১৯৭৫ সাল। ৩ মার্চ। সোমবার। কবি আবুল হাসান ঢাকায়। শিল্পী বন্ধুর বাড়ি বার্লিনে। একজন বাংলাদেশে, অন্যজন জার্মানিতে। কত দূর, তবু চিঠির ভাষা কত আপন। কত মধুর। কত বিপদাপন্ন। কত বিষণ্ন।
হ্যাঁ; হয়তো কেউ কেউ শিরোনামে হোঁচট খাচ্ছেন? খাওয়ার কথা। হঠাৎ কেন বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) নিয়ে টানাটানি? নানা কারণে। অনেকেই ইদানিং বাকশাল নিয়ে লিখছেন। বাকশালের উপকারিতা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে। এসব ভালো খবর। শুনতেও মন্দ লাগে না। কিন্তু হঠাৎ চোখের সামনে বইটা পড়ে গেল! কবি আবুল হাসানের চিঠি নিয়ে তাই সামান্য আলাপ। সে সব ভয়ংকর দিন আমাদের দেখতে হয়নি। কিন্তু সেসব দিনের উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ একজন কবি কীভাবে উপলদ্ধি করছেন? কীভাবে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন? সেসব কিছুটা টুকরো টুকরো ভাঙা আয়নার মতো তুলে ধরতে চাই।
প্রিয় রাইনহার্ট,
‘শেখ মুজিবুর রহমান সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করেছেন। আমার দেশে এখন একটাই দল। সব কটা কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দল এখন বিলুপ্ত। সব দলের কর্মীরাই এখন শেখ মুজিবের দলে যোগ দিচ্ছে। তিনিই এখন দলের নিরঙ্কুশ কর্তা এবং দলের সভাপতি। দেশে ফেরার পর থেকে আমার ভালো লাগছে না। আর কখনো ভালো লাগবে বলেও মনে হয় না। এর কারণটা বোধ হয় তোমার জানা।’
উপরের লেখাটা ৬ নম্বর চিঠির। চিঠির নিচে বাসার ঠিকানা নেই। কিন্তু ৫ নম্বর চিঠিটি লেখা, টিপু সুলতান রোডে, দৈনিক গণকণ্ঠ অফিসে বসে। এই চিঠির অক্ষরে অক্ষরে অস্থিরতা। অনিশ্চয়তা। হতাশা।
কবি কি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন দেশের ভবিষ্যৎ? মানুষের ভাগ্য? কবিরা ভবিষ্যৎ দেখতে পান? নাকি ভবিষ্যৎ কবিদের দেখে-শুনে রাখে? সেসব উত্তর সময়-ই ভালো দিতে পারবে। কিন্তু আবুল হাসানের চিঠির ভাষা। আমাদের রোমকূপ খাড়া করে তোলে!
পক্ষে-বিপক্ষে অনেক তর্ক জমা হয়েছে ৫০ বছরে। এত উন্নতির পরও এখনো সেই একই রূপ আমাদের সামনে হাজির। আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আগামী মাস কীভাবে কাটবে? কত কত অনিরাপত্তা আমাদের চারপাশে। যেন এ দেশের মানুষ একেকটা পাখি। কে কার ফাঁদে কখন ধরা পড়বে কেউ জানে না।
আমাদের স্বপ্ন, আমাদের বর্তমান, আমাদের ভবিষ্যৎ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে চোখের সামনে। অধিকার হরণ করা হচ্ছে। রাতে ভোট হচ্ছে। অন্ধকারে সরকার হচ্ছে। জনগণের তবু হচ্ছে না সকাল!
