মাত্র কয়েকদিন আগে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ‘নতুন এক মধ্যপ্রাচ্য’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। তার সেই ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যে’ ফিলিস্তিন নামের কোন দেশের অস্তিত্ব ছিল না।
কিন্তু ৭ অক্টোবরের হামাসের ‘অপারেশন আল আকসা প্লাবণ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে- চাইলেই এত সহজে ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য গঠন করা সম্ভব নয়। বরং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কেউ কথা বলুক আর না বলুক, তারা নিজেরাই নিজেদের লড়াইটা করার জন্য এখনো শুধু টিকে আছে তা-ই নয়, বরং আরো দৃঢ় হচ্ছে তাদের মানসিকতা। যতই দেয়ালে পিঠ ঠেকছে, ফিলিস্তিনিরা ততোই প্রতিবাদের মাত্রা বাড়ানোর আভাস দিচ্ছে।
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গাজা উপত্যকায় গঠিত এক সশস্ত্র সংগঠন যেভাবে ইসরায়েল নামের রাষ্ট্রের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছে, তা একই সাথে আরো অনেক কিছু মনে করিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ইসরায়েল রাষ্ট্রটি যেভাবে নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যের পরাশক্তি ভাবতে শুরু করেছিল, তা যে মোটেও সত্যি নয় সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আল কাসসাম ব্রিগেডের যোদ্ধারা। তেল আবিবের গর্ব ছিল আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নিয়ে, হামাসের রকেট সেই সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়েছে সফলভাবে। বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাতে চালাতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দক্ষতা যে বাড়েনি সেটা তো দেখাই গেল! হামাসের হাজারখানেক যোদ্ধা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ গুঁড়িয়ে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভেতরে ঢুকে গেল। টানা চারদিন তারা লড়াই করলো ইসরায়েলের মাটিতে ঢুকে। অনেক নাগরিক ও সেনা সদস্যকে ধরে নিয়ে গেল গাজায়।
এসব কিছুই হয়তো নতুন এক মাধ্যপ্রাচ্যের বার্তা দিচ্ছে, তবে সেটা নেতানিয়াহুর ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ নয়। এই বার্তাটি সম্ভবত এমন যে, ফিলিস্তিনকে বাদ নিয়ে নয় বরং ফিলিস্তিনিকে হিসেবে ধরেই মধ্যপ্রাচ্য টিকে থাকবে। কারণ এই ঘটনার পর পশ্চিমারা ইসরায়েলকে সমর্থন দিলেও, আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের পাশেই থাকছে। সৌদি আরব- যারা ফিলিস্তিনিদের সঙ্কটকে উপেক্ষা করে বলে অভিযোগ আছে- তারাও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের আলোচনা স্থগিত করেছে। কিছু সংবাদমাধ্যম এমন খবর দিয়েছে যে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমানের পক্ষ থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের কাছে এই আলোচনা স্থগিতের বার্তা পাঠানো হয়েছে।
অন্য আরব দেশগুলোও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জোরালো করার আভাস দিয়েছে। ইসরায়েলের বাধা সত্ত্বেও গাজা উপত্যকার জন্য মানবিক ত্রাণ বহর প্রস্তুত করেছে মিশর। ত্রাণবাহী গাড়ি রাফা ক্রসিং পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এই ত্রাণ গাজায় ঢুকবে কিনা সেটি স্পষ্ট নয়, তবে এর মধ্যে ইসরায়েলের জন্য অবশ্যই বার্তা রয়েছে। যা বিপরীত স্রোতের আভাস। সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকেই রিয়াদ ও দোহার সাথে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে কায়রোর কর্মকর্তাদের। উপসাগরীয় অঞ্চলের সমর্থন নিয়েই মিশর যে গাজাবাসীকে সহায়তা করতে প্রস্তুতি নিয়েছে সেটি বোঝা যাচ্ছে।
পাশাপাশি, এই সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার দায় নিয়ে নেতানিয়াহুর সরকারকে বিদায় নিতে হতে পারে এমন আলোচনা উঠতে শুরু করেছে। অনেকদিন ধরেই দেশটির জনগণ নেতানিয়াহু ও তার কট্টরপন্থী মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। এই সামরিক ব্যর্থতা আবার বিক্ষোভকে চাঙ্গা করে তুলবে। বিদেশি নাগরিকরাও এখন আর ইসরায়েলকে আগের মতো নিরাপদ ও সুরক্ষিত ভাবতে পারবেন না। শনিবারের সংঘাতের পর তারা দলে দলে ইসরায়েল ছাড়ার জন্য যেভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাতে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ছিল। এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইট ক্যান্সেল করায় বিদেশিরা দিশেহারা হয়ে ওঠে। বিশেষ করে পশ্চিমা পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের এই আতঙ্ক ইসরায়েল কবে দূর করতে পারবে, আদৌ পারবে কি না তার কোনো ঠিক নেই। পারলেও হয়তো বহু বছর লেগে যাবে। তেমনটি হলে তা হবে ইসরায়েলের জন্য আরেকটি পরাজয়।
এখন পর্যন্ত সংঘাত কোন দিকে যাচ্ছে তা বলার উপায় নেই। গাজা উপত্যকায় ব্যাপক বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। প্রতিদিন উঁচু হচ্ছে লাশের স্তুপ। বিমান হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল স্থল বাহিনী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে গাজায়। তারা উপত্যকার সীমান্তে সেনা জড়ো করতেও শুরু করেছে। তবে হামাস বলেছে, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী ঢুকলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। ইসরায়েলি সেনাদের জীবিত ফিরতে না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে তারা।
