আজ সকালে ডোনাল্ড লু’র চিঠি নিয়ে একটি জটিলতার অবসান হলো। সচিবালয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করে চিঠি পৌঁছে দিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস।
চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করে সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্যও দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, চিঠিটি তিনি দেখেছেন। চিঠিটি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাকেই লেখা হয়েছে। কিন্তু তিনি একা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। তিনি দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। পারলে আজই কথা বলার চেষ্টা করবেন।
তবে সংলাপ বিষয়ে তার বক্তব্য হলো, আওয়ামী লীগ যখন শর্তহীন সংলাপের কথা বলেছে তখন বিএনপি সাড়া দেয়নি। তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি ইত্যাদি দাবি তুলেছে। এখন নির্বাচন কমিশন তফশিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সংলাপের সময় ও সুযোগ আছে কি না তা ভেবে দেখতে হবে। কেননা, দল তো শুধু জাতীয় পার্টি ও বিএনপি নয়। সংলাপ করতে হলে ১০০ দলের সঙ্গেই বসতে হবে। সে সময় এখন নেই।
সাংবাদিকরা তখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে কি সংলাপের সম্ভাবনা নেই?
তিনি উত্তর দেন, সংলাপের সুযোগ নেই। তবে তিনি দলীয় সভাপতির সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে জানাবেন। সাংবাদিকরা তখন তাকে প্রশ্ন করেন, তাহলে কি এবারও বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন হতে যাচ্ছে? তিনি উত্তর দেন, আস্ক বিএনপি।
ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে পিটার হাস দেখা করার পর বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু সাংবাদিকদের সঙ্গে তার কথার লাইভ দেখে আমার মনে হয়নি, তিনি সংলাপের সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন। বরং আমার মনে হয়েছে, সরকার আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে, দেখানোর জন্য হলেও সংলাপ করতে চায়। কিন্তু, প্রকাশ্যে এ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতে চায় না।
গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘আমাদের সংলাপে আপত্তি নেই। আমরা গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চাই না। গণতন্ত্র সমুন্নত করতে যা যা করা দরকার, তা–ই আমরা করব। সেখানে যদি সংলাপের প্রয়োজন হয়, আমরা সেটা করব। কিন্তু কার সঙ্গে করব, সেটা বিবেচনার বিষয় আছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’ (প্রথম আলো, ১৪ নভেম্বর)।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় অর্থহীন একটি উত্তর দিয়েছেন। প্রধান তিন দলকে চিঠি দিয়ে ডোনাল্ড লু স্পষ্টভাবেই বলেছেন, রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দেশের প্রধান তিন দলকে শর্তহীন সংলাপ করতে হবে। সেখানে কার সঙ্গে সংলাপ করবো, সেটা পাল্টা প্রশ্ন হতে পারে না। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, সংলাপের প্রয়োজনীয়তা তিনি অস্বীকার করেননি। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ওয়ার্কাস পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননও গতকাল ১৪ দলের জনসভায় বক্তব্য দিয়ে সংলাপের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, শর্তহীন সংলাপ করতে হলে বিএনপিকে সরকার পতনের এক দফা প্রত্যাহার করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, বিএনপিকে এক দফা প্রত্যাহারের পাশাপাশি সহিংসতা পরিত্যাগ করতে হবে।
১৪ নভেম্বর মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে ১৪–দলীয় জোট আয়োজিত ‘শান্তি ও উন্নয়ন’ সমাবেশে এসব কথা বলেন রাশেদ খান মেনন। (১৪ নভেম্বর, প্রথম আলো)
মজার ব্যাপার হলো, শর্তহীন সংলাপের কথা মানলেও নিজে কয়েকটা শর্ত জুড়ে দিতে ভুলছেন না রাশেদ খান মেনন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গীরা শর্তহীন সংলাপ বলতে বোঝাচ্ছেন, বিএনপিকেই শুধু শর্তছাড়া আলাপে আসতে হবে, আর তারা নানা শর্ত দিয়ে যাবেন।
ড. কামাল হোসেনও গতকাল ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলেছেন। তিনি এর আগেও সংলাপের কথা বলেছেন। সম্ভবত, ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে তিনি ও বদিউল আলম মজুমদার প্রথম সংলাপের আহবান জানিয়েছেন।
মজার ব্যাপার হলো, সরকার-ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত ছয়টি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলও গতকাল সংলাপের আহবান জানিয়েছে। এই দলগুলো হলো- বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, মুসলিম লীগ (বদরুদ্দোজা আহমেদ-কাজী আবুল খায়ের) ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।
