দেশে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থানের দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ নিয়ে আলোচনা। রবিবার (১৫ অক্টোবর) আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন, কিছুদিনের মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে, তারাই নির্বাচনকালীন সরকারে দায়িত্ব পালন করবে।
আগামী ১ নভেম্বর থেকে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। সংবিধান অনুসারে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এ সময়ে যে সরকার থাকবে, তা নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে পরিচিত হবে।
যদিও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রয়েছে।
রবিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনকালীন একটি সরকার থাকতে পারে। গতবার যেভাবে ছিল, ওটাই নির্বাচনকালীন সরকার। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এখতিয়ার। প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা ছোট করা দরকার বা যেভাবে আছে সেভাবে থাকা দরকার, এটা তার এখতিয়ার।
ওবায়দুল কাদের আরো জানান, (নির্বাচনকালীন সরকারের সময়ে) নির্বাচন কমিশন খুবই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে যাবে। তখন মন্ত্রী চলে যাবেন রুটিন দায়িত্বে। তখন মন্ত্রী বড় কোনো উদ্বোধন করতে পারবেন না। তখন সরকারের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে না। নির্বাচন–সম্পর্কিত সবকিছু নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করবে। এসপি-ডিসি যদি পরিবর্তন করার দরকার হয়, সেটাও তারা করবে। নির্বাচন কালে নির্বাচন কমিশনের যা যা চাহিদা, তা দিতে সংবিধান অনুযায়ী সরকার বাধ্য।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত দেখা গেছে মেয়াদ শেষে সরকার পদত্যাগ করত এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকত। আওয়ামী লীগের আন্দোলন ও দাবির মুখে এ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল বিএনপি। যার জন্য সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০১১ সালে এ ব্যবস্থা বাতিল হয়। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়। এরপর ২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচন হয় এই নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে। পরে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে এ ধরনের কোনো সরকার ছিল না।
যদিও বর্তমানে সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। তবে সুযোগ রয়েছে এ ধরনের সরকার তৈরির। দুইভাবে এ ধরনের সরকার হতে পারে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এক ধরনের নির্বাচনকালীন সরকারের ধারণা দিয়েছেন। তাতে আওয়ামী লীগের যারা এখন মন্ত্রী আছেন, তাদের সংখ্যা কমিয়ে দশ-বারো জন করা যায়। তবে ওই মন্ত্রিসভার সদস্য হতে হবে সংসদ সদস্যদের। তর্কের খাতির ধরা যাক, বিশজনের ছোটো মন্ত্রিসভা হলো এবং তাতে দুজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী নেয়া হলো। এ দুজনকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
তিনি আরেক ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে বুঝিয়েছেন, ‘আরেকটা অপশন হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেন কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগেরই অন্য কোনো সংসদ সদস্য তখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।’
যদিও সরকারের মন্ত্রীরা সবসময় বলে আসছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
শাহদীন মালিক আরো জানান, বর্তমান সংবিধানে সপ্তম ভাগে ১২৩ অনুচ্ছেদে নির্বাচন প্রসঙ্গে দুটি বিষয় উল্লেখ রয়েছে। যেটি হলো, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’।
তিনি বলেন, সংবিধানে নির্বাচনের সময় সংক্রান্ত দুটো বিধান আছে। একটা হলো সংসদ ভেঙ্গে দিলে। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেশে রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় সংসদ ভেঙ্গে দিতে পারেন। সংসদ ভেঙ্গে দিলে ভেঙ্গে যাওয়ার দিন থেকে তখন হবে কী, যারা সংসদ সদস্য ছিলেন তারা আর আসনে থাকবেন না এবং নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে।
‘তবে, আমাদের গত ২০১৪ এবং ১৮’র নির্বাচনে কিন্তু সংসদ রেখে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙ্গে দিলে বিরোধীরা কিছুটা হয়তো সমতার ব্যাপারটা চলে আসবে। সরকারি দলের বা যেই নির্বাচন করুক কেউই সংসদ সদস্য না। তখন কিছুটা হয়তো ফেয়ার প্লে হবে।’
এর আগে ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনে উপলক্ষে সংবিধানের ভেতরে থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে অংশীদার করার প্রস্তাব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই প্রস্তাবে বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। ওই প্রস্তাব বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছিল। পরে মন্ত্রিসভায় কিছুটা রদবদল হয়েছিল। তাতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার পাশাপাশি শরিকদের দু–তিন নেতাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রদবদল করা ওই মন্ত্রিসভাই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে কাজ করেছে।