ছোট্ট একটি ভূখণ্ড গাজা উপত্যকা। যেটি ২০০৬ সাল থেকে ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে রয়েছে। এর ফলে তারা নিজেরা প্রয়োজনের তাগিদেই সেখানে গড়ে তুলেছে নিজস্ব একটি জগৎ। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, খাদ্যদ্রব্য ছাড়া বাঁচতে পারার অভ্যাস করে নিয়েছে গাজাবাসী। সেই সাথে হামাসের বিশাল রণপ্রস্তুতির কারণে জায়গাটি দুর্গে রূপ নিয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনী তাই গাজায় প্রবেশ করলে তাদের জন্য সহজ হবে না সেই যুদ্ধ। বরং সেখানে ঢুকে হামাসের পেতে রাখা ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিভিন্ন দেশ থেকে সংঘাত বন্ধে ও উত্তেজনা প্রশমনে আলোচনার উদ্যোগ নিতে বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তারা ইসরায়েলের সমর্থনে ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ মুভ করাতে শুরু করেছে। যে স্ট্রাইক গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড। জো বাইডেন ইসরায়েল ও ইহুদিদের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন; কিন্তু একটি বারও যুদ্ধবিরতি বা উভয় পক্ষকে নিবৃত করার বিষয়ে কোনো বাক্য তার মুখ থেকে বের হয়নি। শোনা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে নিবৃত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি টুইট করেও সেটি আবার ডিলেট করে দিয়েছে। ইসরায়েলে এসেছে পৌঁছেছে মার্কিন সামরিক সহায়তার প্রথম চালান। এমনিতেই প্রতি বছর ইসরায়েলকে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা দেয় ওয়াশিংটন; কিন্তু এবারের পরিস্থিতিতে তারা তড়িঘড়ি করে সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
এ সব কিছুকে সংঘাত বৃদ্ধির উস্কানি হিসেবে ধরে নিলে বুঝতে হবে, এবারের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ছাপ ফেলবে। তবে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার চিন্তা যদি ইসরায়েল করে, তাতে তারা খুব সহজে সফল হতে পারবে না। ইতোমধ্যেই সিরিয়া ও লেবানন থেকে ইসরায়েলে রকেট হামলা হয়েছে। লেবানন থেকে হিজবুল্লাহর চালানো হামলায় এক ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তাও নিহত হয়েছেন। হিজবুল্লাহ ইরানের প্রক্সি সংগঠন, কাজেই এই যুদ্ধে হিজবুল্লাহর জড়িয়ে পড়া মানে ইরানের সংশ্লিষ্টতা আরো বেড়ে যাওয়া। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকারও ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সিরিয়ার সাথে সীমান্ত সংঘাত শুরু হলে সেটিও ইরানের দিক থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পাবে। যে কারণে এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িত না থাকলেও ইরানের নাম বারবার আসছে। হামাসের এত যে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তার পেছনেও ইরানের সমর্থন রয়েছে। দেশটি হামাসকে সরাসরি অস্ত্র না দিলেও যে প্রযুক্তিগত ও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে তা গোপন কিছু নয়।
ইরান এই যুদ্ধে জড়াবে কি না সেটি নির্ভর করছে অনেকটা ইসরায়েলের ওপর। এখন পর্যন্ত একটি গুলিও খরচ না করে ইরান যে অনেকগুলো ফ্রন্টে ‘জয়’ পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হামাসকে সহযেগিতা, হিজবুল্লাহর গোলা নিক্ষেপ- ইত্যাদি কারণে ইরানের ওপরও শোধ নেয়ার চিন্তা করতে পারে ইসরায়েল। এতদিন তারা ইরানের মাটিতে অনেকগুলো গুপ্তহত্যার অভিযান চালিয়েছে। এমনকি দেশটির সেরা পারমাণবিক বিজ্ঞানীকেও হত্যা করেছে ইসরায়েল; কিন্তু হামাসের এই অভিযানের জের ধরে সরাসরি দেশটিকে যুদ্ধের মাঠে টেনে আনতে পারে ইসরায়েল। তেমনটি হলে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে। আর সেই যুদ্ধে যে কেউ সহজে জিতবে তেমনটি বলা কঠিন, তবে ইসরায়েলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে ‘সামাজিক’ হয়ে টিকে থাকা আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
তবে দেশটির সামরিক সামর্থ্যের যে নমুনা এবার দেখা গেছে তাতে হয়তো তারা ইরানকে যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। যদি চায়, সেটি হতে পারে তাদের অতিআত্মবিশ্বাসের ফল, অথবা পশ্চিমা সহায়তার ওপর নির্ভরতা; কিন্তু সেই যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক দেশের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে, বিশেষ করে সিরিয়া, ইয়েমেনের মতো ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের। অন্য কোনো আরব দেশও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান নেবে না, সেকথা কে বলতে পারে।
আর বড় আকারের যুদ্ধ না হলেও এবারের সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণকে নতুন করে সাজাতে ভূমিকা রাখবে সেকথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেটি ইসরায়েলের জন্য নেতিবাচক হয়ে উঠবে বলেই মনে করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে দেশটির সম্পর্কিত হওয়ার সুযোগ আরো দূরে চলে যাবে এর ফলে।
Discussion about this post