শুধু যে স্বৈরাচারী, একনায়কতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাতেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের পক্ষে কথা বলার দরকার পড়ে, তা নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও কথা বলে যেতে হয়। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, চিন্তাকেন্দ্র, অধিকার সংগঠন সবাইকে রাষ্ট্র ও সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় নজর রাখতে হয়। নইলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে পড়তে পারে। এর বড় উদাহরণ বাংলাদেশই।
২০০৮ সালে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে সরকারটিই স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের এই ক্রমিক রূপান্তর বিশেষভাবে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা সংহত করে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের দায় কতটুকু তা খোলা চোখেই দেখা যায়। কিন্তু যে আলোচনাটা কখনো ওঠে না, তা হলো- এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, অধিকার ও চিন্তা সংগঠনগুলোর ব্যর্থতাগুলো কী কী।
এদেশের নাগরিক ও বিদ্বৎসমাজ ওয়ান-ইলেভেন সরকার আসার আগে যে সক্রিয়তা ও তৎপরতা দেখিয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাদের সেই তৎপরতা রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে।
অনেকেই বলেন, ওয়ান ইলেভেন সরকার গঠনে তাদের দায় ও সেই সরকারের ব্যর্থতা তাদের সেই পথে ঠেলে দিয়েছে। তারা হঠাৎ করে তারা চুপ হয়ে গিয়েছে। কৃতকর্মের দায় এড়িয়ে নিজেদের নিরাপদ করতে তারা নতুন সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আর সরকার নাগরিক সমাজ নিয়ন্ত্রণের সুযোগগুলোর ষোলআনা সদ্ব্যবহার করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত পাড়া, এনজিও পাড়া, গবেষণা অঙ্গন, মিডিয়া পাড়া থেকে শুরু করে সর্বত্র ধীরে ধীরে তারা কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসনপ্রক্রিয়ায় নাগরিক ও বিদ্বৎ সমাজের প্রভাব কমিয়ে একে প্রায় অকার্যকর করে দিয়েছে।
শুধু অকার্যকর বললে কম বলা হবে। বলতে হবে ঋণাত্বক করে দিয়েছে। কেননা, এখন নাগরিক ও বিদ্বৎসমাজের যে ভূমিকা আমরা দেখতে পাই তার বেশিরভাগই কর্তৃত্ববাদী সরকারের পক্ষে। বড় অংশটি নিজেদের ভূমিকা পালন না করে, সরকারের পক্ষে কাজ করছে। আর যারা এখনও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে তারা নগণ্য, সংখ্যালঘু।
পরিস্থিতি খাদের কিনারায় গিয়ে ঠেকলেও এই অকার্যকর অংশটিই নাগরিক সমাজের সগর্ব পরিচয় নিয়ে আজও আমাদের সামনে উপস্থিত। আর পরিচয় বহন করলেও তারা কথা, চিন্তা ও কাজে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে অর্থপূর্ণ কোনো অবস্থান নিতে পারছে না।
আর এ কারণেই গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও এর কোনো পর্যায়েই নাগরিক সমাজের মধ্যে কোনো হেলদোল আমরা দেখতে পাই না। গণমাধ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রভাব অনুপস্থিত। চিন্তা সংগঠনগুলো উদ্যোগী হয়ে কোনো দিন নির্দেশনা দিতে পারছে না। যে কথা উচ্চস্বরে উচ্চারণ করা দরকার তা মিনমিন করেও খুব বেশি লোক বলতে পারছে না। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের পক্ষে নাগরিক সমাজের অনুপস্থিতি এসময়ের বড় লক্ষণ।
অথচ, মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে এদেশের নাগরিক ও বিদ্বৎ সমাজ যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সময়ও তারা মাঠে নেমেছে। পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময়েও তাদের বড় উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়েছে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, এবারের আন্দোলনে তারা একেবারেই অনুপস্থিত।
অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিকদের ঐতিহাসিক একটি সম্পর্ক আছে। এদেশের নাগরিক ও বিদ্বৎ সমাজের বড় অংশটিই আওয়ামী-ভারতীয় ন্যারেটিভের সাবস্ক্রাইবার। আর আওয়ামী লীগও সমাজের এই অংশটিকে মূল্যায়ন করে নিজের পাশে রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অপরপক্ষে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও অন্য ইসলামপন্থীদের সম্পর্কের কারণে বিদ্বৎ সমাজ দলটির কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। কিন্তু বিএনপি যখন ইসলামপন্থীদের সঙ্গে দূরত্ব রেখে উদার গণতান্ত্রিক ও বাম দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। নিজেদের গণতান্ত্রিক, উদার ও ইনক্লুসিভ চরিত্রে ফিরে এসেছে, তখন সমস্যা কোথায়? তাছাড়া আওয়ামী লীগ চলে গেলে বিএনপি আসবে এই ভয়ে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষেই বা নাগরিক সমাজ বিরামহীনভাবে সায় দেয় কীভাবে?
