মহাভারতের যুদ্ধে শকুনী একবার দুর্যোধনকে বলেছিল, ‘তুমি যদি কখনো কোনো পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনতে না পারো, তবে তাকে শত্রুর প্রতিকূল বানিয়ে ফেল।’
দুর্যোধন তথা কৌরবরা সে উপদেশ মানুক না মানুক, অষ্টাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’-র নেতারা এই উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন।
ভারতের জনগণ ভোটের মাধ্যমে জনাদেশ যা দিয়েছে তার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। একদম খোলা চোখে দেখলে সংখ্যাগুলো এরকম- বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ ২৯০+, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ইন্ডিয়া(INDIA) ২৩৫+। এছাড়াও কাশ্মির, লাদাখ, পাঞ্জাব থেকে কয়েকজন নির্দলীয় এমপি জিতেছেন- যাদের দুইজন মুসলিম, দুইজন শিখ এবং এরা সবাই তীব্র বিজেপি-বিরোধী। আর আছে হায়দারাবাদের সাংসদ ব্যারিস্টার আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। এঁদের ধরলে বিজেপি বিরোধী জোটের মোট প্রাপ্ত আসন ২৪০+। ৫৪৩ আসন বিশিষ্ট পার্লামেন্টে সরকার গড়তে চাই ২৭২ টি আসন, যেটা মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের আছে। তবুও কেন এই নির্বাচনকে তার হার হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেই বিশ্লেষণই করা যাক।
খুব বেশি দিন না, মাত্র ছয়মাস পেছনে ফিরে তাকানো যাক। ২০২৩-এর ডিসেম্বরে ভারতের অন্যতম প্রধান চার রাজ্যে যথা মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানার বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই রাজ্যেগুলোর মধ্যে ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে কংগ্রেসের সরকার ছিল, মধ্যপ্রদেশেও তারা ২০১৮ তে জিতেছিল কিন্তু বিধায়ক কেনাবেচার খেলায় সেই সরকার পড়ে যায়। অর্থাৎ এই রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসের ভালো ফল করার কথা ছিল। কিন্তু নির্বাচনের রেজাল্টের দিনে দেখা যায় ভূমিধ্বস পরাজয় হয়েছে কংগ্রেসের। কোনোক্রমে তেলেঙ্গানাতে মুখ রক্ষা করে তারা। ফলে বিজেপি অনুসারীরা চারদিকে আরো নতুন উদ্যেমে শুরু করে ‘ব্র্যান্ড মোদী’ জয়ধ্বনি। এরই মধ্যে কাজ অসমাপ্ত থাকা সত্ত্বেও মহাসমারোহে উদ্বোধন করা হয় অযোধ্যার সেই বহুল আলোচিত রামমন্দির। আত্মবিশ্বাসে ফুটতে থাকা বিজেপি এবার টার্গেট বেঁধে দেয় চারশো আসন জয়ের। যেটা ভারতের ইতিহাসে একবারই শুধু ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ১৯৮৪ সালে জিততে পেরেছিল। বলা হয়ে থাকে, টেস্ট ক্রিকেটে ব্রায়ান লারা’র চারশো রান আর রাজীব গান্ধীর চারশো আসন জয়ের রেকর্ড ভাঙা অসম্ভব। মোদী কার্যত চ্যালেঞ্জ করে বসলেন সেই মিথকে। পরিস্থিতি তার অনুকূলে, বিরোধীরা ছন্নছাড়া, অধিকাংশ বড় বড় রাজ্যের বিধানসভাগুলোতে তাদের দল ক্ষমতায়। আত্মবিশ্বাসের একপর্যায়ে ইডি, সিবিআই দিয়ে গ্রেপ্তার করালেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেনকে। অনবরত গ্রেফতারির হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে। এমতাবস্থায় কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে তৈরি করা হয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনক্লুসিভ এলায়েন্স ‘ইন্ডিয়া’। এই জোটের অন্যতম শরিক ছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার, যার কথায় পরে আসছি।
