দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী-বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য শুনলে যে কারো মনে হতো, খুব সহজেই আওয়ামী-বিরোধী জোট ক্ষমতায় বসতে পারবে। এই স্বপ্ন দেখানো সহজ হয়েছিল আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তোড়জোড়ের কারণেই সম্ভবত। কিন্তু আওয়ামী-বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের এই আশান্বিত বয়ান দিয়ে কি বিএনপি কিংবা ইসলামপন্থী দলগুলোকে ডিমোটিভেট করার চেষ্টা হয়েছিল কিনা সেটাও এখন বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা আওয়ামী-বিরোধীদের ন্যারেটিভ বিএনপি কিংবা ইসলামপন্থী দলগুলো যাতে খুব সহজেই সুখের সাগরে গা ভাসিয়ে দিতে পারে তেমন রসদ তারা তৈরি করে দিয়েছিল। তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছিল, খুব সহজেই তারা ক্ষমতার মসনদে বসতে পারবে। এ কারণে আন্দোলনরত সমর্থকদের মনে হয়েছে- কঠিন আন্দোলন, সংগ্রাম না করলেও তাদের চলবে। আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচনাকারীরা আন্দোলনকারীদের মন ও মগজে এটা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে যে, তাদের পেছনে ইউরোপ, আমেরিকা আছে। কিন্তু, বাস্তবে রূপ দিতে গেলে যে তাদের কী কী করণীয় সেই অংক সম্ভবত করতে পারে নাই তারা। পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রের চরিত্রের দিক বিশ্লেষণ করলেই তা সহজেই অনুমেয় হওয়ার কথা। কেন একটা রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের একটা দলের পক্ষে কাজ করবে? কতটুকু করবে? তাদের স্বার্থ কী কী? এবং সে স্বার্থের কতটুকু একটা দলকে ক্ষমতায় বসালে পূরণ হতে পারে? নিজ রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ না করেও যদি অল্টারনেটিভভাবে অন্য রাষ্ট্র দিয়ে স্বার্থ পূরণ করা যায় তাহলে উক্ত রাষ্ট্র কেন সে রাষ্ট্রশক্তি প্রদর্শন করতে যাবে, এই দিকগুলোও বিবেচনার বিষয় হিসেবে মাথায় রাখার দরকার ছিল থিংক ট্যাংকগুলোর। আওয়ামী বিরোধী সমালোচকদের কেন মনে হলো না যে, আপনাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া রাষ্ট্রগুলো তাদের চাহিদা যদি অন্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে পূরণ করতে পারে তাহলে তারা ডিপ্লোমেটিক আচরণ করতে পারে। যদি তা নাও করে, তাহলেও কি নিজেদের লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত না রেখে অন্যের ওপর ডিপেন্ডেবল হওয়া উচিত? বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের তো তাদের অনুসারিদের অন্তত এটুকু বোঝানো দরকার ছিল যে, কেউ কাউকে মুখে ভাত তুলে খাওয়াবে না। নিজ পেটের ভাত নিজের হাতেই তুলে খেতে হবে। কিন্তু এইসব বুদ্ধিজীবী সেদিকে যাওয়ার পরামর্শ না দিয়ে অনুসারিদের সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে যা হবার তাই হলো। এর আগের নির্বাচন থেকেও তো শিক্ষা নেওয়া জরুরি ছিল যে, অন্যের ওপর অতোটা ভরসা কিংবা নির্ভর করাটা ঠিক নয়। বিগত নির্বাচনে যেমন, আওয়ামী মতাদর্শের লোক দিয়ে এন্টি-আওয়ামী সেন্টিমেন্ট একত্র করে নির্বাচন করার ফল পেয়েছিল বিএনপি। বিগত নির্বাচনেও বিএনপির মতো এত বড় দলের নীতিনির্ধারকদের মনে প্রশ্ন তৈরি হলো না যে, আমাদের জোটের নেতৃত্ব আমরাই দেবো। সেটা না করে তারা জোটের নেতৃত্ব ড.কামাল, সুলতান মুহাম্মাদ মনুসুর, কাদের সিদ্দিকীদের মতো আওয়ামী মতাদর্শের ধারকদের হাতে তুলে দিয়েছিল। সেটার ফলাফলও তারা পেয়েছিল। রাতের ভোটে বিরাট ব্যবধানে পরাজিত হতে হয়েছিল। এবার আর এজেন্সিগুলোকে আগের মতো পলিসি মেকিং করতে হয়নি। এবার বড় বড় রাষ্ট্রগুলোই পলিসি মেকিং করেছে। এতদিন ভারত ইন্ডিভিজুয়াল ছিল, এখন বাকীরা সরাসরি সামনে চলে এসেছে। রাশিয়া আগে থেকে নিজস্ব রোল প্লে করছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, চীন ও ভারত পরস্পর বিরোধী অবস্থানে থাকলেও বাংলাদেশ নীতিতে তারা একই ভূমিকায় থেকেছে। অথচ, অন্তত বাংলাদেশের ন্যারেটিভে তাদের আলাদা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটাও হয় নাই। সাউথ এশিয়ার ব্লকে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভরসা ভারতই। সে ভারত আবার আওয়ালীগকে নিজ ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছে। ভারত কখনোই চাইবে না আওয়ামী লীগের হাত ছেড়ে দিতে। এই ছেড়ে না দেওয়ার পেছনে হিস্টোরিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। ফলে, ভারতকে ডিনাই করে আমেরিকা কি বিএনপি, ইসলামিস্ট দলগুলোর পক্ষ নিয়ে রিস্ক নিবে? রিস্কও নিতো যদি এইখানে ইন্টারন্যাশনালি আরও অনেক ইকুয়েশন না থাকতো। যদি বিশ্ব রাজনীতির এখন থেকে আরো পাঁচ বছর আগের মতো থাকতো। বিশ্ব রাজনীতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হওয়ার কারণে, এক্ষুনি, মানে এত ত্বরিত গতিতে বাংলাদেশ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে যাবে না তারা। তা আমেরিকা যতই বলুক, তারা নিজ চোখ দিয়েই বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণ করে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ বিষয়ে আমেরিকা কিংবা ইউরোপ চাপ প্রয়োগ করবে বটে কিন্তু এমন চাপ তৈরি করবে না যাতে ভারত বেঁকে বসে যেতে পারে। আমেরিকা এইখানে তক্ষুনি ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেবে যখন দেখবে, ভারত সরাসরি রাশিয়ার ব্লকে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ভারতও সেটা দ্রুত পারছে না। কেননা চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত সমস্যাসহ আরো অনেক সমস্যা আছে। এইখানে, অনেক কিন্তু আছে। এই কিন্তুগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়া, ভারত যতটা সরাসরি আওয়ামীলীগের পক্ষে অবস্থান করবে ততোটা আমেরিকা বিএনপির পক্ষে করবে না। আমেরিকা এইখানে ডিপ্লোম্যাটিক আচরণ করবে। সম্ভবত তাই হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই জিনিসগুলো কেন বিএনপি কিংবা ইসলামী দলগুলো বুঝলো না কিংবা তাদের থিংক ট্যাংকগুলো বুঝলো না? সেদিক দিয়ে আওয়ামী থিংক ট্যাংক বেশ শার্প। তারা তাদের গবেষণার মাধ্যমে নিজেদের শক্তিগুলোকে সঠিকভাবে ইউটিলাইজ করতে পেরেছে। এ কারণে সামনে প্রশ্ন চলে আসে ভোটের আগে বিএনপি ও ইসলামিস্ট দলগুলোকে কি বিভ্রান্ত করা হয়েছিল?
Discussion about this post