আগস্টে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বলা হচ্ছে, খাদ্যে মূল্যস্ফীতির এই হার ১১ বছর সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমার তো মনে হয়, খাদ্যে মূল্যস্ফীতির এই হার স্বাধীনতার ৫১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমি আমার বোধ হওয়ার পর থেকে খাদ্য পণ্যের এমন লাগামহীন দাম কখনো দেখি নাই। নিকোস কাজানজাকিস বিখ্যাত গ্রন্থ ‘জোরবা দ্য গ্রিক’-এ জার্মানির দুর্ভিক্ষের সময়কার চিত্র দেখাতে গিয়ে বলেছেন, ‘মুদ্রামান এত নেমে গেছে যে সামান্য কিছু কিনতে হলেও আপনাকে বস্তা ভরে টাকা নিয়ে বাজারে যেতে হবে।’ এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যদি চরম সংকটময় অবস্থায় না থাকি, তাহলে আমাদেরও কেন পকেট ভরে টাকা নিয়ে বাজারে যেতে হচ্ছে! প্রতিটি পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মাছ, মাংস, শাক-সবজি সব ছাপিয়ে এমনকি আলুও এখন দুর্মূল্য। এক সময়ে এমন একটা স্লোগান আমরা প্রায়ই শুনতাম- ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান’। উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধানের চাষাবাদ ব্যাপক হারে শুরু হওয়ার আগে ভোক্তার চাহিদা মেটাতে ভাতের বদলে আলু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হতো। এতে করে বোঝা যায়, আলু বরাবরই এ দেশে একটা উচ্চফলনশীল সহজলভ্য খাবার। ভাতের পর বাংলাদেশে যে খাবারটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় তা হলো আলু। সব খাবারের সঙ্গে মিশে যেতে পারে আলু। শিশুদের পছন্দের সবজিও আলু। আবার একক খাদ্য হিসেবেও আলু যথেষ্ট কার্যকর।
বর্তমান বাজারে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের মধ্যে মানুষ খাদ্য হিসেবে অধিক হারে আলুর ওপর নির্ভর করছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, অভাবীরা সবজিসহ সব জিনিসের অতিরিক্ত মূল্যে হিমশিম খেয়ে আলুর ওপরেই বেশি নির্ভর করছে। সেই আলুর দাম হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। মূল্য পৌঁছেছে কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
এদেশে আলুর চাহিদা ৭৭ লাখ টন হলেও গত বছর ১ কোটি ৯ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। অর্থাৎ চাহিদা মেটানোর পরও উদ্বৃত্ত থাকার কথা ৩২ লাখ টন।
কৃষিবিদদের মতে, আলু আমাদের দেশে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় একটা ফসল। স্বল্পমেয়াদি এ ফসলটির উৎপাদন আয় অন্যান্য ফসলের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে আলুর যে চাহিদা তার বিপরীতে দ্বিগুণ আলু উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৫০ হাজার টন আলু রপ্তানি করা হয়। প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটিরও বেশি টাকা আলু রপ্তানি থেকে আয় করে বাংলাদেশ।
নিঃসন্দেহে এটা শুভ লক্ষণ হওয়া উচিত ছিল ভোক্তা এবং কৃষকের জন্য। অথচ এদেশে ভোক্তা এবং কৃষক কেউই সেই সুফল ভোগ করতে পারেন না। একই ঘটনা আমরা দেখি ধানের ক্ষেত্রেও। চালের মূল্য অত্যধিক। অজুহাত দেখানো হয় যে, চালের দাম কমালে কৃষকের ক্ষতি, কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কৃষক ধান উৎপাদন করে তার উৎপাদন খরচও তুলে আনতে ব্যর্থ হচ্ছে।
মধ্যস্বত্বভোগীদের কবলে পড়ে পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়, যার মূল্য দিতে হয় ভোক্তা এবং কৃষক উভয়কেই। আলুর মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে আলু কেনা হয় ১১ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে। যা কোল্ড স্টোরেজ বা হিমাগারে গিয়ে দ্বিগুণ হয়ে যায় আর তারপর পৌঁছায় পাইকারের হাতে। খুচরা বাজার থেকে কিনতে হয় তিনগুণ দামে। সেই মূল্য পরিশোধেও এদেশের ক্রেতারা কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। কিন্তু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যদি সুযোগ বুঝে আলুর মতো একটা সহজলভ্য, উচ্চফলনশীল পণ্যের দাম চারগুণ বাড়িয়ে ক্রেতাকে কিনতে বাধ্য করে তখনই বাধে বিপত্তি।
অনেক সময় দেখা যায়, সরকার কোনো একটা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সেটা কেউ মানছে না। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের সঙ্গে বাজারের কোনো মিলই থাকে না। কারণ বাজারের কারসাজি রোধে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা যথাযথ সময়ে নেওয়া হয় না। যে কোনো সময় নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক এখানে। আর দাম একবার বাড়লে কখনোই আর আগের জায়গায় ফিরে আসে না। এভাবে সাধারণ মানুষের ব্যয় দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
যদি মেনে নেই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, ডলার সংকট ইনফ্লেশন ইত্যাদি কারণে আমদানিকৃত পণ্যের দামও বাড়তে পারে, কিন্তু হিমাগারে থাকা আলুর দাম বেড়ে যায় কীভাবে? এক্ষেত্রে যদি অজুহাত দেখানো হয় ক্রেতা অন্যান্য সবজি কিনতে পারছে না বলে আলু বেশি কিনছে তাহলেও যে খাদ্য হিসেবে আলুর চাহিদা ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে, সে কথা বলা যাবে না। আর যদি বাড়েও তাহলেও সেই ৫০ শতাংশ বাড়তি উৎপাদন তো হয় এদেশে। অথচ আলুর দাম বেড়েছে ১১১ শতাংশ।
এক্ষেত্রে একটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যদি কারসাজি করে অন্যান্য সবজির সঙ্গে তাল রেখে আলুর মতো একটা নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা নেমে আসে। কিন্তু সেদিকে কার খেয়াল আছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে অভিযান চালায় তাতে কিছু চুনোপুঁটি ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও মূল হোতারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই সিন্ডিকেটটা দমাতে সরকার বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে।
অনেক সময় গুজব সৃষ্টি করেও দাম বাড়াতে দেখা গেছে এসব সিন্ডিকেটকে। পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা যখন এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তার পেছনে নিশ্চই অন্য কারণ থাকে, যা খতিয়ে দেখা দরকার। আবার ব্যবসায়ীরা যদি রাজনীতিতে বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকে, বা কোনো না কোনোভাবে স্টেকহোল্ডারের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে এ ধরনের সিন্ডিকেট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যার কুফল ভোগ করতে হয় মধ্য ও নিম্ন আয়ের ক্রেতাসাধারণকে। প্রয়োজন না থাকলেও সরকার এয়ারবাস কেনার ঘোষণা দিতে পারে, দ্বিতীয় স্যাটেলাইট কেনার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে, শুধু বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে তাদের আন্তরিকতা দেখা যায় না, এই যা আফসোস!
Discussion about this post