সবকিছু বিজেপির প্ল্যানমাফিকই হচ্ছিল। চারশো আসনে জয়ের লক্ষ্য সামনে রেখে জোরকদমে চলা নির্বাচনী প্রচারের একপর্যায়ে ছোট একটা ভুল করে ফেলে তারা। চ্যালেঞ্জ করে বসে খোদ জাতীয় সংবিধানকে। একজন বিজেপি নেতা বলে ফেলেন, আমরা চারশো আসনে জিতলে সংবিধান বদলে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করে নতুন সংবিধান পাশ করাবো। ব্যস, রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে তাবড়-তাবড় বিরোধী নেতারা প্রচার শুরু করে দেয়, বিজেপি সংবিধান বদলে দেবে! বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকারের করা সংবিধান বদলে দেবে! এই প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হয় দলিত- পিছিয়ে পড়া সমাজ এবং মাইনোরিটি মুসলিম-শিখ সমাজ। তাদের ভোট কনসলিডেট হয়। যার ফল আজকের এই নির্বাচনী রেজাল্ট।
এখন প্রশ্ন হলো কেন ২৯০+ আসন জিতেও স্বস্তিতে নেই নরেন্দ্র মোদী? এর উত্তর হলো, এই ২৯০ আসনের মধ্যে এমন দু’টি দল আছে যারা কয়েকমাস পূর্বেও বিজেপি জোটে ছিল না, কেবলমাত্র ভোটের ক্যালকুলেশনে লাভ করতে সাময়িকভাবে জোটে এসেছে। ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’র মানদণ্ডে তাদের ট্র্যাক রেকর্ড মোটেও ভালো নয়। যেমন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার, যিনি জাতীয় রাজনীতিতে ‘পেন্ডুলাম কুমার’ নামেও পরিচিত। তার গত দশ বছরের জোট রাজনীতির ছোট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনে নীতিশের দল জেডিইউ, কংগ্রেস এবং লালু যাদবের দল আরজেডি-র সাথে জোট করে বিজেপিকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার কংগ্রেসের সাথে জোট ভেঙে বিজেপির সাথে জোট করে। ঠিক তার তিনবছর পরে বিজেপির সাথে জোট ভেঙে কংগ্রেস-আরজেডির সাথে জোট করে নতুন করে ক্ষমতায় বসে। এ পর্যায়ে মানুষকে বোঝাতে থাকেন দেশের স্বার্থে বিজেপিকে হারাতে হবে বিরোধীদেরকে একত্রিত হতে হবে। বিজেপি বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ এলায়েন্স গঠনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু কিছুদিন পরে এই জোট বিজেপিকে হারাতে যথেষ্ট কাজ করছে না এই অজুহাত তুলে নিজেই আবারো বিজেপি জোটে যোগ দেন। তাই দিল্লিতে কান পাতলে শোনা যায়, ‘নীতিশ সাবকা হ্যায়’। আসল ব্যাপার হলো রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি চরম উচ্চাভিলাষী। ৮ বারের মুখ্যমন্ত্রী তিনি, এ পদে আর মন বসে না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেকদিনের স্বপ্ন ওনার। সাকুল্যে ১২ সিট পাওয়া জেডিইউ-এর নিতিশ কুমারকে বিজেপি কোনদিন প্রধানমন্ত্রী করবে না। কিন্তু বিরোধীরা যদি অফার করে? ঠিক একই ব্যাপার অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইড়ুর ক্ষেত্রে। কয়েকবারের মুখ্যমন্ত্রী উনি, এ পদে আর ক্রেজ পান না। চান প্রধানমন্ত্রী হতে। এই নির্বাচনের ঠিক আগের ভোটে, অর্থাৎ ২০১৯ এর ভোটে ইনিই দিল্লিতে দৌঁড়োদৌড়ি করছিলেন বিজেপি বিরোধী দলগুলোকে এক করতে, ফাঁক তালে যদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আসে সেই আশায়। তার দল তেলেগু দেশম পার্টির মোট আসন ১৬ টি। কাজেই নীতিশের ১২ আর এই ১৬ আসন ধরে যে সরকার চলবে আর যাই হোক সেই সরকার কখনো স্টেবল সরকার হতে পারে না। ‘ব্র্যান্ড মোদী’ তো দূর অতীত। অযোধ্যাতে বিজেপি হেরেছে। প্রচারের এক পর্যায়ে উন্মাতাল হয়ে নিজেকে ঈশ্বরের অবতার ঘোষণা করা মোদী স্বয়ং পুণ্যভূমি বেনারসে কংগ্রেসের এক অখ্যাত নেতা অজয় রায়ের কাছে শুরুর ধাপগুলোতে পিছিয়ে ছিলেন। অনেক অহংকারের উত্তর প্রদেশের অর্ধেকের বেশী সিটে হেরে গেছে বিজেপি। কাজে আসেনি যোগী আদিত্যনাথের ক্যারিশমাও। বরং নতুন করে উত্থান হয়েছে দুই গান্ধীর। ইন্দিরা গান্ধীর নাতি, রাজিব গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধী এবং মেয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। গত নির্বাচনে খাসতালুক আমেথি থেকে হেরে গিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। তাকে