বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সংগঠন হিসেবে বেশ শক্তিশালী। এই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দল ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য এবং নিয়মানুবর্তিতা, ঐক্য ও সংহতির অসাধারণ নজির পাওয়া যায়। এগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুর্লভ ব্যাপার। বোঝা যায়, সংগঠন গড়ে তুলতে, নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষিত করতে দলটি যথেষ্ট শ্রম দেয়। তাদের আভ্যন্তরীণ নীতি ও কৌশল বেশ কার্যকর। আর এ কারণেই, দলটির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবার মৃত্যুদণ্ডের পরও দলটি ভালভাবেই টিকে আছে। শুধু মৃত্যুদণ্ড নয়, দলটির বহু নেতাকর্মী জেল-জুলুমসহ নানা বাধার মুখোমুখি হয়েছেন। নেতাদের একের পর এক জেলে নেওয়া হয়েছে। নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আইনগত ও রাষ্ট্রীয় বাধা তৈরি করা হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে জামায়াতকে দুর্বল করা যায়নি। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বলছে, জামায়াতের জনসমর্থন বেড়েছে, তাদের কর্মীর সংখ্যাও বেড়েছে। শত বৈরিতার মধ্যেও অল্প সময়ের নোটিশে ঢাকায় বিশাল জমায়েত করার সক্ষমতা তারা সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত দুবার দেখিয়েছে।
কেউ কেউ বলেন, জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। প্রথমে তীব্র সরকার-বিরোধী অবস্থান নিলেও বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তারা কৌশল হিসেবে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি অবলম্বন করেছে। অনেকটা সময় চুপ থেকে ভেতরে ভেতরে সংগঠন গোছানোর কাজে মন দিয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সরকারী দলের সঙ্গে মিশে গিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছে। এসবের মাধ্যমে তারা বৈরিতা মোকাবেলা করে নিজেদের টিকিয়ে রাখার উপায় বের করেছে। তাতে সফলও হয়েছে।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, জামায়াতের গঠনতন্ত্র বা দলিলে যাই থাকুক, দলটি প্রয়োগিকভাবে যথেষ্ট আধুনিক। ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ডিসিপ্লিনড তো বটেই, সবচেয়ে অগ্রসরও। কিছু ক্ষেত্রে মতাদর্শিকভাবেও তারা অন্য ইসলামপন্থী দলগুলোর চেয়ে উদার।
জামায়াত আলিয়া মাদ্রাসার ব্যাপারে বেশ উৎসাহী, কওমী মাদ্রাসা থেকে তুলনামূলকভাবে দূরেই থেকেছে। কিন্তু তাদের মূল নজর সরকারী কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। জামায়াত সবসময়ই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করা চেষ্টা করেছে। মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র সংগঠনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় জায়গা করার ব্যাপারে জামায়াতের মতো আর কোনো ইসলামপন্থী দল এত মনোযোগী হয়নি। জামায়াতের লোকেরা নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে গিয়ে সারা দেশে যত কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট স্কুল ও কলেজ, মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট বিদ্যালয়, কলেজে খুলেছে আর কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে ইতিহাসে তেমনটি করেনি। তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তৈরি করেছে।
জামায়াতের লোকেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি হাসপাতাল, ব্যাংক, বীমা, সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সংবাদমাধ্যম, থিংকট্যাঙ্ক, সাহিত্য শিল্পের সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানও গড়েছে।
