অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার যোদ্ধাদের আকস্মিক এক আক্রমণের শিকার হলো ইসরাইল। দখলদার রাষ্ট্রটি কখনো যা কল্পনাও করতে পারেনি, সেটাই করে দেখিয়েছে হামাস। গাজা-ভিত্তিক এই প্রতিরোধ সংগঠনটি ৭ অক্টোবর শনিবার ভোরে একযোগে অনেকগুলো ফ্রন্টে আক্রমণ চালিয়ে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যুহ এলোমেলো করে দেয়। জল, স্থল, আকাশ সব দিক থেকে এক যোগে আক্রমণ করে হামাসের যোদ্ধারা। একই সাথে অন্তত ২২টি পয়েন্টে সীমানা প্রাচীর ভেঙে ঢুকে পড়ে ইসরাইলি শহর, গ্রাম, বসতিতে। কোনো কোনো এলাকায় ইসরাইলি ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকেছে হামাসের যোদ্ধারা। এই আক্রমণে তিন শতাধিক ইসরাইলি নিহত হয়েছে ও অনেককে বন্দী করে গাজায় নিয়ে গেছে হামাস।
রোববার সন্ধ্যায় এই লেখা যখন লিখছি, তখনও দুই পক্ষের মাঝে লড়াই চলছিল। গাজায় পাল্টা বিমান হামলায় নিহত হয়েছে তিন শতাধিক ফিলিস্তিনি। কাজেই দ্রুত যুদ্ধবিরতি না হলে এই সঙ্ঘাতের ফলাফল ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে- সেই আভাস ইতোমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।
আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এতবড় আক্রমণের কথা ঘূণাক্ষরেও টের পায়নি ইসরাইলি গোয়েন্দারা। বলা হয়ে থাকে, ইসরাইল রাষ্ট্রটি টিকে আছে তাদের গোয়েন্দা সামর্থ্যের ওপর। গোয়েন্দা তৎপরতা দিয়েই তেলআবিব নিজের প্রতিরক্ষা এবং সারা বিশ্বে রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখে; কিন্তু দেশটির দাপুটে সব গোয়েন্দা সংস্থার চোখে ধুলো দিতে পেরেছে হামাস। এত বড় অভিযানের জন্য হামাসকে নিশ্চয়ই অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে; কিন্তু ইসরাইল কিছুই টের পায়নি। এটি অবশ্যই হামাসের একটি সফলতা এবং ইসরাইলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা।
মোসাদ, শিন বেট, ডোমেস্টিক ইন্টেলিজেন্সের মতো সংস্থাগুলোও হয়তো শনিবারের হামলার তীব্রতা দেখে গায়ে চিমটি কেটেছে। কারণ ইসরাইলের মতো একটি রাষ্ট্র, যারা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়- তাদের দেশের ভেতরে ঢুকে এই হামলা প্রমাণ করে- ইসরাইল অজেয় নয়। হামাসের মতো একটি সংগঠনও তাদের বেকায়দায় ফেলতে পারে।
এর আগেও হামাসের রকেট হামলার সামনে ইসরাইলের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের দুর্বলতা ধরা দিয়েছে। তবে এবার ইসরাইলি আয়রন ডোমের ব্যর্থতার হার অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে। স্থলযুদ্ধেও হামাস যে কতটা দক্ষতা অর্জন করেছে সেটির জলন্ত প্রমাণ হয়ে থাকবে এবারের অভিযান। হয়তো দিনের পর দিন ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি নিপীড়নের ফলে জমা হওয়া ক্ষোভই সংগঠনটি উগড়ে দিয়েছে এবার। ভেতরে ভেতরে ফুসতে থাকা আগ্নেয়গিরি হঠাৎ লাভা উদগীরণ করেছে।
হামাস কেন এই সময়ে আকস্মিক এই যুদ্ধ শুরু করলো তার সম্ভাব্য তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন আল জাজিরার জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা। এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, তিনটি কারণে হামাস এই সময়ে এই অভিযান পরিচালনা করে থাকতে পারে- প্রথমত, দীর্ঘদিনের দখলদারিত্ব, নিপীড়ন, অবৈধ বসতিস্থাপন ও ফিলিস্তিনি ধর্মীয় স্থাপনাগুলো- বিশেষ করে আল আকসা মসজিদের অবমাননার প্রতিশোধ নেওয়া, দ্বিতীয়ত- ইসরাইলের আগ্রাসী সরকারের সাথে আরবদের সম্পর্ক স্থাপনের বিরোধিতা জানান দেওয়া এবং তৃতীয়ত, ইসরাইলি সেনা ও নাগরিকদের বন্দী করে তাদের বিনিময়ে নিজেদের সদস্যদের ইসরাইলি কারাগার থেকে ছাড়িয়ে আনা।
চলতি বছরটি ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে রক্তাক্ত বছর। এবার প্রায় প্রতিদিন ইসরাইলি বাহিনীর হাতে কোনো না কোনো এলাকায় ফিলিস্তিনিদের হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি হতাহত হয়েছে পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে। জেনিনের উদ্বাস্তু শিবিরে মিলিশিয়া বিরোধী অভিযানের নামে বৃদ্ধ থেকে শিশু- সবাইকে নির্বিচারে গুলি করেছে ইসরাইলি বাহিনী। এ বছর জানুয়ারি থেকে এই যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে দুইশ’র বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক। প্রায় প্রতিদিনই ইসরাইলি সেনারা গুলি চালিয়েছে। আবার অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরাও অনেকবার হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোতে। সর্বশেষ হামাসের অভিযানের আগের দিনও কয়েক হাজার ইহুদি জোর করে প্রবেশ করেছে আল আকসা মসজিদে। এতসব ক্ষোভের বিস্ফোরণ হতে পারে হামাসের এই অভিযানের কারণ।
আবার সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপনের আলোচনাও বেশ জোরেসোরে অগ্রসর হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুজন ইসরাইলি মন্ত্রী প্রকাশ্যে সৌদি আরব সফর করেছেন। রিয়াদ ও তেলআবিবের মধ্যে ওয়াশিংটনের মধ্যস্ততায় হয়তো শিগগিরই সম্পর্ক স্থাপিত হবে। উভয় পক্ষই সেই পথে হাঁটার আভাস দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ফিলিস্তিনিদের উদ্বেগ আছে।