এই নিউজে প্রথম আলোর সেলিম জাহিদ কয়েকটি কৌতুহল-উদ্দীপক তথ্য দিয়েছেন। তা হলো- ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তফসিল ঘোষণার আগে হঠাৎ ‘রাজনৈতিক সমঝোতার’ জন্য ইসলামি এই দলগুলোর এমন অবস্থানের পেছনে সরকারি মহলের সায় আছে। তারা চাইছে, এ ধরনের একটি উদ্যোগ থাকুক। সংলাপে কার্যকর কিছু না হলেও এর লক্ষ্য, সরকার যে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে সচেষ্ট, সেটি আন্তর্জাতিক মহলকে দেখানো। একই সঙ্গে বিএনপিকে আরও চাপে ফেলাও এর লক্ষ্য।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভেতর থেকে জানা যায়, সংলাপ বা রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে পশ্চিমা প্রভাবশালী একাধিক দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে সরকারের দিক থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ হয়েছে, এমনটা জেনেছে ওই দলগুলো। যাতে নির্বাচন সামনে রেখে তারা একটা উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নেবেন বলে সরকারের একটি মহল থেকে তাদের কাউকে কাউকে প্রায় দুই সপ্তাহ আগেই আভাস দেওয়া হয়।
গত সপ্তাহেই এক যৌথ বিবৃতি দিয়ে পাঁচদলীয় রাজনৈতিক মোর্চা ‘সমমনা ইসলামি দলগুলো’ নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) তফসিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানায়। তারা বলেছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচনের দাবি উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হতে পারে।’ (১৪ নভেম্বর, প্রথম আলো)
সংলাপের জন্য সরকার-ঘনিষ্ট ইসলামপন্থী দলগুলোর এই আহবানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের আহবান।
আপনাদের মনে পড়বে, এ বছরের ১৫ জুলাই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সভা আয়োজন করে ব্যবসায়ীরা বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। এ বিষয়ে ১৬ জুলাইয়ের প্রথম আলোর সংবাদ থেকে জানা যায়, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চান দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলেছেন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেই ভবিষ্যতেও শেখ হাসিনার সরকার দরকার। শনিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যবসায়ীদের করণীয়’ শীর্ষক সম্মেলনে দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা ও শিল্পোদ্যোক্তারা এসব কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি ছিলেন।
অনুষ্ঠানে সব মিলিয়ে ৩১ জন ব্যবসায়ী বক্তব্য দেন। তাঁদের বেশির ভাগ সরাসরি বলেছেন, আগামী মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে চান তাঁরা। কেউ কেউ পরোক্ষভাবে তা বলেছেন। কয়েকজন স্লোগানে স্লোগানে একই দাবি জানান। দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যবসায়ী গানে গানে আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে দেখার অনুভূতি প্রকাশ করেন।‘
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ এই সংগঠনটিই গতকাল একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের তাগিদ দিয়েছে।
‘রাজনৈতিক সহিংস কর্মকাণ্ডে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম।
এই অবস্থায় ব্যবসায়িক পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতাদের কেউ কেউ। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলেছেন এ বিষয়ে এফবিসিসিআই ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এফবিসিসিআইকে বৈঠকে বসার।
রাজধানীর গুলশানে এফবিসিসিআইয়ের কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এক রুদ্ধদ্বার মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ী নেতারা এই পরামর্শ দেন। সভায় বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদও অংশ নেন। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের অংশগ্রহণে এই সভা আহ্বান করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মাহবুবুল আলম।
সভায় বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতা, ডলার–সংকট, মূল্যস্ফীতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকঋণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এফবিসিসিআইয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
সভায় অংশ নেওয়া একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তাঁরা এফবিসিসিআইকে সক্রিয় হওয়ারও আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংস বা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কর্মসূচি না নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে এফবিসিসিআইকে অনুরোধ করেন।’ (১৫ নভেম্বর, প্রথম আলো)