একটি রাজনৈতিক দল এত সংগঠিতভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে চেয়েছে এমন উদাহরণ আমাদের সামনে নেই। এসব কারণে জামায়াতকে আধুনিক ও অগ্রসর দল না বলার উপায় নেই। অবশ্য গত ১৫ বছরে জামায়াতের অধিকাংশ লাভজনক প্রতিষ্ঠান হয় বেদখল হয়েছে, নয়তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান সরকারী দলের লোকদের সঙ্গে রফা করে টিকে গিয়েছে।
জামায়াত ক্ষমতা কেন্দ্রগুলোতে নিজেদের লোক বসাতে চেয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণে তারা যথেষ্ট সফলও হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার দৃশ্যমানভাবে তাদের এই স্ট্রংহোল্ডগুলো ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কতটুকু সফল হয়েছে তা সময়ই বলে দেবে।
জামায়াতে ইসলামীর সার্বিক কার্যক্রম দেখলে না বোঝার কারণ নেই যে দলটি তাদের প্রতি বৈরী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যেই নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান গড়তে চেয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আস্থা অর্জন করতে চেয়েছে। তবে, এ কাজে তারা খুব বেশি সফল হতে পারেনি।
প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থানের কারণে মধ্যশ্রেণী দলটির প্রতি আকৃষ্ট হয়নি।
দ্বিতীয়ত, সারা পৃথিবীতেই মধ্যশ্রেণী র্যাডিকেলাইজেশনের বিরুদ্ধে। তারা সুবিধাভোগী ও বড় ক্রেতাগোষ্ঠী। স্থিতিশীলতার পক্ষের সবচেয়ে বড় সমর্থক। যথাসম্ভব উপভোগবাদী ও মুক্তজীবনের কাছাকাছি থাকার পক্ষপাতি। ফলে, দেশের মধ্যশ্রেণীর বড় অংশ প্রাকটিসিং মুসলিম হলেও তারা জামায়াতের প্রতি কখনোই তীব্র আকর্ষণ ব্যক্ত করেনি। তারা হয়তো ইসলামী ব্যাংকের সুদমুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, ইবনে সিনায় চিকিৎসা নিতে গিয়েছে, কিন্তু জামায়াতে ভেড়েনি।
আমার বরং মনে হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের বেশি আকৃষ্ট করেছে। প্রায়োগিক দিক থেকে ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়ার একটা স্বপ্ন ও আশ্বাস থেকেই তারা শিবির ও জামায়াতে গিয়েছে বলে মনে হয়। এই ছেলেদের অংশগ্রহণ শিবির ও জামায়াতকে একটা ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। অবচেতনভাবেই জামায়াতের মধ্যে একটা মধ্যশ্রেণী বিরোধী মনোভাব তৈরি করেছে। বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের ছেলেদের কার্যক্রম দেখে আমার মনে হয়েছে, কোনো এক অজানা কারণে তারা মধ্যশ্রেণী থেকে আসা ছেলেমেয়েদের প্রতি বৈরীভাব পোষণ করে। তারা দীর্ঘসময় জুড়ে নানাভাবে এই ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করতো। এসব করে শিবির বা জামায়াতের কী উপকার হয়েছে জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, এটা এক ধরনের শ্রেণীঘৃণা। নিম্ন ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেরা মধ্যশ্রেণীর ছেলেমেয়েদের প্রতি যা সহজাতভাবেই পোষণ করে। এই ব্যাপারাটির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল মধ্যশ্রেণীর প্রতি শিবির ও জামায়াতের ঘৃণা যুক্ত হয়েছে। র্যাডিকেলাইজেশনের প্রতি মধ্যশ্রেণীর অনীহা বিষয়টিকে বাড়িয়ে তুলেছে। মধ্যশ্রেণীর সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক এর ফলে আরও বৈরী হয়েছে। এটা পরস্পরের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক বিভেদ বা কালচারাল গ্যাপ তৈরি করেছে। আমি দেখেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শিবির ও জামায়াতের কর্মীরা মধ্যশ্রেণীর প্রতি এক ধরনের সাধারণ ঘৃণা প্রকাশ করেন। যে এক্সপ্রেশনগুলো কোনোভাবেই রাজনৈতিক নয়। বোঝা যায়, তারা বৃহৎ মধ্যশ্রেণীর কাছ থেকে এলিয়েনেটেড ফিল করছেন। তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে না। মধ্যশ্রেণীর চিন্তা তারা ধরতে পারছেন না। ফলে, এত জুলুমের শিকার হয়েও মধ্যশ্রেণীর উপযুক্ত সহানুভূতি পাচ্ছেন না।
