প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের কাছ থেকে দৈনিক পত্রিকার কিছু রীতি আমরা শিখেছিলাম। তার সঙ্গে সব মিলিয়ে পাঁচ বছর কাজ করেছি আমি। এ সময়ে অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো সকাল বেলার মিটিং। প্রতিদিন সকালে সম্পাদকীয় মিটিং খুবই একঘেয়ে ব্যাপার। কিন্তু সারওয়ার ভাই খুব রিলিজিয়াসলি এই মিটিংটা করতে চাইতেন। মিটিংয়ের প্রথমেই প্রায় সব দৈনিক পত্রিকার ফাইল নিয়ে বসা হতো। সারওয়ার ভাই নিজে ফাইনাল ওলটাতেন। রীতি অনুসারে, আমাদের আগেই বাসায় থাকতে বা অফিসে এসে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ভালোভাবে চোখ বোলাতে হতো। সারওয়ার ভাই নিজে সকালবেলা উঠে বাসার মেঝেতে পত্রিকা ছড়িয়ে সব দৈনিকে চোখ বোলাতেন। পত্রিকার পক্ষ থেকে আমরা ছয়/সাতটি পত্রিকার বিল পেতাম। এখন বেশিরভাগ পত্রিকাই খরচ কমানোর অজুহাতে সাংবাদিকদের জন্য এই সুবিধাটি বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রথমেই আলোচনা হতো কোন পত্রিকা কী ছেপেছে, কারা ভালো করেছে, কাদের শিরোনাম সুন্দর হয়েছে, কারা এক্সক্লুসিভ নিউজ পেয়েছে। সারওয়ার ভাই আমাদের মতামত শুনতে চাইতেন। সমকাল আজ কোথায় এগিয়ে বা পিছিয়ে গেল সেটা বুঝতে চাইতেন। সাধারণত নিউজ ও রিপোর্টিংয়ের লোকজন এইসব মিটিংয়ে থাকতো না। ফলে আমরা রিপোর্টিং ও এডিটিংয়ের নানান সমস্যা নিয়ে খোলামেলা বলতাম।
সম্পাদকের সারাদিনের কাজ রিপোর্টিং ও নিউজের লোকদের সঙ্গে। অনেক সময়ই আমাদের মিটিংয়ের পরে নিউজের মিটিং শুরু হতো। সেই মিটিংয়ে একটাই সুর থাকত। তারা সমস্বরে বলতো আজ আমাদের পত্রিকা সেরা হয়েছে। এই নিউজটা আমরা খুব ভালো করেছি। সারওয়ার ভাই কখনো কখনো বলতেন, অমুক পত্রিকা এই নিউজটা পেল আমরা পেলাম না কেন? রিপোর্টিংয়ের লোকজন মুখস্ত বলতো, সারওয়ার ভাই এই নিউজটা কিন্তু অনেক পুরাতন। এটা আমাদের পত্রিকায় একভাবে গেছে।
অথবা, এই নিউজটা আমাদের কাছেও এসেছিল। কিন্তু নিউজটা মেরিট ছিল না বলে আমরা ছাপিনি।
অথবা, এই নিউজটা নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। অমুককে এসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু সে কালকে অফিসে আসেনি।
নিউজ ও রিপোর্টিংয়ের লোকজন সম্মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইত তারাই সবচেয়ে ভালো কাজ করেছে এবং সবচেয়ে ভালো পত্রিকাটি আজকে বের করতে পেরেছে। এবং সেটা সম্ভব হয়েছে সারওয়ার ভাইয়ের দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্বের কারণে।
কখনো কখনো সারওয়ার ভাই তাদের প্রশংসায় গলে যেতেন আবার কখনো রেগে গিয়ে কোনো একটা নিউজ নিয়ে ভালো করে কাজ শুরু করতে বলতেন।
কিন্তু সম্পাদকীয় মিটিংয়ে তিনি বুঝতে চাইতেন আমরা নিউজ নিয়ে কী ভাবছি। নিউজ ও রিপোর্টিংয়ের মিটিংয়ের আগেই তিনি একটা কংক্রিট ধারণায় পৌঁছাতে চাইতেন। বিশেষ করে তিনটি বা দুটি সম্পাদকীয় লেখার জন্য যখন নিউজ খোঁজা হতো তখন সারওয়ার ভাই হতাশ হয়ে পড়তেন। সারবস্তু সম্পন্ন নিউজ না থাকলে সেটি নিয়ে এডিটোরিয়াল লেখা যায় না। এ ব্যাপারটি তিনি ভাল বুঝতেন। ফলে, সকালবেলাতেই পত্রিকা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়তেন। সাধারণত এডিটোরিয়ালে কী লেখা হবে তা তিনি বলে দিতেন। অথবা জিজ্ঞেস করতেন, বল এ বিষয়ে কী লিখবা?