একথা আমরা সকলেই স্বীকার করি, পাঁচ বছর পরপর অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু, এটা ভিত্তি। এই ভিত্তিটুকু না থাকলে বাকী দাবি-দাওয়া আমরা পেশ করবো কীভাবে? ভাল নির্বাচনের ভিত্তি নিশ্চিত করেই তো রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুনভাবে গড়ে তোলার দাবিগুলো আমাদের জানিয়ে যেতে হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ গত ১৫ বছর ধরে চুপ থেকে থেকে বা সরাসরি পক্ষে দাঁড়িয়ে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে যেমন শক্তি যুগিয়েছে, তেমনি নিজেদের গুরুত্বহীন ও ফতুর করে ফেলেছে।
বহুদিন ধরে খেয়াল করলেও আমরা বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি প্রকাশনা সংস্থা আদর্শের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায়। সরকারের অপছন্দের তিনটি বই প্রকাশ করার দায়ে প্রকাশনা সংস্থাটির ওপর নানা ঝামেলা নেমে আসে। একুশে বই মেলায় প্রকাশনাটির স্টল বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েও এর সুরাহা পাওয়া যায়নি। এর আগে এমন ঘটনা আরো ঘটেছে। কিন্তু সেগুলো আলাপ-আলোচনা, মেনে মানিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে সমাধান হয়েছিল।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে আদর্শের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা বুঝতে পারি, এদেশে ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিকদের অবস্থা খুবই নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, দেশের বেশির ভাগ লেখকের মধ্যে এই উপলদ্ধিও কাজ করছে না যে, কর্তৃত্ববাদের আছর বহু আগে থেকে তাদের তৎপরতা ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। আমরা সে দফা নাগরিক ও বিদ্বৎ সমাজের পক্ষ থেকে খুব বেশি সাড়া পাইনি। পরিস্থিতি দেখে আমাদের মনে হয়েছে, ভিন্নমতাবলম্বী ও স্বাধীন বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও কথাবার্তা চালু করা দরকার। বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মানুষগুলোর পারস্পারিক বোঝাপড়া বাড়ানো দরকার। একা একা বা ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে এ লড়াই চালানো যাবে না।
খুব দ্রুত আমরা ‘লেখার স্বাধীনতা’ শিরোনাম একটি আয়োজন করি। পরবর্তী কয়েকটি কাজের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হই। আমরা অনুধাবন করি, সমাজে ও সংবাদ মাধ্যমে অকার্যকর যে অংশটিকে নাগরিক সমাজ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় এবং যারা কার্যত শাসকদের নিয়ন্ত্রণমূলক ন্যারেটিভের পুনরুৎপাদন ছাড়া আর কিছুই করেন না তাদের বাইরে অপেক্ষাকৃত তরুণদের একটি গোষ্ঠী সমাজে তৈরি হয়ে আছে। তাদের একত্রিত করাই মূল কাজ। দল-মত-আদর্শ নির্বিশেষে এই তরুণরা গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মতপ্রকাশ ও মানবাধিকারের দাবিতে একাট্টা হতে প্রস্তুত। খুব বিস্ময়করভাবে আমাদের এই মূল্যায়ন সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। দ্রুততম সময়ে আমরা লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক ও শিক্ষকরা মিলে চলমান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সমান্তরালে রাস্তার প্রতিবাদে নামতে সক্ষম হই। সমাজের নানা অংশ এত সম্পৃক্ত হয়। মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি একাডেমিক ও ঘরোয়া আলোচনাতেও আমরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্য করি।
অপেক্ষাকৃত তরুণদের এই তৎপরতা আগের প্রজন্মগুলোর বয়োজ্যেষ্ঠদের সংখ্যালঘুতা এখন অনেকটাই ঘুঁচিয়ে দিয়েছে। তারাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশের নাগরিক ও বিদ্বৎ সমাজের চেহারা নতুন একটি রূপ পরিগ্রহ করছে ধীরে ধীরে।
তবে একটি কথা না বললেই নয়, কার্যকর নাগরিক সমাজের অনুপস্থিতির বিষয়টি অনেক দেরিতে আমাদের নজরে এসেছে। সঙ্গতকারণেই ঐক্যপ্রক্রিয়াও বিলম্বিত থেকেছে। ন্যূনতম দাবিতে যারা একত্রিত হতে চেষ্টা করছেন তাদের মধ্যে পারস্পারিক বোঝাপড়া এখনো খুব গভীর নয়। চিন্তার প্রভেদ আছে, কর্মপদ্ধতি নিয়ে দ্বিমত আছে। বিদ্বৎ সমাজের লোকদের সব বিষয়ে একমত হয়ে একই কাতারে এসে দাঁড়ানোর ভাবনাটাও অলীক। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ন্যূনতম বিষয়ে তাদের একমত হতেই হবে। এজন্য কথা বলার যে পরিসরগুলো দরকার তা আমাদের সমাজে অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের জন্য চলমান আন্দোলনগুলো কিছু পরিসর তৈরি করেছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। নতুন পরিসর সৃষ্টি ও পুরনো পরিসরগুলো প্রসারিত করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
গণতন্ত্রের জন্য চলমান আন্দোলনে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষকরা অল্প হলেও রাস্তায় নামছেন। যত অল্পই হোক, এটা খুব জরুরি। কিন্তু তাদের কাজের আসল জায়গা চিন্তাচর্চায়, সৃজনশীলতায়। তাদের স্পেসগুলো তাদের দিতে হবে। রাজনীতির অঙ্গনে যারা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে চিন্তাকেন্দ্রগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত সংযোগ স্থাপন করা গেলে আজকের হতাশাজনক অবস্থান থেকে আমরা বের হতে পারবো একদিন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সুসময় ফিরে এলেও সমাজের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করার কাজ বন্ধ করা যাবে না। স্বাধীন বুদ্ধিজীবীদের স্পেস নষ্ট না করে সেগুলো বাড়িয়ে তুলতে হবে। সামনের ভাল দিনে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই স্বাধীন চিন্তা গড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করে একে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করতে হবে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সংস্কার বুলেটিনের জন্য লেখা
Discussion about this post