আমি জামায়াতে ইসলামীর দলিলপত্র পড়িনি, তবে তাদের কার্যক্রমের ধরন পযালোচনা করে আমার মনে হয়েছে, এই বৈরিতা অর্জন বোধহয় তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা বরং উল্টোটা চেয়েছিল। তবু এটা সত্য, উচ্চশ্রেণীর মধ্যে জামায়াতের অবস্থান বেশ ভাল। মধ্যশ্রেণীর মধ্যে তারা অল্প জায়গা তৈরি করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, দীর্ঘদিনের চর্চায় জামায়াত-সমর্থক একটা মধ্যশ্রেণীও তারা তৈরি করেছে। তবে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। তারা দীর্ঘমেয়াদী কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল সেটি যে দ্রুত সফল হতে যাচ্ছে না, সে মূল্যায়নও তারা করেছে বলেই মনে হয়। ফলে, আগের কর্মসূচির সমান্তরালে অন্য কৌশল নিয়েছে। আর সেখানেই বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক সংকটটি ঘণীভূত হয়েছে।
ক্ষমতা দখলের জন্য জামায়াত নতুন যে নীতিটি গ্রহণ করেছে তার সঙ্গে লেনিনের নীতির অনেকটা মিল আছে। ছোট কিন্তু সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত দল কীভাবে বড় ও অসংগঠিত দলকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের কাজে লাগাতে পারে সেটি রুশ বিপ্লবের সময় লেনিন হাতে-কলমে দেখিয়েছেন। জামায়াত বিএনপির সঙ্গে এই নীতিটিই অবলম্বন করে চলছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করলেও সরকার গঠনের জন্য তাদের জামায়াতের সমর্থন দরকার হয়ে পড়েছিল। জামায়াত ১৮ আসনের সমর্থন দিয়ে বিএনপির আস্থা অর্জন করেছিল সেবার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন করে নির্বাচন করে জামায়াত মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এ ঘটনা জামায়াতকে বেশ শক্তিশালী করে। পাশাপাশি দল হিসেবে বিএনপিকে দুর্বল করে দেয়।
একথা সত্য মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত উদার-গণতান্ত্রিক ও শাসকশ্রেণীর দল হিসেবে গড়ে উঠলেও বিএনপির মধ্যে মুসলিম উপাদান ছিল। দলটি প্রতিষ্ঠাকালে বেশ সাফল্যের সঙ্গে মুসলিম লীগ ও মাওলানা ভাসানীর রাজনীতি আত্মস্থ করতে পেরেছিল। ডানপন্থী রাজনীতিকদের পাশাপাশি বামপন্থী রাজনীতিকরাও দলটিতে যুক্ত হয়েছিলেন। শহুরে মধ্যবিত্তের পাশাপাশি দলটির বড় সমর্থক গোষ্ঠী ছিল গ্রামীণ কৃষকরাও। সব মিলিয়ে বিএনপি শুরু থেকে ইনক্লুসিভ রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছিল। কিন্তু বিএনপি কখনোই ইসলামপন্থী কোনো দল ছিল না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের সংশ্রব দলটির একটি ইসলামপন্থী ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। একথা সত্য, বিএনপি-জামায়াত শব্দ দুটি একসঙ্গে উচ্চারণ করার মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের প্রচারযন্ত্র বিএনপিকে ইসলামপন্থী দল হিসেবে ব্র্যান্ডিং করার চেষ্টা করেছে। একই সঙ্গে এটাও সত্য, জামায়াতের দীর্ঘমেয়াদী সংশ্রব বিএনপির ইসলামাইজেশন ঘটিয়েছে। বিএনপি বড় দল হলেও এটি জামায়াতের মতো সুসংগঠিত নয়। জামায়াতের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক ক্যাপাসিটিও দলটির নেই। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামায়াত বিএনপিকে যথেষ্ট পরিবর্তিত করেছে। বিএনপির ভেতর তারা জামায়াতপন্থী একটা বড় গ্রুপ তৈরি করতে পেরেছে। শুধু তা-ই নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে জামায়াতের লোকেরা বিএনপির লোক বলে ব্যাপকভাবে পরিচিতি অর্জন করেছে। একটা বড় সময় জুড়ে বোঝা খুব কঠিন ছিল, কোন কথাটি জামায়াতের কোন কথাটি বিএনপির। ২০১৮ সালের পর বিএনপি ধীরে ধীরে জামায়াতের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। অতিসম্প্রতি প্রকাশ্যে বলে যে, তাদের পুরনো জোট আর কার্যকর নেই।