তারপর আমরা আলোচনা করতাম, আজ এডিটোরিয়াল পাতায় কী কী পোস্ট এডিটোরিয়াল ও অপ-এড ছাপা হবে। আজকাল পত্রিকার লোকেরাও জানে না পোস্ট এডিটোরিয়াল কি আর অপ-এড কী। সম্পাদকীয় বা এডিটোরিয়াল হলো কোনো বিষয়ে পত্রিকার নিজস্ব মতামত। পোস্ট এডিটোরিয়ালগুলোতেও পত্রিকার নিজস্ব মতামত প্রকাশিত হয় এবং এগুলোর সাধারণত পত্রিকার নিজেদের লোকেরাই লিখে থাকেন। অথবা পত্রিকার বাধা কলামিস্টরা লিখে থাকেন। যারা পত্রিকার মতামত জেনে এবং মেনে লেখাগুলো লেখেন। এই লেখাগুলো সম্পাদকীয়র পাশেই ছাপা হয়। আর অপ-এড হলো, অপজিট টু এডিটরিয়াল। সম্পাদকীয় পাতার বিপরীতে এই পাতাটি থাকে। এখানে মুক্তমতগুলো প্রকাশিত হয়। এর বাংলা নাম হতে পারে সম্পাদকীয়র বিপরীতে। কেউ একজন এর বাংলা করেছিলেন উত্তর-সম্পাদকীয়। বাংলাদেশে অবশ্য পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতাগুলোতে এই রীতি কখনোই বুঝেশুনে মানা হয়নি।
যাই হোক, সম্পাদকীয় মিটিংয়ে আমরা আলোচনা করতাম কোন কোন উপসম্পাদকীয় ও কলাম আজ ছাপা হবে।
ছোটবড় মিলিয়ে এভারেজে দৈনিক ৯টি লেখা ছাপা হতো। আমরা প্রত্যেক লেখকের নাম ও লেখার বিষয় আলোচনা করতাম। নিজেরা যে লেখাগুলো লিখবো বা অনুবাদ করব সেগুলো বিস্তারিত বলতাম। কখনো কখনো সম্পাদক জিজ্ঞেস করতেন এই লেখক কে? তিনি এটা কেন লিখেছেন? কী করেন তিনি?
বছরের প্রতিটি দিন এরকম মিটিং করা খুবই একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর ব্যাপার। একদিন আমি সারওয়ার ভাইকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সম্পাদকীয় মিটিংটা কেন এত জরুরি? ফোনেই তো কথাগুলো সেরে নেওয়া যায়। আজকের এডিটোরিয়াল কী? কোন কোন লেখা যাবে?
