কোনো কারণে ব্রেইনে রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হলে কিছু ব্রেইন-টিস্যু মারা যায়। এটাই হলো স্ট্রোক। স্ট্রোক তিন প্রকার যথা- ১. ইসেমিক স্ট্রোক ( Ischemic stroke) ২. হেমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke) এবং ৩. মিনি স্ট্রোক (Mini Stroke)
পুরনো ও বিখ্যাত এই স্ট্রোকগুলো সম্পর্কে সবাই মোটামুটি ওয়াকিবহাল। তাই এগুলো নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। বরং আলোচনা করা যেতে পারে নতুন একটি স্ট্রোক নিয়ে। হ্যাঁ, নতুন এই স্ট্রোকটি বাংলাদেশে ছোবল মারা শুরু করেছে। যেহেতু এই স্ট্রোকের কারণ এবং উৎপত্তিস্থল মার্কেট তাই এর নামকরণ করা হয়েছে- মার্কেট স্ট্রোক। আর ক্রমানুসারে এটিকে অভিহিত করা হচ্ছে ৪ নম্বর স্ট্রোক হিসেবে। অবশ্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদন না-পাওয়া পর্যন্ত এর সঙ্গে ‘প্রস্তাবিত’ শব্দটি ব্যবহার করে যাওয়া ভালো। তাই এটি বলা বা লেখার সময় ঠিক এভাবেই করা বাঞ্ছনীয় : মার্কেট স্ট্রোক (প্রস্তাবিত)।
সচেতন ও বিচক্ষণ পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলে রাখা ভালো, হিট অফিসারের ভয়ে যেহেতু বাংলাদেশ থেকে হিট স্ট্রোক বিদায় নিয়েছে সেকারণে এটি আলোচনার বাইরে থাকছে। কারণ কে চায়- ইতিহাস খুঁড়ে বেদনা জাগাতে!
যাহোক। মূল আলোচনায় ঢুকি।
গত এক/দেড় বছরে বাংলাদেশে অনেকেই মার্কেট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু এ ব্যাপারটি ডাক্তাররা ধরতে পারেন নি। ধরতে না পারাটাই স্বাভাবিক, কারণ এটি খুবই সূক্ষ্ম, স্পর্শকাতর এবং রাজনৈতিক স্ট্রোক। উপরন্তু এই স্ট্রোকের সাথে মধ্যবিত্তের চিরায়ত আত্মসম্মান জড়িত। ফলে একজন ব্যক্তি কখন ও কীভাবে আক্রান্ত হন তা প্রকাশ করেন না। এমনকি কেউ প্রকাশ করার ফুরসতও পান না। তবে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে জনৈক মধ্যবিত্ত আব্দুর রহমান সাহেবের (ছদ্মনাম) স্টেটমেন্টে:
১১ অক্টোবর ২০২৩
স্পট : কাঁঠালবাগান কাঁচাবাজার, ঢাকা।
সময় : সন্ধ্যা ৬ টা।
বরাবরের মতো কাঁচাবাজারে তীব্র গরম এবং আগুন। প্রতিটা পণ্যের কাছে যেতেই শরীরে আগুনের আঁচ লাগে। দেখতে পাই, অনেকের শরীর অলরেডি ঝলসে গেছে। কেউ কেউ মাস্ক-ঢাকা মুখে দোকানির সাথে দর কষাকষি করছেন। আমিও সেসব মধ্যবিত্তদের একজন- যাদের মাসিক আয় নির্দিষ্ট পরিমাণ। বলা ভালো, সীমিত আয় এবং নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
আমাদের কারোরই আয় বাড়েনি কিন্তু বাজারের প্রতিটা জিনিসের দাম বেড়েছে বন্যার মতো হু হু করে। ক্ষেত্রবিশেষে তিন গুণ, চার গুণ, পাঁচ গুণ- এমনকি দশ গুণ পর্যন্ত। এ যেন দড়ি ছেঁড়া গরু আপন মনে সাজানো বাগান নষ্ট করে গেলেও কিছু বলার নেই। কারণ, মিঞা বাড়ির গরু। ও যে মানে না মানা…
আমরা সবাই জানি, এক চিমটি লবণ কিংবা দুটো কাঁচামরিচর কারণে বৈষয়িক জীবন কলাপ্সড হয়ে যেতে পারে। সেকারণে কোনো পণ্যকেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। মূলার কথাই ধরা যাক না। বায়ু দুষণের অন্যতম কারিগর এই সবজিটিও এখন নাগালের বাইরে। যে ধুন্দল এক সময় বিক্রি হতো না, ধুঁকে ধুঁকে মরত দোকানির ঝাঁকায়, এখন তার দাম ৭০-৮০ টাকা কেজি।
