ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দেয় তার মধ্যে অন্যতম হলো, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য সুদসহ ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময় পর ঋণগ্রহীতা যদি ঋণ বা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করে, তবে ওই অনাদায়ী ঋণকে খেলাপি ঋণ বলা হয়। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা এই খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে এক প্রকার দেউলিয়া দশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অনেক পদ্ধতি, কৌশল ও প্রচেষ্টা অবলম্বনের পরও সমাধান আজও হাতের নাগালের বাইরে থেকে গেছে।
নানা ধরনের ছাড় দিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এপ্রিল-জুন সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াল। অর্থাৎ ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। এই সময়টা ঋণখেলাপিদের জন্য স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিতি পেতে পারে। গত ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। আর ১ বছরে (জুন-২২ থেকে জুন-২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি-সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
আমার শিক্ষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এ দুই ঋণকে বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যত দিন ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আলাদাভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে না, তত দিন খেলাপি ঋণও কমবে না। ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদ ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কোনো সরকারই এ উদ্যোগ নেয়নি। খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঘোড়াকে থামাতে হলে ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দের পাশাপাশি তাদের শাস্তি দিতে হবে। তাহলে হয়তো এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। যত দিন এ কাজ করা যাবে না, তত দিন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে খেলাপি ঋণের হার কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় খেলাপি ঋণের হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্দশায় থাকা শ্রীলঙ্কায় খেলাপি ঋণের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে এ হার কম। এমনকি পাকিস্তানেও খেলাপি ঋণের হার বাংলাদেশের চেয়ে কম।
বাংলাদেশ ব্যাংক পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কায় খেলাপি ঋণের হার ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পাকিস্তানে তা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারতে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) ধারণা হলো, ভারতে আগামী বছর খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ৩১টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ফলে সর্বমোট খেলাপি ঋণে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারেনি। আবার কিছু ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল করার পর আবার খেলাপি হয়েছে। একটি ব্যাংকে ৭০০ কোটি টাকার একটি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল। কিন্তু ঋণগ্রহীতা সেটির কিস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে তা আবার খেলাপি হয়ে পড়ে। এ রকম কিছু বড় ঋণ পুনঃতফসিল হওয়ার পরও আবার কিস্তি দিতে ব্যর্থতার কারণে খেলাপি হয়েছে।
অন্য যেসব কারণ রয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখার প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায়, অনাদায়ী ঋণ আদায়ে ২০১৫ সাল থেকে ঋণ খেলাপিদের নানা ধরণের সুবিধা ও বড় বড় ছাড় দিয়ে আসছে সরকার। আবার আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো শর্তের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার শর্ত দিয়েছিল। বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ২০২৬ সালের মধ্যে পাঁচ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামানোর শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের বেশি। সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারও নির্ধারিত মাত্রার ওপরে। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে এই অক্টোবরে আইএমএফের প্রতিনিধিদের দেশ আসার কথা রয়েছে।
এমন অবস্থায় খেলাপি ঋণ কম কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা নীতির ঘোষণা দেয়। সবশেষ মেয়াদী ঋণের কিস্তির অর্ধেক শোধ করতে পারলেই তাদের আর ঋণখেলাপি বলা হবে না- এমন সুযোগও দেওয়া হয়। কিন্তু বার বার সুবিধা দেওয়া হলেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনীতে সেই সুযোগ যেন আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরে জাতীয় সংসদে ওই আইনের সংশোধনীতে বলা হয়েছে, এখন থেকে খেলাপিরাও ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। নতুন আইনের কারণে খেলাপিদের নতুন ঋণ পেতে সমস্যা হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নিচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ থাকা মানে, ব্যাংক ওই বিনিয়োগ থেকে কোন লভ্যাংশ পায় না, ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়। ব্যাংকে টাকার পরিমাণ কমে গেলে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে ব্যাংকের নতুন করে ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। এতে নতুন করে বিনিয়োগ কমে যায়, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে। ফলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এক কথায় খেলাপি ঋণের প্রভাবে ব্যাংকিং খাত ও রিজার্ভসহ সব ধরনের আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ব্যাংকের টাকা অর্থনীতিতে ‘জ্বালানির মতো’ কাজ করে।