যাক। খামোখা খেই হারিয়ে লাভ নেই। মূল কথায় ফিরি। এটা বিদেশি শিল্পীবন্ধুকে কবি আবুল হাসানের লেখা চিঠির একাংশ। আরও কিছু চিঠি পাঠ করবো। সে সব চিঠিতেও উঠে এসেছে উৎকণ্ঠা। বেকারত্ব। দলীয় দালালদের চাকরি-বাকরি। ভিন্নমতের ওপর নানামাত্রিক অভিঘাত। যেন সময় মোটেও এগোয়নি। সেই বাংলাদেশ আর এই বাংলাদেশের কোনো পার্থক্য নেই। তাই এই লেখা। সময়কে ইতিহাসের পাতায় রেখে সামান্য বন্টন করার তাগিদ। এ যেন আয়নায় নিজেকে দেখা।
এ বইটিতে আবুল হাসানের ১৩টি চিঠি পাওয়া যায়। প্রথম চিঠিটি ১৯৭৪ সালের ৩ ডিসেম্বর লেখা। শেষ দুটি চিঠির তারিখ পাওয়া যায় না। কিন্তু ১১ নম্বর চিঠি ১৯৭৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে লেখা। আর কবি আবুল হাসানের মৃত্যু হয় ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর। পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)।
পরের চিঠিতে, ১৯৭৫ সালের ১০ মার্চ ৭ নম্বর চিঠির শেষের দিকে কবি আবুল হাসান বন্ধুকে লিখছেন—
‘প্রিয় বন্ধু, দুর্ভাগ্যবশত আমি জন্মেছি এমন একটা দেশে, যেখানে মানুষ এখনো না খেতে পেয়ে মারা যায়। তুমি তো জানো না, শহরজুড়ে হাজার হাজার গৃহহীন ভিখিরির ভিড় দেখে আমার কী রকম মন খারাপ হয়! আমি জানি না কবে এই নিঃস্ব মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটবে, কবে তাদের স্বপ্নপূরণ হবে? আমার দেশের মানুষগুলোর জন্য তুমি প্রার্থনা কোরো, রাইনহার্ট, যাতে তারা শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারে, দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে শান্তি আর সম্প্রীতি গড়ে তোলার কাজে নিজেদের যুক্ত করতে পারে।’
সময়ের কী অদ্ভুত মিল। তখন খেতে না পেরে মারা গেছে। এখন মশার কামড়ে মারা যাচ্ছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা না পেয়ে লাশ হচ্ছে শিশু। শত শত শিশু নাই হয়ে গেল। তবু কারো কোনো দায় নেই। দিশা নেই। ব্যথা নেই। ভরসা নেই। এখনো তো শহরজুড়ে ভিখিরির মেলা। গাড়িতে উঠতে ভিক্ষুক হাত পাতে। ফুটপাতে হাঁটতে গেলে সামনে এসে দাঁড়ায়। চা খেতে গেলে হাত বাড়িয়ে দেয়। পাশে বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা ‘ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা’! তাদের চোখে কোনো ফাঁকি নেই। সত্যিই তারা অভাবী। যতই উন্নতি হচ্ছে ততোই ভিখারি বাড়ছে। কী চমৎকার উন্নয়ন। কিন্তু মানুষের কোনো উন্নতি নেই। মানুষ দিনকে দিন পাল্লা দিয়ে অমানবিক আচরণ করছে। পুলিশ হেফাজতে মরছে নিরীহ যুবক। বিচারক বলছেন ‘দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন!’ আর কত উন্নতি হবে একটা জাতির? আমরা এত উন্নতি চাই না। আমরা চাই অগ্রগতি। প্রগতি আর সুমতি। সুশিক্ষা আর চিকিৎসা। কবি আবুল হাসানের মতো আমাদের মন খারাপ হয়। মানুষের মুখে আমরাও হাসি দেখতে চাই। কিন্তু সে হাসি দেখার জন্য আর কত অপেক্ষা করতে হবে বুড়িগঙ্গা?