হারিয়ে উদ্ধত বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানি সংসদে লাগাতার অসভ্যতা করে গেছেন গান্ধী পরিবারের সাথে। পার্লামেন্টে যেকোন ইস্যুতে ‘জবাব দো সোনিয়া গান্ধী’ বলে উন্মত্ত ভঙ্গিতে চেঁচামেচি করতেন তিনি। সোনিয়া গান্ধীর মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত ইস্যু হিসেবে নেন। আমেথি থেকে নিজেরা না দাঁড়িয়ে তুলনামূলক লো প্রোফাইলের গান্ধী পরিবারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সচিব কিশোরী লাল শর্মাকে দাঁড় করিয়ে দেন। নিজে দুই সপ্তাহ মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন আমেথি-রায়বেরিলিতে। ফলাফল, রায়বেরিলি থেকে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ভোটে রাহুলের জয় এবং আমেথিতে সেই স্মৃতি ইরানির বিরুদ্ধে ১ লাখ ৬১ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়। রাহুল গান্ধীর মোহাব্বত কি দুকানের কেনাবেচা নির্বাচনী মেলায় এই প্রথম হয়তো এত ভালো হলো। ভারত জোড়ো যাত্রার পরে রাহুল গান্ধীকে মানুষ সত্যিকারের নেতা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন।
আপাতদৃষ্টিতে যা বোঝা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। যদিও আরএসএস-এর একটা অংশ ওনাকে প্রধানমন্ত্রী না করে নিতিন গড়করি বা রাজনাথ সিং বা শিবরাজ সিং চৌহানকে প্রধানমন্ত্রী করার পক্ষে। আবার এই নির্বাচনের পরে বিজেপির গুজরাট লবির সাথে কট্টর আরএসএস যোগী আদিত্যনাথ লবিগুলোর মধ্যেও টানাপোড়েন চলছে। মোদির এই মেয়াদ মোটেও তার জন্যে সুখকর হবে না। একটা দুর্বল কোয়ালিশন সরকার চালাতে গিয়ে যে জটিলতাগুলো তৈরি হবে, তা তার জন্যে মোটেও স্বস্তিদায়ক হবে না এবং আরো অজনপ্রিয় হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অপরদিকে কংগ্রেস কোনো তাড়াহুড়া করতে চায় না। সবে ‘ব্র্যান্ড রাহুল’ গড়ে উঠছে, এখনো সেটা মোদীর ইমেজের সমতুল্য হয়ে ওঠেনি। এমতাবস্থায় একে ওকে ধরে রাহুল মমতা অখিলেশরা কোয়ালিশন সরকার গড়লেও কিছুদিনের মধ্যে ভেতর-বাইরের মতানৈক্য সরকার পড়ে যাবে এবং মোদি হয়তো সাতাত্তরে হেরে যাওয়া ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৮০ তে বিপুল ভোটে জিতে আসার মতো কামব্যাক করে ফেলবেন। অতএব, তাড়াহুড়া করে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নয়। ভোটের রাজনীতিতে মোমেন্টাম খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাকেই ধরে রাখতে হবে। এবছরের শেষে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানায় ভোট। আগামী বছর বিহার এবং তারপরেই সবচেয়ে বড় প্রদেশ উত্তর প্রদেশের বিধানসভা ভোট। এই বড় বড় রাজ্যেগুলো জয় করে গ্রাউন্ড আরো শক্ত করে তবেই হয়তো তারা মোদীকে সটানে ফেলে দিতে পারবে। আঞ্চলিক ভাবে রাহুল, মমতা, অখিলেশ, স্ট্যালিন, তেজস্বী, উদ্ধভ ঠাকরে, শারদ পাওয়াররা আরেকটু শক্তি অর্জন করতে চাইবে। ততক্ষণ অব্দি কেন্দ্রে নড়বড়ে শাসন চলতে থাকুক। লোকসভায় ভালো ফল করায় এবার বিরোধীদের রাজ্যসভা তথা সংসদের উচ্চকক্ষেও আসন বাড়বে। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে বিজেপি জোট। নিজের ইচ্ছায় তারা আর বড় কোনো বিল পাশ করাতে পারবে না। দিল্লির সিংহাসন তখন হয়তো আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরের সময়কার মত টলোমলো করবে। কাজেই এই জয় স্বস্তি দিচ্ছে না বিজেপিকে। আবার সংখ্যার বিচারে কংগ্রেসের কাছেও এই ফল ‘দিল্লি আভি দূর হ্যাঁয়’-ই। অতএব, আপাতত এই লড়াইয়ে জয়ী একজনই। তিনি বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকার, স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধান রচয়িতা।
Discussion about this post