অনেকের মনে এখন একই প্রশ্ন উঁকি মারছে, বিশ্ব কি বড় কোনো সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে চলতেই ইসরায়েলে হামাসের বড় ধরনের হামলা সেই প্রশ্নে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ১৯৭৩ সালে পর এই প্রথম বড় আকারের হামলার মোকাবেলা করতে হচ্ছে ইসরায়েলকে। ইসরায়েলের প্রায় চারশতাধিক লোক মারা গেছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই সৈন্য। জবাবে হামাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় ফিলিস্তিনেরও চার শতাধিক লোক মারা যাবার খবর পাওয়া গেছে। ৭০ হাজার লোক ইতোমধ্যে মরুভূমির তাঁবুতে উদ্বাস্তু জীবন ধারণ শুরু করেছেন। ইসরায়েলের নিরাপত্তা বলয়, ভেঙে যে হামলা হামাস পরিচালনা করেছে সেটিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অভিহিত করেছেন “গোয়েন্দা ব্যর্থতা” হিসেবে। আকাশ পথে আয়রন ডোমের নজরদারি এড়িয়ে সোজা ইসরাইলের মাটিতে রকেট হামলা এবং ইসরাইলের ২০ টি স্ট্র্যাটিজিক পয়েন্টে কমান্ডো হামলার মাধ্যমে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর ঘুম কেড়ে নিয়েছে হামাস। অনেকে ধারণা করছেন, হামাস বিগত ১৫ বছরে আয়রন ডোমের দুর্বলতা নিরূপন করে নতুন করে মিসাইল সিস্টেম ডেভেলপ করেছে। যা তাদের সাম্প্রতিক হামলায় সফলতা এনে দিয়েছে। অপরদিকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেদ করে একই সময়ে কমান্ডো অভিযান পরিচালনা রীতিমত হতবাক করেছে গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের।
এ সময় কেন এত বড় হামলা?
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অনেকগুলো বিষয় সামনে নিয়ে আসছেন এই আলোচনায়। প্রথমত, স্বল্পমেয়াদে সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বকে ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে নিরুৎসাহিত করতে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। কারণ সপ্তাহ দু’য়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে সৌদি যুবরাজ সালমান প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে প্রভাবিত করা হচ্ছে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। বাংলাদেশ সরকারও ভারতের প্রভাবে ইতোমধ্যে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছে। যার অংশ হিসেবে পাসপোর্ট থেকে ইসরাইলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নীরবে তুলে নেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের তৎপরতা মনিটরে ইসরাইলী কোম্পানি থেকে সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়েছে।
স্বল্প মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে পশ্চিমা থিঙ্ক ট্যাংকগুলোর পর্যালোচনায় বেরিয়ে আসছে।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল দীর্ঘ দিন ধরেই নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যে সুপার পাওয়ার ভেবে আসছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে গেল এক দশকের সংঘাত অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর এটি জানান দিতেই ইরানের তত্ত্বাবধানে এ হামলা হয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবী এখন প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত, আবারও দ্বিমেরু কেন্দ্রিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে বিশ্ব রাজনীতি। একভাগের নেতৃত্বে চীন-রাশিয়া, আর অপরপক্ষে আমেরিকা। এমন পরিস্থিতিতে সংগত কারণেই ইরান এখন রাশিয়া ও চীনের ব্লকে। হামাস হামলার পর এর সমর্থনে ইরানের প্রেসিডেন্ট রইসির পক্ষ থেকে শক্ত বিবৃতি পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতামতের সত্যতাই তুলে ধরছে।
তৃতীয়ত, বেশ কিছুদিন ধরেই গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলী সৈন্যদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। যেখানে হরহামেশো ফিলিস্তিনি নাগরিকরা নাজেহাল হচ্ছেন। বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশের ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিষয়টি ততো গুরুত্ব পাচ্ছিল না। প্রতিনিয়ত ইসরাইলী নিষ্পেষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় হামাস ইসরায়েলে বড় ধরনের হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি বলেছেন হামাসের সামরিক কমান্ডার মুহাম্মদ আল দেইফ । তিনি বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত দখল, বায়তুল মোকাদ্দাসের অপবিত্রীকরণ, সর্বোপরি নারীদের নাজেহালের প্রতিবাদেই হামাস “অপারেশন আল আককসা স্ট্রম” পরিচালনা করেছে।
চতুর্থত, গাজার মানবিক পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে- যা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিরোধের মনোবৃত্তি তৈরি করেছে। “সম্প্রতি সালাম ইয়া মাহদি” শীর্ষক একটি গান ফিলিস্তিনি যুবকদের হামাসে যোগ দিতে আগ্রহী করে তুলেছে। এ গানটি ৯টি ভাষায় অনূদিত হয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে। গাজার সবচেয়ে বড় সংকট খাবারের অভাব। গাজা উপত্যকার ৯০ শতাংশ লোক খাদ্য সংকটের মধ্যে রয়েছেন। বিদ্যুতের সংকট তো আছেই। ইসরায়েল গাজায় জ্বালানি সরবরাহ নিষিদ্ধ করেছে। ফলে মাত্র ১৩ ঘণ্টা মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পায়। যার ফলে গৃহস্থালীর কাজ, সেনিটেশন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে, যা প্রতিনিয়ত মানুষকে চরম ভোগান্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গাজায় বেশিরভাগ মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। তারা নিরাপদ পানি ব্যবহার থেকে বঞ্চিত। এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী মানবিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পাবার উদ্দেশে হামাস বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলার সর্বাত্মক ঘোষণা এসেছে ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছ থেকে। তবে নেতানিয়াহু যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কূটনৈতিক চ্যানেলগুলোও ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে কাতার ও মিশরকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনার জন্য।
ইসরায়েলকে যদি আবারও গাজা দখলে নিতে হয় তাহলে ব্যাপকহারে সাধারণ নাগরিকদের জীবনহানি ঘটবে। জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বে ইসরায়েল-বিরোধী জনমত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এ বিষয়টি নেতানিয়াহুকে মাথায় রাখতে হচ্ছে। যে সৈন্য ও সাধারণ নাগরিকদের হামাসের যোদ্ধারা ধরে নিয়ে গিয়েছে তাদেরকে ইতোমধ্যে গাজার স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে রাখা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সে সমস্ত জায়গায় ব্যাপকভিত্তিক হামলার সম্ভাবনা রয়েছে সে সমস্ত জায়গায় বন্দিদের রাখার ফলে হামলা করতে ইসরায়েলকে দশবার চিন্তা করতে হবে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, গাজায় ইসরায়েল চিরুনি অভিযানের দিকে যাবে । প্রতিটি বাড়ি তন্ন তন্ন করে সার্চ করবে। কিন্তু এটা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
ইতোমধ্যে তালেবানদের পক্ষ থেকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি চাওয়া হয়েছে তিনটি দেশের কাছে। লেবাননের হেজবুল্লাহও প্রস্তুত হামাসকে সহযোগিতা করতে। পেছনে ইরান তো রয়েছেই। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সবধরণের সহযোগিতার ঘোষণা এসেছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের কাছ থেকেও এসেছে অনুরূপ আশ্বাস। এমন বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্যে আবারও বড় ধরনের কোনো সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে কিনা সেই আশঙ্কাই ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্ব রাজনীতিতে।
Discussion about this post