কারণ সৌদি আরব শুরুতে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার শর্ত হিসেবে সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বললেও পরে সেই শর্ত থেকে সরে আসতে পারে তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে, এখন মোহাম্মাদ বিন সালমানের প্রশাসন দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে- এক, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি- যার মূল শর্ত হতে পারে বাইরের কোনো দেশ থেকে সৌদি আরব আক্রান্ত হলে মার্কিন সহায়তা পাওয়া এবং দুই, বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য ওয়াশিংটনের সম্মতি আদায় করা।
ইরান পারমাণবিক শক্তি অর্জন করার পর থেকে সৌদি আরবের শাসকদের মাঝেও পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখা যাচ্ছে। কাজেই এই দুটি রাষ্ট্রীয় ‘অর্জনের’ বিনিময়ে সৌদি আরব ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের কথা ভুলে যেতে পারে। আর সেটি মনে করিয়ে দিতেই হামাস এই পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনও ঘটনার পরপরই একই সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
এর আগে আরব বিশ্বের যে চারটি দেশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে তারা সবাই সৌদি মিত্র হিসেবে পরিচিত। রিয়াদের গ্রিন সিগনাল নিয়েই তারা ওই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে মনে করা হয়। আব্রাহাম অ্যাকর্ড নামক ওই চুক্তির পর থেকেই ওয়াশিংটন ও তেলআবিব সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনার বিষয়ে প্রকাশ্য কথা বলছে। এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার একটি পদক্ষেপ হতে পারে হামাসের এই আক্রমণ। মুসলিম বিশ্ব দিনে দিনে যে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার কথা ভুলে যাচ্ছে, সেটাই হয়তো তারা মনে করিয়ে দিতে চাইছে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে।
নেপথ্যের কারণ যাই হোক, ফিলিস্তিনের বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্ব যে একচোখা নীতি গ্রহণ করে আসছে সেটি আরো একবার চোখ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই ঘটনা। শনিবার ভোরে ইসরাইলি নাগরিকদের ঘুম ভাঙার আগেই একযোগে কয়েকটি ফ্রন্টে হামলা চালায় হামাসের যোদ্ধারা। কিন্তু হামলার খবর পেয়ে ওয়াশিংটন, প্যারিস, বার্লিনের কর্মকর্তাদের ঘুম ভাঙতে মোটেই দেরি হয়নি। তারা দ্রুই সেই গৎবাঁধা বুলি- ‘প্রতিরক্ষার অধিকার রয়েছে ইসরাইলের’ আওড়াতে শুরু করে। অথচ দিনের পর দিন ইসরাইলি আগ্রাসন, অবৈধ নতুন নতুন বসতি স্থাপন আর ফিলিস্তিনিদের বুকে চালানো গুলির শব্দ তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না।
হামাস বলছে, তারা এই আঘাতের মাধ্যমে দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে চায়; কিন্তু বাস্তবে তার বিপরীতটাও হয়তো ঘটতে পারে। আরো বাড়তে পারে ইসরাইলি নিপীড়ন। ইতোমধ্যে গাজায় বিমান হামলায় কয়েকশো ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। শোনা গেছে, গাজা উপত্যাকায় স্থল অভিযানের পরিকল্পনাও করছে তেলআবিব। ইসরাইল তার কয়েকশো নাগরিকের লাশ ‘উপহার’ পাওয়ার প্রতিশোধ নিতে এখন হয়তো মরিয়া হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যেই তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই অঞ্চলটি হয়তো আবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্বাক্ষী হতে চলেছে।
ইসরাইলের প্রতি পশ্চিমাদের সমর্থনের বিপরীতে হামাসকে সমর্থন দিয়েছে শুধু ইরান ও লেবাননের ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ। এছাড়া দু’একটি দেশ ইসরাইলকে দোষারোপ করে বিবৃতি দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা লাঘবে মুসলিম বিশ্বকে খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এবারেও যুদ্ধ বন্ধে এখন পর্যন্ত তেমন কোন পদক্ষেপের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সংঘাত কখনোই কাম্য হতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের পক্ষ থেকে সম্মিলিত চাপ প্রয়োগ করতে পারলে এই সংঘাত থামানো সম্ভব। সে জন্য হামাস ও ইসরাইল উভয় পক্ষকে নিবৃত করতে হবে। হামাসের অভিযানের পর এখন ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের প্রতিশোধ স্পৃহা আরো বেড়ে যেতে পারে। এমনকি ইসরাইল সমগ্র পশ্চিম তীর দখল করে নিতে পারে এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর জাতিগত নিধনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা। এসব বিষয় মাথায় রেখেই যুদ্ধবিরতির জন্য প্রচেষ্টা শুরু করা উচিত। পাশাপাশি স্থায়ীভাবে সংঘাত বন্ধে অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের দুদর্শার বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। নতুবা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের এমন ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যে কোনো সময়। তাতে আরো বাড়বে লাশের মিছিল। দীর্ঘ হবে সঙ্কট।
Discussion about this post