আমি পরাজিত সৈনিকের মতো বাজারের বিভিন্ন অলিগলিতে পায়চারি করছিলাম আর ভাবছিলাম, কীভাবে স্ত্রীর দেওয়া ফর্দ অনুযায়ী বাজার করা যায়। হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছিলাম, পরিমাণে কোন পণ্যটি কম নেওয়া যায় কিংবা কোনটি না নিয়ে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মেলাতে পারছিলাম না। এ যেন পরীক্ষার হলে বসে প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা ছাত্রের হাপিত্যেশ।
উচ্ছের দামও ১০০ টাকা কেজি। ২৫০ গ্রাম দিতে বললে বিরক্তিতে দোকানির মুখে প্রথমে কুঞ্চন পড়ে তারপর কী মনে করে সে ফিক করে হেসে বলে, কী আর কমু, মাইনষের অবস্থা হালুয়া টাইট।
এক কেজি গরুর মাংস চেয়ে থরে থরে ঝুলানো মাংসের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত কম হাড়যুক্ত একটি পিস খুঁজতে থাকলে কসাই তরাস কণ্ঠে বলে ওঠে, দূরে সইরা দাঁড়ান ভাইজান, চাপাতির কোপ লাগবো!
পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা কেজি শুনে মাথায় হালকা ঝাঁকুনি অনুভব করি। এক কেজি নেব নাকি আধা কেজি, এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়। ততোক্ষণে দোকানি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে, নিলে নেন, না নিলে নাই। আমি কৃত্রিম হাসি হেসে আধা কেজি দিতে বলি। আদার কেজি ২৫০ টাকা। আড়াইশো গ্রাম। রসুন ১৪০ টাকা। আধা কেজি। জিরা ১২০০ টাকা শুনে মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। মশলাটি না নিলেই নয়। মাংসে লাগে। টের পাই, মাথার ঘাম কপাল হয়ে নাকে-মুখে চুয়ে পড়তে শুরু করেছে। ঠিক সে সময় ঝাপসা দেখতে শুরু করি। রীতিমতো হাঁপাতে থাকি। ভাবি, ভূমিকম্প শুরু হলো নাকি? হয়তো ঠিক সেসময়ই আমি সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাই।
জ্ঞান ফেরার পর দেখি, ঝাঁঝালো গন্ধের হাসপাতালের শাদা চাদর বিছানো বেডে শুয়ে আছি। আমার হাত ফুটো করে ক্যানোলা স্থাপন করা হয়েছে। সেই পথে ফোঁটায় ফোঁটায় তরল ওষুধ ঢুকছে শরীরের আনাচে-কানাচে। পাশে অসহায় ভঙ্গিতে বসা স্ত্রী ও দুই মেয়ে। বৃদ্ধা মা রয়েছেন বাসায়। হয়তো জায়নামাজে বসে চোখের জল ফেলছেন। আমি চোখ মেলে তাকাতেই পরিবারের মানুষের অশ্রুভেজা চোখগুলো ছলছল করে, টের পাই। একেবারে সিনেমাটিক দৃশ্য। জানতে পারি, আমি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছেন, এটা ছিল হেমোরেজিক স্ট্রোক।
কিন্তু না। সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে ডাক্তার যেটিকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলেছেন তা যে আসলে মার্কেট স্ট্রোক। আশা করি এ বিষয়ে আর ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার নেই। তবে কীভাবে এই স্ট্রোকের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে আলোচনা করা যেতে পারে।
তবে একটি তথ্য না দিলেই নয়, নতুন এই স্ট্রোকে দগ্ধ হতে হতে যারা বিদগ্ধ হয়েছেন তাদের মতে, ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের অবসান না ঘটলে ভবিষ্যতে এটি মহামারিতে রূপ নিতে পারে।
Discussion about this post