একটানা ১৫ বছরের আওয়ামী শাসন বাংলাদেশের সমাজে বহুমুখী প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা সমাজে নানা ধরনের রূপান্তরও ঘটিয়েছে। গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, সুশাসন, অর্থনীতি, বাণিজ্য, বাজার, সুবিচার, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ বহুল আলোচিত ক্ষেত্রগুলোতে কী রূপান্তর ঘটেছে, তা নিয়ে সবসময়ই আলোচনা করা দরকার। কিন্তু এখানে সেসব বিষয় আনতে চাই না।
অন্য কয়েকটি বিষয় সামনে আনছি।
যেমন :
১. শাসনব্যবস্থায় রাজনীতির ওপরে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শাসনব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই আমলাতন্ত্র-নির্ভর হয়েছে। সমাজে আমলাদের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থান আরও পোক্ত হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে তরুণদের মধ্যে আমলাতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। আমলাতন্ত্রের বাইরে অন্য পেশাগুলো অবমূল্যায়িত হচ্ছে।
২. সরকার ব্যবস্থায় ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। মন্ত্রিসভা ও সংসদে ব্যবসায়ীরা পেশাগোষ্ঠী হিসেবে একক কর্তৃত্ব তৈরি করেছেন। আইন ও নীতি প্রণয়নে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাটি ব্যবসাবান্ধব হতে পারেনি। কারণ, বাজারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বড় অংশ ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ। প্রায় সবক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ প্রাধান্য পাওয়ায় বাজার ব্যবস্থা ভারসাম্যহীন অবস্থায় পড়েছে।
৩. দৃশ্যমান ও বড় কাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো উন্নয়নের ন্যারেটিভকে শক্তিশালী করেছে। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য সুবিধাজনক হয়েছে। অর্থের প্রবাহ বাড়িয়েছে। কিন্তু এগুলো আমাদের ঐতিহ্যবাহী যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী হুমকি তৈরি করেছে। বেশিরভাগ প্রকল্পই আমাদের নদী ও জলাধার ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
৪. কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও উৎপাদনের নীতি আমাদের পুরনো খাদ্য ব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দেশীয় মাছের জাতগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। জলাধার ও নদীর প্রাণবৈচিত্র্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। দেশীয় কৃষি ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটেছে। বেশি উৎপাদনের নীতি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থাকে প্রায় উৎখাত করতে চলেছে। নানা রাসায়নিক, কীটনাশক ও সার ব্যবহার করার কারণে বাজার থেকে দেশীয় জাত ও অর্গানিক খাদ্যশস্য প্রায় উধাও হয়ে গেছে।
৫. আদালত পাড়াতেই যে শুধু বিচারব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা-ই নয়। সমাজেও ন্যায় ও নীতির অবস্থান পেছনে পড়ে গেছে। সমাজে বলবান, অর্থবান ও ক্ষমতাবানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার টাকা আছে বা যে টাকা উপার্জন করতে পারে সমাজে তারই কর্তৃত্ব। ফলে, সমাজে জ্ঞান, বিদ্যা ও অভিজ্ঞতার মূল্য কমে গেছে।
৬. কাঠামোগত উন্নয়নের দিকে যত জোর দেওয়া হয়েছে ততোই কমজোর হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। বছর বছর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার সাধারণ মান একেবারে পড়ে গিয়েছে। বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন ভবন প্রচুর উঠেছে। কিন্তু শিক্ষা, পাঠদান ও গবেষণার উন্নয়ন ঘটেনি। বিদ্যায়তনগুলোর সর্বাত্মক নেতিবাচক রাজনীতিকরণ এগুলোকে শিক্ষাঙ্গন হিসেবে আর কার্যকর রাখতে পারছে না।
৭. তরুণদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। মেধাবী ও দক্ষ তরুণরা বেশি হতাশ হচ্ছে। তাদের বিদেশ যাওয়া হার বেশি। এতে ব্রেইন ড্রেইন হওয়ার আশঙ্কা অনেকে বেড়ে গেছে। অর্থাৎ দেশ মেধাবীশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে।
৮. জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও দক্ষতার বদলে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বৎ সমাজ এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। সব স্তরেই অযোগ্য লোকেরা এগিয়ে গিয়ে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে। নাগরিক সমাজে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। দেশের মূলধারার গণমাধ্যম ব্যবস্থাও প্রভাবহীন ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
৯. তরুণদের মধ্যে ব্যাপকভাবে এ ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে, সামনে আগাতে হলে মেধা ও যোগ্যতা নয়, নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রাখতে হবে। তরুণদের বড় অংশটি শুধু সুবিধা অর্জনের জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
১০. তরুণদের একটি অংশ যেমন সুবিধাবাদীতা ও স্বার্থকেন্দ্রিকতার কারণে বড় সংখ্যায় ক্ষমতাসীনদের দিকে ঝুঁকছে, আরেকটি অংশের তেমনি র্যাডিকালাইজেশন ঘটছে।
১১. সীমিত আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে এক ধরনের অক্ষমের আর্তনাদ তৈরি হয়েছে। তারা অনুধাবন করতে পারছে, এই শাসনব্যবস্থায় তাদের অংশগ্রহণের আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। বাজারে, অফিসে, জনপরিসরে তারা আর ভাইব্রেন্ট ও কর্মক্ষম থাকতে পারছে না। মধ্যশ্রেণীর মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও অদৃষ্টবাদীতা ছড়িয়ে পড়েছে।
১২. অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে আয় বৈষম্য বাড়ছে। সাথে বাড়ছে মতাদর্শিক বৈষম্য। এক অংশ খুব ভাল আছে, আরেক অংশ খুব খারাপ আছে। সমাজ দ্বিখণ্ডিত হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে ফুঁসছে।
১৩. সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় শাসকদের যৌথনীতি এই ব্যবস্থা তৈরি করেছে- এমন ধারণা পাকাপোক্ত হওয়ায় দেশ একটা র্যাডিকেল রূপান্তরের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছে। সমাজের বড় অংশের মধ্যে শাসকদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়েছে।
১৪. শাসন ব্যবস্থায় কার্যকর বিরোধী রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা সীমাবদ্ধ হওয়ায় ফলে সমাজে বিরোধী মত ও আদর্শের লোকদের গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
১৫. জনগণের বড় অংশের মধ্যে পরাজয়ের চূড়ান্ত গ্লানি তৈরি হয়েছে।
Discussion about this post