জামায়াতের রাজনীতি সমর্থন না করলেও আমি এটা কখনোই মনে করি না যে, জামায়াতের রাজনীতির প্রয়োজন নেই। ইসলাম আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামের মধ্য দিয়ে সমাজের কোনো কোনো অংশের রাজনৈতিক অভিব্যক্ত প্রকাশিত হবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এই রাজনৈতিক অভিব্যক্তিগুলো ধারণ করার মতো রাজনৈতিক দল থাকতে হবে। এই দলগুলোকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে জায়গা দিতে হবে। তারা যাতে রাজনীতিতে নিজেদের অংশ দাবি করতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। এর অন্যথা হলে সমাজে অনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক উপাদান বাড়তে পারে। ফলে জামায়াত ও ইসলামপন্থীদের ধ্বংস, নিষিদ্ধ করার নীতি আমি কখনোই সমর্থন করি না।
এখন কথা হলো, বিএনপির রাজনীতি থেকে জামায়াতের রাজনীতি আলাদা। দুই দলের কর্মপদ্ধতি আলাদা। বিএনপি সমাজের সকল অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। জামায়াত সেটা করে না। জামায়াতের কর্মপদ্ধতি যতই উদার হোক, তারা যতই মধ্যবিত্তেকে কাছে টানার চেষ্টা করুক, তারা সমাজের র্যাডিকেল রূপান্তর চায়। রাষ্ট্র ও সংবিধানের মৌলিক রূপান্তর চায়। আর বিএনপি অবশ্যই বিপ্লবী কোনো দল নয়। তারা শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। এমন দুটি দলের দীর্ঘমেয়াদী জোট, একসঙ্গে পথ চলা দুই দলকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক অতীতে জোট প্রক্রিয়ায় বিএনপি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
১. বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতকে সঙ্গে রেখে বিএনপি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। প্রতিপক্ষ দল তাদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বলেও আখ্যায়িত করেছে।
২. বিএনপি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
৩. বিএনপির জামায়াতায়ন ঘটেছে।
৪. বিএনপিকে উদারনৈতিক দল থেকে ইসলামপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
৫. শহুরে মধ্যশ্রেণীর মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় বিএনপি এই অংশের মধ্যে ধীরে ধীরে অজনপ্রিয় হয়েছে।
৬. কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপির মধ্যে এক ধরনের জামায়াত-নির্ভরতা তৈরি হয়েছে।
৭. বিএনপি ক্ষমতাকেন্দ্রের কৌশলগত শক্তিশালী জায়গাগুলোতে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রীয় নীতির ক্ষেত্রে জামায়াত বিএনপিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে বলেও অনেকে মনে করেন। ক্ষমতাসীন অবস্থায় ভারতের জন্য অস্বস্তিকর কিছু নীতি জামায়াত প্রভাবিত হয়ে নেওয়া হয়েছিল বলেও মনে করা হয়। বিশেষ করে, তখন জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবীরা খোলাখুলিভাবে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের স্বাধীনতাকামীদের পক্ষ নেওয়ার কথা বলে এসেছেন। এতে বিএনপি কতটা প্রভাবিত হয়েছে বোঝা না গেলেও জামায়াত হয়তো প্রভাবিত হয়েছিল। জামায়াত নেতারা কোনো কোনো জঙ্গীগোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলেছেন। ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে জামায়াতকে অনেকে দায়ী করেন।
এখন কথা হলো, জামায়াত অবশ্যই ভারত-বিরোধী রাজনীতি করতে পারে। কিন্তু শাসক দল হিসেবে বিএনপির জন্য এই নীতি নেওয়া কঠিন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে খুবই ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলেও সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। দ্বিতীয় বার এসে কেন সেটি খারাপ হলো, সেটি পর্যালোচনা করে দেখা দরকার। ভারত কেন জামায়াতের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিকে হুমকি মনে করলো সেটি ভাবা দরকার। এটি করলেই বোঝা যাবে, প্রতিবেশী হয়েও তারা কেন সব ডিম আওয়ামী লীগের ঝুড়িতেই রাখলো।