চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ের সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশে এলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। রবিবার (১০ সেপ্টেম্বর) জি-২০ সম্মেলন শেষে করেই তিনি রাত ৮টা ১০ মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানান। ১৯৯০ সালে ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁর পর এটি বাংলাদেশে কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় সফর।
সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এমানুয়েল মাখোঁর দ্বিপক্ষীয় ও একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়।
ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিষয়টি মাখোঁর এ সফরে গুরুত্ব পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাংবাদিকদের তা জানিয়েছেন। সোমবার সাংবাদিকদের শেখ হাসিনা ‘ফ্রান্স বাংলাদেশের সার্বভৌম নীতি, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে চলমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে। আমরা উভয়েই আশা করি বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে এ নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’ (বাসস)
ফরাসি প্রেসিডেন্ট তার সফরকালে তুরাগ নদে ভ্রমণ করেন। গানের দল ‘জলের গান’র প্রধান রাহুল আনন্দের বাসায় যান। এ ছাড়া ধানমন্ডি লেক দেখা ও সেখানে গান শোনারও পরিকল্পনা ছিল তার। সব শেষ করে সোমবার বিকেলে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। গান বা শিল্পের প্রতি ফরাসিদের ঐতিহ্যগত আগ্রহ মাখোঁর সফরেও অটুট ছিল। তিনি নিজেও একজন পিয়ানো বাদক। দর্শন শাস্ত্রেও ভালো দখল আছে। ব্যাংকার মাখোঁ হঠাৎই রাজনীতিতে আসেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হয়ে তাক লাগিয়ে দেন অনেককে। নিজের তুলনায় বয়সে অনেক বড় শিক্ষিকাকে বিয়ে করে ‘ফরাসি উদারতার’ পরিচয় দেওয়ায় দেশটির বয়স্ক নাগরিকরা তাকে প্রেসিডেন্ট পদে ভোট দেন। আগে থেকেই মাখোঁ বিভিন্ন লেখালেখিতে ‘প্যান ইউরোপিয়ান’ দৃষ্টিভিঙ্গির জানান দেন। যা তাকে একজন উপযুক্ত ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভোটারদের সামনে হাজির করে।
সম্প্রতি এ কাজে তিনি আরো তৎপর হয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে এখন আলোচ্য বিষয়ে মাখোঁ’র নিজস্ব রাজনীতি। আর সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থেকে বের হয়ে ‘ইউরোপীয় শক্তির’ বিকাশ ঘটানো। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে চলতি বছর এপ্রিলে তিনি চীন সফর করেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংকে আহ্বান জানান পরিস্থিতি শান্ত করতে। যদিও তার সে সফরের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে নিজস্ব ইউরোপ গড়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তার চীন সফর নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে।
ওই সফরে মাখোঁ চীনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ছয় ঘণ্টা বৈঠক করেন। তারা ইউরোপ, রাশিয়া এবং তাইওয়ান নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর মাখোঁ ঘোষণা করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে ইউরোপের ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের’ জন্য চেষ্টা করা উচিত। তিনি বলেছিলেন, ‘মার্কিন এজেন্ডা থেকে আমাদের কৌশল ঠিক করা উচিত নয়’। মাখোঁ এও বলেছিলেন, যে সংকট আমাদের নয় তাতে জড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়’। মাখোঁ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ইউরোপীয় দেশগুলোকে মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে যাতে ওয়াশিংটনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে না হয়। (ফরেন অ্যাফেয়ার্স)
তার এ অবস্থানের সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকরা। এমনকি ফ্রান্সের পত্রপত্রিকায়ও এ নিয়ে সমালোচনা হয়। মাখোঁ চেয়েছিলেন, চীন ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান জানাবে এবং রাশিয়াকে শান্ত করবে। তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের পক্ষে এ ধরনের ভূমিকা পালন ছিল অসম্ভব। ফ্রান্সের সামরিক, রাজনৈতিক প্রভাবও যথেষ্ট নয় যা চীনকে প্রলুব্ধ করতে সক্ষম। অন্যদিকে ফ্রান্সের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তারপরও মাখোঁ যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা তার রাজনৈতিক দর্শন, ইউরোপকে আলাদা শক্তি হিসেবে জাগানোর চেষ্টা থেকে।
অপরদিকে রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতাও জিইয়ে রাখতে চায় ফ্রান্স। ইতিমধ্যে মাখোঁ ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকে কোনো রাশান ফ্ল্যাগ ওড়ানো যাবে না। মাখোঁ বলেছেন, অবশ্যই প্যারিস অলিম্পিক চলাকালে কোনো রাশিয়ান পতাকা থাকতে পারবে না। আমি মনে করি, এই বিষয়ে একটি ঐকমত্য রয়েছে। কারণ, রাশিয়াকে এমন সময়ে স্বাগত জানানো যাবে না যখন দেশটি যুদ্ধাপরাধ করছে এবং শিশুদের নির্বাসিত করছে।’