তারও আগে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি সরকারি ও বিরোধী দল থেকে সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব দিলেও আওয়ামী লীগ সেটি গ্রহণ করেনি।
এবারও বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে আগ্রহী নয়। পদত্যাগ করার পর তাদের কোনো সংসদ সদস্যও নেই এখন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যেহেতু বিএনপির কোনো সংসদ সদস্য নেই, ফলে তাদের ছাড়াই নির্বাচনকালীন সরকার হবে।
রাজনৈতিক মহলে নির্বাচনকালীন সরকারের কয়েকটি তরিকা নিয়ে আলোচনা চলছে বলে কথা ভাসেছে। এর মধ্যে একটি হলো, নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ২০ জন মন্ত্রী থাকবেন। ২০ জনের মধ্যে ১০ জনের জন্য সরকারি দল ২০ জন দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবে। আবার বিরোধী দল বাকি ১০ জনের জন্য ২০ জন নির্দলীয় ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবে। জাতীয় সংসদ সরকারি দলের ২০ জন থেকে ১০ জন এবং বিরোধী দলের ২০ জন থেকে ১০ জনকে নির্বাচিত করবে। এই ২০ সদস্যদের মধ্য থেকে একজন প্রধানমন্ত্রী হবেন গোপন ভোটের মাধ্যমে। ব্যালটে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে লটারির মাধ্যমে একজনকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে।
অপর তরিকাটি হলো, বর্তমানে সংসদে আছেন এমন ১০ জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে, যারা পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেবেন না। এ ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে একজন বিশিষ্ট নাগরিককে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আলোচনাগুলো পুরোনো এবং এতে কোনো অগ্রগতিও নেই। এসব প্রস্তাব বিষয়ে গত সপ্তাহে সরকারের তথ্যমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়। তিনি বলেছিলে, নির্বাচনকালীন সরকার প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার (মন্ত্রিসভা) ছোট করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনকালীন সরকার (মন্ত্রিসভা) ছোট করা হয়নি। যে সরকার ছিল, সেই সরকারই দায়িত্ব পালন করেছে।
তার এই বক্তব্য থেকে অবশ্য একটি প্রশ্ন তৈরি হয়। আগের জাতীয় নির্বাচনে যেহেতু নির্বাচনকালীন সরকার ছিল না, তাহলে এখন থাকার দরকার কী? বিগত জাতীয় নির্বাচনে বরং নির্বাচনকালীন সরকার গঠন সহজ ছিল। তখন বিএনপিসহ প্রায় সব নিবন্ধিত দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। নিরপেক্ষ সরকারের দাবিও জোরদারভাবে ওঠেনি সেবার। এখন যখন সব দল ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা আওয়ামী লীগ সরকার অথবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না, তখন নির্বাচনকালীন সরকার কতটা প্রয়োজনীয়?
রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের ধারণা, এই নির্বাচনকালীন সরকারের সময় থেকে ঘুরে যেতে পারে পরিস্থিতি। আওয়ামী লীগ যেহেতু এ ধরনের একটা সরকারের বিষয়ে রাজি, তাহলে সুযোগ রয়েছে বিরোধীদের বিভিন্ন দাবিকে এর সঙ্গে যুক্ত করার। যার একটি হতে পারে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার বাইরে অন্য কাউকে নেওয়া এবং অন্যান্য দলগুলোর প্রতিনিধি রাখা।
তারা বলছেন, এ ছাড়া সংসদ ভেঙ্গে দিয়েও আওয়ামী লীগ পরিস্থিতি সহনশীল করতে পারে। এর ফলে তিনশ আসনে অনেকটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারে শেখ হাসিনা থাকলেও বিরোধীদের নির্বাচনে অংশ নিতে বলার যুক্তি দেখানো যাবে। এতে বিরোধীদের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি তৈরি হতে পারে।
অবশ্য তারা এও বলছেন, এই নির্বাচনকালীন সরকার কখন হবে তাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকার ছোট করার বিষয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সিদ্ধান্ত আসবে। যদি সেটা হয় তাহলে বিরোধী দলগুলোর জন্য আর কোনো আশা থাকবে না। ওই সময়ের পর নির্বাচনকালীন সরকারে তাদের অংশ নেওয়া মানে নির্বাচনেই অংশ নেয়া। তখন আর আন্দোলন করা যাবে না। যদি তফশিলের আগে নির্বাচনকালীন সরকার হয়, তাহলে বিরোধী দলগুলোর পক্ষে আন্দোলনের গতিবিধি নির্ধারণ সহজ হবে। সরকার সে সুযোগ তাদের দেবে না বলেই মনে হচ্ছে।
সর্বশেষ আরো একটি বিষয় রাজনীতিক মহল ভাবছে। সেটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবার বাংলাদেশের নির্বাচনকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তারাও নিশ্চয় এ নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে সেদিকে নজর দেবে। যদি আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের চেষ্টা চালায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখবে না বলেই অনুমান তাদের।
Discussion about this post