তিনি বলেছিলেন, এটা শিখে রাখো। যেখানেই যাবা এই প্র্যাকটিসটা করার চেষ্টা করবা।
প্রত্যেকটা পাতা নিয়ে মিটিং না করলে একসময় কী ছাপা হচ্ছে সেটা তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। বিভাগীয় সম্পাদক বা সাবডিটররা ইচ্ছামতো লেখা ছাপিয়ে পত্রিকাকে বিপদে ফেলবে।
এখন মনে হয় সারওয়ার ভাই ঠিক বলেছিলেন। পত্রিকাগুলোতে সকালবেলার সম্পাদকীয় মিটিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে কর্তা ব্যক্তিদের নজর এড়িয়ে অসংখ্য ভূয়া লেখকের ভূয়া লেখা ছাপা কঠিন হতো।
এর মানে এই নয় যে, আমরা কখনো ভূয়া লেখা ছাপিনি। আমরাও জেনেশুনে ভূয়া লেখা ছাপতাম। এর সংখ্যা হতো খুবই কম।
সাধারণত এ ধরনের লেখা সম্পাদকের কাছে আসতো। এবং পুরনো রীতি অনুসারে সম্পাদক এগুলো সরাসরি আমাদের হাতে দিতেন না। মিটিং শেষে তার পিয়ন এসে আমাদেরকে দিয়ে যেত। লেখার ওপরে তার কমন রিমার্ক থাকতো। ‘ছোট করে দিয়ে দাও।’
লেখা পড়ে আমরা বুঝতে পারতাম এটা খাওয়ানো জিনিস। আমরা এটাকে বলতাম ফিড বা চোথা।
বারো বছর ধরে সম্পাদকীয় পাতায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝি, কোনো লেখাই অবচেতনে বা অসচেতনভাবে ছাপা হওয়া সম্ভব নয়।
আগে লেখা আসতো ডাকে। এখন লেখা আসে মেইলে। খুব অসচেতন ব্যক্তি ছাড়া মেইলে আসা লেখা নিয়ে প্রত্যেকেই কয়েকটি বিষয় জানার চেষ্টা করেন।
১. লেখাটি কে পাঠিয়েছেন।
২. লেখক কে?
৩. তার পরিচয় কী?
৪. তিনি আগে অন্যান্য পত্রিকায় লিখেছেন কিনা।
৫. তিনি যে বিষয়ে লিখেছেন সে বিষয় নিয়ে জানেন কিনা।
আপনাদের মধ্যে কারও যদি নতুন লেখক হিসেবে কোনো রেফারেন্স ছাড়া পত্রিকা অফিসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকে তবে খুব ভালো করেই বুঝবেন দৈনিক পত্রিকায় কলাম বা যে কোনো লেখা ছাপা কতটা কঠিন।
এ কথা সত্যি, অনেক পত্রিকা থেকেই সকাল বেলার মিটিংয়ের পদ্ধতি উঠে গেছে। অনেক পত্রিকাতেই সম্পাদকরা ভিন্নমত শুনতে চান না। নিউজ ও রিপোর্টিংয়ের কমফোর্ট জোন থেকে বের হতে চান না। নিজের পত্রিকার সমালোচনা শুনতে চান না। আবার এমন সম্পাদকের কথাও জানি, যারা নিজেদের পত্রিকার প্রথম পাতার লিড নিউজ সম্পর্কেও জানেন না। তারা সাধারণত, কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে পত্রিকা বর্গা দিয়ে রাখেন। এরা ইচ্ছামতো পত্রিকা চালায়। কোটারি করে। নানা জায়গা থেকে নানা রকম ফিড খায়। সম্পাদক বাইরে বাইরে কাটিয়ে ঠিকমতো বুঝতেও পারেন না তার নামী পত্রিকাটি তার ও জাতির কী সর্বনাশ করে চলেছে।
এমন সম্পাদক হয়তো অনেকেই আছেন। কিন্তু আমার বক্তব্য হলো, কেউ যতই ভালো ইংরেজি লিখুক আর তার পরিচয়ে যত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই থাকুক, পত্রিকার ভেতরে কারো না কারো স্বজ্ঞান উদ্যোগ ছাড়া দিনের পর দিন ভুয়া লেখকদের প্রোপাগান্ডামূলক লেখা ছাপা হতে পারে না।
তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, আমরা অনেক সময়ই যেভাবে চোথা বা ফিড ছাপতে বাধ্য হয়েছি এক্ষেত্রেও তেমন ঘটনাই ঘটেছে। কোনো পাওয়ারফুল জায়গা থেকে পত্রিকাগুলোকে এই ফিড খেতে বাধ্য করা হয়েছে। এবং সঙ্গত কারণেই পত্রিকাগুলো এটা স্বীকার করতে পারছে না বা পারবে না।
Discussion about this post