৩০ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এ সরকারকে অবৈধ বলেন, কিন্তু মিটিং করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। না নিলে খবর আছে। অনুমতি না নিলে পালাবার পথ পাবেন না। পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু মিটিং করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। না নিলে খবর আছে। অনুমতি না নিলে পালাবার পথ পাবেন না। পালিয়ে যেতে হবে।’ (ডেইলি স্টার বাংলা)
এরপর ২ অক্টোবর নবনিযুক্ত ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিক দল যত বড়ই হোক না কেন, অনুমতি ছাড়া রাজধানীতে কোনো অনুষ্ঠান করা হবে না। কোনো দল যদি অনুমতি ছাড়া মিছিল, সভা বা সমাবেশ করার চেষ্টা করে নিয়ম ভঙ্গ করে, তাহলে ডিএমপির যেকোনো ইউনিট নির্ভয়ে আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে।’
তিনি বলেন, সোমবার বিরোধী দলের সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে। তারা আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে এবং নিয়ম মেনে সমাবেশের আয়োজন করছে।
তারা দুজনই সম্ভবত বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এমনটা বলেছেন। তাদের বক্তব্যের আগে আমীর খসরু ঢাকার আমিনবাজারের সমাবেশে বলেছেন, ‘আগামীতে বিএনপির সমাবেশ করতে আর কারো অনুমতি লাগবে না। তারেক জিয়ার নির্দেশেই বিএনপির নেতাকর্মীদের রাজপথ দখলে রাখতে হবে। যা কিছু ফায়সালা হওয়ার রাজপথেই হবে’। (মানবজমিন)
৫ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রামে রোডমার্চ কর্মসূচির জন্যও বিএনপি অনুমতি নেয়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা অনেক সহ্য করেছি। আর নয়। এখন রোডমার্চ কর্মসূচির জন্য প্রশাসন থেকে কোনো অনুমতি নেবো না। তবে অবহিত করব। তিনি রোডমার্চ সফলে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন।’ (জাগো নিউজ)
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমাবেশের অনুমতি নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। অনুমতিকে কেন্দ্র করে সভা-সমাবেশে বাধা আরোপের বিষয়ে জাতিসংঘ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ আপত্তি জানিয়ে আসছে। তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিও জানাচ্ছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা শুরু করেছে। এ ভিসা নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ গণতান্ত্রিক আচরণের ঘাটতি। তা অব্যাহত না থাকলে আরো বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে জানানো হয়েছে।
বিএনপির জন্য সমাবেশের অনুমতি লাগলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য তার প্রয়োজন হয় না, এমন বিষয় নিয়েও পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ নিয়ে এই অনুমতি-সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেয়। তখন দেখা গেছে, দুই দলের জন্যই সমান ২৩ শর্তে সমাবেশের ‘অনুমতি’ দিচ্ছে পুলিশ।
এরপর থেকে অনুমতি নিয়ে আর কোনো গোলযোগ দেখা দেয়নি বাংলাদেশের রাজনীতিতে। তবে হুট করে আবার সভা-সমাবেশে অনুমতির বিষয়টি কেন সামনে আনলেন সরকারি দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা এবং ঢাকার পুলিশ প্রধান, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ এ কথার সহজ অর্থ সভা-সমাবেশ করার অধিকার সবার আছে। এ অধিকার রহিত করা যেতে পারে শুধু কিছু ক্ষেত্রে। সেগুলো হলো- জানমালের ক্ষতি, অস্থিতিশীলতা তৈরি ইত্যাদি।
কেউ কখনো বলে না যে, আমরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য অথবা জানমালের ক্ষতি করার জন্য সমাবেশ করবো। সমাবেশ মাত্রেই যে কারণে শান্তিপূর্ণ। যদি তা অশান্তি সৃষ্টি করে, ভাঙচুর করে তাহলে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে বিশৃঙ্খলা হতে পারে এমন আগাম আশঙ্কা থেকে অনুমতির অপেক্ষায় কোনো সমাবেশ আটকে রাখার বিধান নেই দেশে। যদি সংশয় থাকেও, সেক্ষেত্রে সমাবেশ আহ্বানকারী পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে।
মানবাধিকার কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন যে, সমাবেশের জন্য অনুমতি নয়, বরং পুলিশকে অবহিত করা যেতে পারে। যাতে করে সমাবেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়, একই সময়ে একই স্থানে অন্য সমাবেশ না হয়, সমাবেশ যেন কারো ক্ষতির কারণ না হতে পারে। এখানে অবহিত করার বিষয়টিকে অনুমতি হিসেবে দেখালে তাতে নাগরিক অধিকার খর্ব হয়।
বিরোধী দলগুলোর গত এক বছরের সমাবেশে বিশৃঙ্খলা বা ভাঙচুর, জানমালের ক্ষতির ঘটনা বলতে গেলে ঘটেনি। তারপরও সরকারি দল ও পুলিশের পক্ষ থেকে যখন অনুমতির কথা বলা হচ্ছে, তখন বিএনপি বিষয়টি কীভাবে দেখবে তার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি নিয়ে তুমুল আলোচনা ওঠে ২০১৩ সালে। ওই বছরের ৫ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও প্রাণহানি ঘটে। শাপলা চত্বর থেকে রাতের আঁধারে হেফাজতকে উচ্ছেদ করা হয়। এর কিছুদিন পর রাজধানীতে সভা-সমাবেশে নিষিদ্ধ করা হয়। যাকে সরাসরি জরুরি অবস্থা হিসেবে উল্লেখ করা না হলেও কোনো দলকেই তখন সমাবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, সংবিধানে যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে সভা-সমাবেশের অধিকার দেওয়া আছে। এর অর্থ হলো, সমাবেশ যারা করবেন তারা জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করবেন না, গাড়ি-বাস-ট্রেনে আগুন দেবেন না, কোরান শরীফ পোড়াবেন না।
তিনি বলেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত না হচ্ছি যে সমাবেশের নাম করে দুর্বৃত্তরা ওই ধরনের কাজগুলো করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এই যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের আওতায় আমরা সভা-সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা বলেছি এটা হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য।
কেউ কেউ মনে করেন, এবারও সমাবেশের অনুমতিকে কেন্দ্র করে এ ধরনের বিধি-নিষেধের আরোপ ঘটতে পারে। সরকারি দল ও পুলিশের হুঁশিয়ারি হয়তো সেটাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার অবাধ অধিকার ছাড়া একটি নির্বাচনী পরিবেশ কীভাবে তৈরি করা সম্ভব?
Discussion about this post