আছি, না দিলে নাই।”
Discussion about this post