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের সবচেয়ে বড় মূল্য নিয়েছে ন্যাটো বাহিনীর সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ। জামায়াতের কারণেই বিএনপি ইসলামপন্থী বলে ট্যাগ খেয়ে ক্ষমতার বাইরে ছিটকে পড়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর দলটি ক্ষমতার বাইরে। এতে বিএনপি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জামায়াত। কেননা, বিএনপি যদি এই সতেরো বছরে এক টার্মের জন্য ক্ষমতায় আসতো তবে জামায়াতের এত ক্ষতি হতো না। ক্ষমতা থেকে দূরে রেখেও তারা জামায়াতকে সহযোগিতা করতে পারতো। আমি মনে করি, নিজেদের স্বার্থে জামায়াতের উচিত বিএনপির কাছ থেকে দূরে থেকে দলটিতে সমর্থন দিয়ে যাওয়া। যুগপৎ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া। কিন্তু জামায়াতের নীতিনির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীরা এখনও মনে করেন বিএনপির সঙ্গে জোট গড়ে একসাথে চলা উচিত। বিএনপির জামায়াতপন্থীরাও একই কথা মনে করেন। কিন্তু এতে আসলে বিএনপির ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনাই শুধু কমবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আপাতত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ থেকে সরে এলেও ইওরোপ মানিসকভাবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ থেকে সরে আসেনি। ভারত ও ইসরায়েল এখনও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের মধ্যে রয়ে গেছে। গাজায় ইসরায়েলী হামলার সময় ঠিক বোঝা গেল না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলেই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ থেকে সরে এসেছে কি না। জামায়াত অবশ্যই জঙ্গী সংগঠন নয়, কিন্তু কোনো অজানা কারণে তারা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ভিকটিম। সেটি তারা অবশ্যই পর্যালোচনা করবে। কিন্তু এখন তাদের উচিত, বিএনপির হাত ছেড়ে দেওয়া। যাতে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ থেকে পাকাপোক্তভাবে বেরিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে।
আমি আবারও বলছি, যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিতে জামায়াত, হেফাজত, ইসলামী আন্দোলন অংশ নিলে তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। এখন বাম-ডান-মধ্যপন্থীদের বৃহত্তর ঐক্য হওয়া খুব জরুরি। কিন্তু এজন্য জোট করলে আন্দোলনে ঐক্যের বদলে বিভেদ ও জটিলতা বাড়বে।
সবদিক দিয়ে মনে হয়, যুগপৎ আন্দোলন এখনকার প্রেক্ষাপটে খুব ভাল সমাধান। ২০১৮ সালে যাদের সঙ্গে জোট হয়েছিল তাদের অনেকেই পক্ষত্যাগ করেছেন। ২০২৩ সালে এসে জোট ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন নেই। কষ্ট হলেও জোট গঠনের চিন্তা থেকে বিএনপি ও জামায়াত দুই দলকেই বিরত থাকতে হবে।
তাছাড়া আমার মনে হয় না, জোট গঠন করলেও জামায়াত ২০১৪ সালের মতো মাঠে নামতে পারবে। সেই বাস্তবতা মাঠে নেই। রাজনীতিটাই মাঠে নেই, পরাশক্তিগুলোর বুদ্ধির খেলায় পরিণত হয়েছে। সেই বুদ্ধির খেলার কৌশলে শেষ পর্যন্ত জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। সরকার টিকে আছে তিন পরাশক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। সরকারকে পরাজিত করতে হলে অবশ্যই কোনো এক বা একাধিক পরাশক্তির সহযোগিতাই লাগবে। ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো করে থাকলে হবে না। কথাবার্তা সরাসরি বলতে হবে। এনগেজ হতে হবে।
আর মনে নিতে হবে, বিএনপি ও জামায়াত কখনোই এক রকমের দল নয়। দুটি দুই রকম দল। দল দুইটির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি আলাদা। জামায়াত ছাড়া বিএনপি চলতে পারবে না বা বিএনপি ছাড়া জামায়াত চলতে পারবে না এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে বৃহত্তর প্রয়োজনে দল দুটি সুসম্পর্ক রাখবে। কিন্তু আবারও এই দুই দলের জোটগত মিশ্রণ দল দুটিকে লাভবান না করে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
Discussion about this post