এই খাতের বড় অংকের টাকা ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে গেলে গোটা অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ব্যাংকের মুনাফার ওপর যদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাহলে স্বাভাবিকভাবে সরকার ব্যাংকের থেকে কম কর পায়। আর সরকার কম কর পেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় খাতে ব্যয় কমে যাবে। যা এটি চক্রাকার প্রতিক্রিয়ায় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। এছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নেও সরকার ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ করতে পারবে না, বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে। সেইসাথে যে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনছেন তাদের শেয়ারের দাম কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব ব্যাংকিং খাতে এসে পড়ছে।
খেলাপি ঋণ মানুষের জীবনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবেই প্রভাব ফেলে। উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যাংক ঋণ দিলেও এই ঋণের অর্থ উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার না হওয়ায় তা সরাসরি মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। আবার খেলাপিঋণ যত বাড়বে, ততোই সরকারের বাজেটে ঘাটতি হবে। খেলাপিদের চাপে ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে পারবে না। সুতরাং ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে বেশি টাকা ছাপাবে। তখন সেটাও পরোক্ষভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। এই ঋণের অর্থ যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হতো তাহলে টাকার বিপরীতে পণ্য বাজারে থাকতো। তাহলে মুদ্রাস্ফীতি হতো না। আবার খেলাপি ঋণের প্রভাবে ব্যাংকের সাধারণ আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা ব্যাংকে টাকা রাখলে লাভ পাচ্ছেন কম, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ পোষাতে আমানতকারীদের লাভের হার কমিয়ে দিচ্ছে। অপরদিকে ভালো ব্যবসায়ীরাও ঋণ পেতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন। তাদের ওপর বেশি সুদ চাপানো হচ্ছে। অথচ এই ব্যসায়ীরা যদি ঋণ পেতো দেশের উৎপাদন বাড়ত। তার মানে ভালো ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছে না। সুদের হারটাও সরকার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।
খেলাপি ঋণ সরকারের কর ব্যবস্থাপনাকেও প্রভাবিত করে। খেলাপি ঋণের ফলে সরকারের বাজেটে যে ঘাটতি হবে, তখন ভারসাম্য তৈরি করার জন্য সরকারের কর বৃদ্ধি করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। সেটিও হবে পরোক্ষ কর, যা সব শ্রেণী পেশার মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যদি প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে ওই খেলাপিদের থেকে কিছু টাকা আদায় করা যেতো তাহলে লাভ হতো। কিন্তু সরকার নিচ্ছে পরোক্ষ কর বা ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স। তার মানে একজনের দোষ আরেক জনের ওপর চাপানো হচ্ছে। সরকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সাধারণ মানষের ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
খেলাপি ঋণের সাথে টাকা পাচারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই টাকাগুলোর একটা বিরাট অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় বদলে নিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়। ফলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ তৈরি করছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের আমানতের ওই টাকা দেশের কোনো উপকারে আসে না।
তবে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক নেতা, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ঋণগ্রহীতার পারস্পরিক যোগসাজশে দেওয়া হয় এসব ঋণ। কাজেই খেলাপি ঋণ কমাতে হলে ব্যাংকগুলোয় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তথা এমডি ও অন্যান্য পরিচালকের দায়িত্বের বিষয়টি অনস্বীকার্য। তবে এ ব্যাপারে ব্যাংক খাতের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বও কম নয়। বস্তুত এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককেই পালন করতে হবে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা।
দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই আইন শিথিল করে দেওয়া হয়। এতে দুর্নীতিবাজ ব্যাংকারদের জন্য আরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। অথচ ব্যাংকগুলোতে কোথায় কী অনিয়ম হচ্ছে, তা দেখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। অনিয়ম বন্ধ হয়ে ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে খেলাপি ঋণ কমে আসতে বাধ্য। খেলাপি ঋণের কারণে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোই যে সমস্যায় পড়ছে তা নয়, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
Discussion about this post