চীনের সঙ্গে সখ্য এবং রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতা রেখে চলা নীতির কারণে মাখোঁর সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে পশ্চিমা দুনিয়ায়। আগস্টে নাইজারে সেনা অভ্যুত্থানকে তাদের পরাজয় হিসেবেই দেখছে বিশ্ব মিডিয়া। নাইজারে ক্যু-এর পেছনে রাশিয়াকে দায়ী করছে ফ্রান্স। তাদের দাবি আফ্রিকাকে অনিশ্চিয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে রাশিয়া। যদিও রাশিয়া সেটা অস্বীকার করেছে। তবে আফ্রিকা অঞ্চলে যে ক্রমে চীন আর রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তৃত হচ্ছে তা এখন মোটামুটি জানা বিষয়। তারপরও নিজের রাজনৈতিক দর্শন থেকে মাখোঁ সরে আসেননি। এর প্রমাণ বাংলাদেশ সফর। শেখ হাসিনা যাকে অভিহিত করেছেন ‘ফ্রান্সের নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ’ হিসেবে।
সোমবার আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বিভিন্ন দেশে প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। বাংলাদেশ এ দুই পরাশক্তির অন্যতম আকর্ষণের জায়গা বলে সম্প্রতি দৃশ্যমান হয়েছে। ফ্রান্স চাইছে এ দুই শক্তির বাইরে তৃতীয় একটি পক্ষ তৈরি করতে। যা আন্তর্জাতিকভাবে মাখোঁর ‘বিকল্প প্রস্তাব’ হিসেবে পরিচিত।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনদালু’র প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন একটি বিশেষভাবে আলোচ্য ইস্যু। ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ দল টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচন করতে চাইছে। বিরোধীরা তাকে দমনমূলক কৌশলের জন্য অভিযুক্ত করছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, নির্বাচন সুষ্ঠু বা স্বচ্ছ হবে না। তবে সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে।
তারা প্রতিবেদনে আরো জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ মোকাবেলা করার জন্য শেখা হাসিনা সরকারকে চাপ দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলিকে এ ইস্যুতে বিভক্ত।
আনদালু জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পশ্চিমাদের ‘হস্তক্ষেপ’ হিসেবে সমালোচনা করছে রাশিয়া। তারা বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ মাখোঁর আগেই বাংলাদেশ সফর করেন। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের পারস্পরিক বাণিজ্য চলছে। পাশাপাশি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতের দায়িত্বও রাশিয়ার। তবে রাশিয়া শুধু বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আগ্রহী নয়। ল্যাভরভ তার সফরে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দেওয়ার সরাসরি বিরোধিতা করেছেন।
মাখোঁ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রসংশা করলেও নির্বাচন বা মানবাধিকার নিয়ে কোনো কথা বলেননি। বরং ঘুরে বেড়িয়েছেন, গান শুনেছেন। তাতে মনে হয় মাখোঁর বাংলাদেশ সফরে হয়তো প্রাধান্য পেয়েছে সাংস্কৃতিক বিনিময়।
তবে আনদালু’র ওই প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক শাদাব আলি খান বলেছন, গ্লোবাল গ্রুপে ফ্রান্সের অবস্থান পরিষ্কার নয়। পশ্চিম এবং অন্যান্য জোটের সঙ্গে তাদের একটি জটিল সম্পর্ক রয়েছে। ফ্রান্স তার প্রাক্তন আফ্রিকান উপনিবেশগুলোতেও অবস্থান হারিয়েছে। যে কারণে হয়তো ফ্রান্স বাণিজ্যের জন্য একটি নতুন বাজার খুঁজছে।
তিনি বলেন, প্যারিস প্রতিরক্ষা পণ্য ও প্রযুক্তিতে বাণিজ্যের প্রস্তাব দিতে পারে। অন্যদিকে ঢাকা তার রপ্তানি বহুমুখী করতে এবং ফরাসি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আগ্রহী।
মাখোঁ ঢাকা ছাড়ার পর রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ফরাসি প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন বাংলাদেশ তাদের এয়ারবাস কোম্পানির তৈরি ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেছেন, প্রাথমিকভাবে দুটি এয়ারবাস উড়োজাহাজের জন্য অর্ডার দেয়া হয়েছে। কয়েক দফায় ১০টি এয়ারবাস উড়োজাহাজ চেয়েছি আমরা। কারিগরি কমিটি এখন মূল্যায়ন করছে। এই উড়োজাহাজগুলো নতুন এবং পুরোনো রুটে ব্যবহার করা হবে।
এ ছাড়া আরেক খবরে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণ ও উৎক্ষেপণে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস।
ফলে, মাখোঁ বাংলাদেশ সফরে বাণিজ্যিকভাবে যে বড় দাও মেরে গিয়েছেন তা প্রায় নিশ্চিত। বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেয়েছে তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের পর প্রচারিত যৌথ ঘোষণাটি অবশ্য অনেকের নজর কেড়েছে। ইংরেজিতে প্রচারিত ওই ঘোষণায় বলা হয়, বিশ্বের যে কোনো দেশে অসাংবিধানিক পরিবর্তন এবং বেআইনি সামরিক হস্তক্ষেপের নিন্দা করে দুই দেশ। ধারণা করা হচ্ছে, এই ঘোষণাটিতে হয়তো সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতি ফ্রান্সের সমর্থন ব্যক্ত হয়েছে পাশাপাশি, আফ্রিকায় ফ্রান্স নিয়িন্ত্রত রাষ্ট্রগুলোতে সরকার পরিবর্তন বিষয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশও যে উদ্বিগ্ন সে বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
Discussion about this post