এই খবর অনেকের মধ্যে বিস্ময় তৈরি করলেও, এটা প্রকারান্তরে এই বার্তাই দিচ্ছে যে, সরকার সংলাপ করতে আগ্রহী। সরকারের সম্মতি ছাড়া এফবিসিসিআই এ ধরনের কথা বলবে না বলেই অনেকে বিশ্বাস করেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের নতুন অবস্থানের পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে গার্মেন্ট খাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন, গার্মেন্ট খাতে প্রায় ৩৫% অর্ডার কমে যাওয়া, অনেক ছোট কারণে গার্মেন্ট পণ্য প্রত্যাহারের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা উপলদ্ধি করতে পারছেন, একতরফা নির্বাচন হলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে।
গত ১০ নভেম্বর গণভবনে একটি সভায় প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চেয়েছেন। যুগান্তরের খবর- ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি ঠিক রাখতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চেয়েছেন। দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এখন একটা অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়ছে, সেখানে আপনাদেরও একটু নজর দিতে হবে। আপনারা সহযোগিতা করবেন যেন আমাদের অর্থনীতি কোনোমতেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।‘
আমার অনুমান হলো, সরকার-সমর্থক এফসিসিসিআই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতায় মধ্যস্থতা করতে চায়। গতকালের সভায় তাদের সাবেক একজন সভাপতিও বলেছেন, ‘২০১৪-১৫ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় এফবিসিসিআই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছিল। এবারও তেমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’ (১৫ নভেম্বর, প্রথম আলো)
সংলাপ নিয়ে যেসব খবর এ পর্যন্ত সামনে এসেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, সংলাপের ব্যাপারে সরকার অনমনীয় নয়। বরং তারা দেখানোর জন্য বা সময় ক্ষেপনের জন্য হলেও সংলাপ করতে চায়। তবে বিএনপি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। আসা কঠিন। কারণ, তাদের অধিকাংশ নেতাই কারাগারে বা আত্মগোপনে। এ অবস্থায় তারা কীভাবে দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নেবে? সংলাপে মধ্যস্থতা কে করবে সে আভাসও সাম্প্রতিক খবরগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমা কোনো কূটনীতিক অথবা এফসিসিসিআই মধ্যস্থতায় সংলাপের ইঙ্গিত দেওয়া হলেও আমার মনে হয়, সংলাপে মধ্যস্থতার দায়িত্ব নেবেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত খবরে যা জানা যাচ্ছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র চিঠিটি প্রথম পেয়েছে জাতীয় পার্টি। বিএনপির কাছে পাঠানো চিঠি কবে কোথায় কখন কার কাছে দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো খবর জানা যায়নি। বিএনপি প্রতিক্রিয়া কী, তাও স্পষ্ট নয়। আওয়ামী লীগের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু চিঠি পাওয়ার পর জাতীয় পার্টি বেশ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। সম্ভবত রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বনানীতে আসার আগে সম্প্রতি জিএম কাদের মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু প্রাথমিক যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন সেটিও বেশ ইতিবাচক ছিল।
১৩ নভেম্বর চিঠি পাওয়ার পর ১৪ নভেম্বর জিএম কাদের বলেন, ‘নির্বাচনে যাওয়ার এখনও পরিবেশ তৈরি হয়নি। নির্বাচনে গেলে স্যাংশন আসারও সম্ভাবনা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি এসেছে আমাদের কাছে। এই চিঠির গুরুত্ব অনেক। এটা যুক্তরাষ্ট্রের অফিশিয়াল চিঠি। তারা সংলাপ চাচ্ছেন। আমরাও সংলাপের কথা বলে আসছি। আমরা আর কোনো দলের মুখাপেক্ষী থাকতে চাই না। আমরা এখন দলগতভাবে অনেক শক্তিশালী।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন সিদ্ধান্ত নেবার। নানা বিষয়ে আমাকে ভেবে দেখতে হচ্ছে। এই অবস্থায় যদি আমরা নির্বাচনে যাই আর যদি পরবর্তীতে সরকার সমস্যায় পড়ে তাহলে কী হবে? দেশে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয় এবং সরকার যদি সংলাপ না করে তাহলে নির্বাচনে গেলে আমাদের ওপর স্যাংশন আসতে পারে। যদি আলাপ-আলোচনা না করে তাহলে সরকারের ওপর নিশ্চিতভাবে বড় ধরনের স্যাংশন আসতে পারে।‘
(১৪ নভেম্বর, যুগান্তর)
কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির জরুরি ওই সভায় মাঠপর্যায়ের নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দেন। এমনকি তারা বিএনপির সঙ্গে জোট বাধার কথাও বলেন।