কী আত্মঘাতী পরিকল্পনা। সবুজ একটা দেশকে কংক্রিটের শহর বানাতে চায়। যেখানে সারা পৃথিবী শহরকে গ্রাম বানাতে ব্যস্ত সেখানে আমাদের মায়াহরিণগুলো গ্রামকে শহর বানাতে ব্যতিব্যস্ত।
৮ নম্বর চিঠি। মার্চের ১৭ তারিখে লেখা। এই চিঠিতে জার্মান প্রেমিকা গাব্রিয়েলার কথা লিখেছেন কবি। ‘রাইনহার্ট, আজ আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই, গাবিকে কী তীব্রভাবেই না আমি ভালোবেসেছিলাম! …. তুমি আমার অশ্রু আর কান্না তার কাছে পৌঁছে দিয়ো। তার সুরভিত ফুলেল অনুভব আমি এখনো ভালোবাসি।’
৯ নম্বর চিঠি। এটা লেখা মার্চের ২৪ তারিখে। এখানে উঠে এসেছে ঢাকার কয়েকজন নামজাদা শিল্পীর স্মৃতি। মুর্তজা বশীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডা। বন্ধু মাহফুজুল হক খানের সঙ্গে তখন থাকতেন। এসেছে ‘পৃথক পালঙ্ক’ প্রকাশের ইঙ্গিত ও ইশারা।
১৯৭৫ সালের মে মাস। ১৩ তারিখ। লিখছেন দেশের দুর্দশারা কথা। রাজনৈতিক দলীয়করণের চিত্র। তুলে ধরেছেন—
‘হাতে টাকা পয়সা নেই। কাজেই আমার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। তা ছাড়া দেশে এখন চাকরি জোগাড় করাও কঠিন। তুমি যদি রাজনৈতিক কর্মী হও, সরকারি দলের লোক হও, কেবল তাহলেই একটা চাকরি পাবে। কিন্তু এটা তো আমার পথ নয়। আর তাই এই ভোগান্তি। কেবল আমার একার নয়, আরও হাজার হাজার লোকের এই একই দুর্দশা।’
এসব পাঠ করলেও মন খারাপ হয়। কারণ আমিও আবুল হাসানের শিল্পের সৎভাই! আমাদেরও তো একই সমস্যা। সত্য কথা বলি, বিধায় কাজে দেয় না কেউ। সামনে প্রশংসা আর পেছনে নিন্দা করে। সরকারি দলের সমালোচনা করলে কোনো প্রতিষ্ঠানই পছন্দ করে না। আর সরকারি চাকরির ইতিহাস তো জলের মতো স্বচ্ছ। পরিবারে কেউ আওয়ামী লীগ করেন কিনা? বংশে কেউ মুক্তিযোদ্ধা আছে কিনা? যেন স্বাধীনতা একটি দলের ভোগ্যবস্তু। স্বাধীনতাকে ভাঙিয়ে তারা বার বার গোলায় তুলেছে ক্ষমতার ধান। দেশ নিয়ে যারাই কথা বলে তারাই রাজাকার! হয় দালালি করো, নয়তো কেটে পড়ো। আমি নিজে অনেক অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি। তাই কেউ কাছে ডেকে নিজের বিপদ বাড়াতে চায়নি। আমি এই সময়টাকে আবুল হাসানের মতো মনে রাখবো। আবুল হাসানের চিঠি পড়তে পড়তে। আমার একটা বিষয় পরিষ্কার। কবি-লেখক-শিল্পীদের বাজারদর থেকে শুরু করে ডায়েরি ও চিঠি লেখা জরুরি। কারণ তাতে সময়কে সবচেয়ে বেশি আঁচ করা যায়। আপনার আমার সন্তান আমাদের সময়কে পাঠ করতে চাইবে হয়তো। পেছন আর পুরানকে যতই অস্বীকার করুক মানুষ। শেকড় ছাড়া তার বাঁচা নাই। মানুষ তো আর বনসাই নয়।
আবুল হাসান মানেই স্বপ্নবাদী হতাশার কবি! দুর্দশা, দুর্ভোগ আর দুর্দিনের চালচিত্র যেন তার ছোট্ট জীবনের সাইন। হতাশার পাশাপাশি শিল্পী আশাবাদী। আর দুর্দিনের সঙ্গে আবুল হাসান সুদিনের কথাও লিখেছেন অঢেল। এই চিঠির শেষেই তিনি শিল্পীবন্ধু রাইনহার্টকে লিখছেন—
‘ভাগ্যিস আমাদের সাধারণ মানুষজন মৌলিক মানবিক গুণাবলি ও সম্পর্ককে এখনো মূল্য দেয়। তারা সত্য ভালোবাসে, তারা মানবতা ভালোবাসে, তারা শিল্প সাহিত্য গান কবিতা ভালোবাসে।’
আর সেপ্টেম্বরে গিয়ে আবুল হাসান ফের আরও গুরুতর কথা লেখেন। ১১ নম্বর চিঠিতে। ১৯৭৫ সালেই।
‘রাইনহার্ট, আমার জীবন এখন অনেক কঠিন! বাংলাদেশ অসুস্থ ও রুগ্নদের জায়গা নয়। যদি প্রচুর অর্থ আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হও, তবেই তুমি এ দেশে টিকে থাকতে পারবে।’
এ যেন আজকের বাংলাদেশের কথা। যার টাকা আছে শিক্ষা তার। যার অর্থ আছে চিকিৎসা তার। গরীবের যেন কোনো অধিকার থাকতে নেই। তার স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবাব কেউ নেই। মরতে মরতে আর আর কত দিন বাঁচব? আমরা কী বেঁচে আছি? এই বেঁচে থাকার অর্থ কী? আমাদের একটাই গুণ। আমরা সব কিছু হারিয়ে তবু চুপ আছি। সহ্য করে যাচ্ছি গাধার মতো।
কবি-শিল্পীদের যা হয়। মরতে মরতেও তারা স্বপ্ন দেখেন। আশা হারান না। না জগতের প্রতি। না মানুষের প্রতি। তাই মৃত্যুর আগে সর্বশেষ চিঠিতে লিখে যান শান্তির কথা।
‘একটা ভালো খবর দিই, জেনে তুমি খুশি হবে—বাংলাদেশও অচিরেই হয়ে উঠতে যাচ্ছে আরেক শান্তির দেশ। দেশকে পুরোদস্তুর সমাজতান্ত্রিক করার জন্য শেখ মুজিব ঠিক ঠিক পদক্ষেপই নিয়েছেন। এখন আমরা উন্নত ভবিষ্যতে ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারি বৈকি।’
কিন্তু কবির ‘ভালো খবর’ কতটা ভালো হলো? তার শান্তির দেশ কতটা পেলাম? বন্ধুকে লেখা চিঠিগুলো। প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে এসে পড়ছি। তবু সময় যেন নড়েনি। কত আদরে আগলে রাখা বাংলাদেশি বন্ধুর চিঠি। সেসব আরেক কাহিনি। কিন্তু জার্মান বন্ধুর লেখা কোনো চিঠি আবিষ্কার করা যায়নি। সেসব আমাদের দুর্ভাগ্য।
আবুল হাসানের মতো এই সময়ের কবি-শিল্পীদের ভাগ্যের তো একটা মিল আছে। অন্তত যারা বিবেক বিক্রি করে দেয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। আমাদের দেশ আমাদের গড়তে হবে। একটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের যা যা চরিত্র তার রূপ দিতে বদ্ধ পরিকর আমরা।
সবশেষে ওয়াকিলুর রহমানকে ধন্যবাদ। তার কল্যাণেই এটা বই রূপে পড়তে পারলাম। তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিষ্টার জন্য ইতিহাসের অংশ হলেন তিনি। একইসঙ্গে ধন্যবাদ বাংলা ও জার্মান জানা অনুবাদক ও সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল ফারুককে। আর শিল্পকলার শিক্ষক রেজাউল করিম সুমনকে। আর প্রথমাকে। যারা বইটি প্রকাশ করেছে যত্ন করে।
Discussion about this post