১৪ নভেম্বর রাতেই জিএম কাদের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। অনেকেই মনে করেছেন, দলীয় সভায় তার বক্তব্য হয়তো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার পর পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন আলামত মেলেনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি বিভিন্ন সময়ে ডিসাইডিং ফ্যাক্টরে পরিণত হয়েছে। ২০১৪ নির্বাচনের আগে আমরা এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি। সেবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে চাপ দিয়ে নির্বাচনে এনেছিলেন। তখন বলা হয়েছিল, জাতীয় পার্টি ট্রাম্প কার্ড। এই কার্ড খেলেই ভারত আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে এনেছিল। তবে সেবার জাতীয় পার্টিকে বোঝাতে সুজাতা সিংকে কেন নিজে আসতে হয়েছিল সেটি স্পষ্ট নয়। কেননা, ভারতের সঙ্গে জাতীয় পার্টির বন্ধুত্ব অনেক পুরনো ও গভীর। ধারণা করা হয়, ভারতের সমর্থন নিয়ে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। এই দফা ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলের বাইরে এরশাদের ৯ বছরের শাসনে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত সবচেয়ে স্বস্তিতে ছিল একথাও বলা হয়। জাতীয় পার্টির শাসনামলে আওয়ামী লীগ যে তাদের সহায়তা করে গিয়েছে সেখানেও ইন্ডিয়া ফ্যাক্টর কাজ করতে পারে। এখন আওয়ামী লীগ শাসনামলে জাতীয় পার্টি হয়তো সেই ঋণই শোধ করে চলেছে।
জাতীয় পার্টির পক্ষে শেষ পর্যন্ত ভারত ও আওয়ামী লীগের প্রভাব বলয়ের বাইরে গিয়ে বড় ভূমিকা নেওয়া সম্ভব হবে কি না সেটা বড় প্রশ্ন। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি জাতীয় পার্টিকে হাত করতে পারে তবে এই কার্ড দিয়েই তারা ওভারট্রাম্প করতে পারবে।
তবে জিএম কাদের মধ্যস্থতার ভূমিকা নিলে ভারত অখুশী হবে না। ভারতে চারদিনের সফরের পর গত ২৩ আগস্ট সাংবাদিকরা জিএম কাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর যে মতদ্বৈধতা, এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান কী। জবাবে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেন, ‘ভারত বলেছে, এটা আপনাদের নিজস্ব ব্যাপার। আমরা চাই, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটার সুরাহা করবেন।’
এ ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্মকর্তারা জাতীয় পার্টিকে উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার কথাও বলেছেন বলে জানান জি এম কাদের। তাঁরা বলেছেন, যেহেতু জাতীয় পার্টির সবার কাছে একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, তাই সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, সবাইকে একসঙ্গে করে, সুন্দর একটা নির্বাচন করতে পারলে তারা খুশি হবেন। (২৩ আগস্ট, প্রথম আলো)
যেই মধ্যস্থতা করুন, একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংলাপে কি সমঝোতা হবে?
আমার উত্তর হলো, সংলাপে সমঝোতা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সরকার পক্ষ যদি ছাড় দেয় তবে কিছু অগ্রগতি হতে পারে। তবে সরকারকে ছাড় দেওয়ার মতো অবস্থানে বিরোধী দলগুলো এখনও নিতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগও পর্যাপ্ত নয় বলেই মনে হচ্ছে। তারা ধীর পদক্ষেপে আগাচ্ছে। মার্কিন চাপ সরকারকে সংলাপে বসাতে পারলেও অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে যেতে বাধ্য করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সংলাপ পর্যন্ত যেতেও রাজি নাও হতে পারে। তফশিলের সময়ে সংলাপের আহবানকে তারা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে বলে আজ প্রথম আলো জানিয়েছে। ডোনাল্ড লু’র চিঠির গভীর তাৎপর্য আছে। শেষ পর্যন্ত সেই তাৎপর্যকে আওয়ামী লীগ কীভাবে ব্যাখ্যা করে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। নয়াদিল্লিতে মার্কিন ও ভারতীয় পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের মধ্যকার টু প্লাস টু বৈঠকের পর এই চিঠি এলো। ফলে, একটি বার্তা তো স্পষ্ট, ভারতীয় সাংবাদিকরা যা বলেছেন তা ঠিক নয়। ভারতের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
তফশিল ঘোষণার পর মার্কিনী চাপ বাড়তে পারে বলে কেউ কেউ অনুমান করছেন। সেক্ষেত্রে তফশিল ঘোষণা কোনো ফ্যাক্টর নয়। ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টি নিয়ে যে নাটকগুলো হয়েছে সেগুলো তফশিল ঘোষণার পর হয়েছে। ২০০৬ সালে তফশিল ঘোষণার পর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে নির্বাচনের কয়েকদিন বাকী থাকতে ইয়াজউদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পতন হয়েছিল। ফলে, তফশিল ঘোষণার পর সব শেষ হয়ে যাবে না। পিকচার আরও বাকী থাকবে।
পুনশ্চ : হাতের ব্যথার কারণে কয়েকদিন লিখতে পারিনি। কয়েকটি পডকাস্ট করেছি। সেগুলো আপনারা শুনতে পারেন।
নিচে লিংক দিচ্ছি।
ব্যবসায়ীরা কেন হঠাৎ করে সংলাপ চাইছেন?
জিএম কাদের কোন ভূমিকা নিতে যাচ্ছেন?
Discussion about this post