১০ বছর পূর্ণ করেছে চীনের যুগান্তকারী বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। একটি বাণিজ্যিক রুটের মাধ্যমে চারটি মহাদেশকে যুক্ত করা এবং বিপুল সংখ্যক শিল্প কারখানা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্প শুরু হয় ২০১৩ সালে। এটিকে চীন একটি বাণিজ্যিক পদক্ষেপ হিসেবেই শুরু করে। পুরনো সিল্ক রুটকে আবার জাগিয়ে তুলতে চেয়েছে তারা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে চীন পশ্চিমা বাণিজ্যিক শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়, পাশাপাশি বাণিজ্যের সীমা ছাড়িয়েও প্রকল্পটি বিশ্বব্যাপী চীনের আধিপত্য বিস্তারের একটি উপলক্ষ। এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়া বিভিন্ন দেশকে প্রচুর ঋণ দিয়েছে বেইজিং। সমালোচকরা বিষয়টিকে উপস্থাপন করছেন, ঋণের ফাঁদ হিসেবে। যার উদ্দেশ্য বিভিন্ন দেশের ওপর চীনা প্রভাব মজবুত করা। মোট কথা, বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্প যে একটি ভূরাজনৈতিক উদ্যোগ সেটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর বিশেষজ্ঞরা এই মহাপ্রকল্পকে ভূরাজনৈতিক উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করতেই বেশি পছন্দ করেন।
যেভাবে শুরু ও বিস্তার
২০১৩ সালে কাজাখস্তান সফরে গিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সর্বপ্রথম এমন একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সড়ক ও নৌপথে পণ্য পরিবহনের একটি মাস্টারপ্ল্যান হিসেবে তিনি এটির কথা জানান। একই সাথে এ সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণ শুরুর ঘোষণা দেন। এর একটি রুট নির্ধারণ করা হয় চীনের উত্তরাঞ্চল থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে তুরস্ক ও রাশিয়াকে যুক্ত করে পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত। আরেকটি রুট নির্ধারণ করা হয়, চীনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে শুরু হয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ হয়ে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য পাড়ি দিয়ে গ্রিস হয়ে পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত।
শি জিনপিং জানান, এই প্রকল্প দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাথে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশকে যুক্ত করবে। প্রকল্পের মূল কাজগুলোর মধ্যে ছিল- বিভিন্ন দেশে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, সেতু তৈরি, শিল্প করিডোর ও অন্যান্য স্থাপনা গড়ে তোলা। ভারত মহাসাগর ছিল এই প্রকল্পের প্রস্তাববিত একটি রুট। মোট কথা, বিশ্ব বাণিজ্যের চেহারা বদলে দিতেই চীনের প্রেসিডেন্ট এই পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার কথা জানান শুরু থেকেই।
শুরুতে এটির নাম রাখা হয় ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’। ২০১৫ সাল থেকে নাম হয় বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। শুরুতে এই প্রকল্পের ৫টি মূলনীতি ছিলো- ১. নীতিগত সমন্বয়, ২. অবকাঠামোগত সংযোগ, ৩. বাণিজ্য, ৪. আর্থিক একত্রীকরণ এবং ৫. নাগরিক পর্যায়ে সংযোগ। পরে ষষ্ঠ নীতি হিসেবে এর সাথে যোগ হয় ‘শিল্প সহযোগিতা’। মূলত এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন তাদের উদ্বৃত্ত মূলধন ও শিল্পক্ষেত্রে অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা বিষয়ক উদ্বেগের সমাধান চেয়েছে। সাথে এসব অঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টিও ছিল।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয় ৫৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) হিসাব বলছে, ২০২৭ সাল নাগাদ এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হতে পারে আরো ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে চীন ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে বিআরআই ফোরাম আয়োজন করেছে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিশ্বনেতা এসব ফোরামে উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। দেশগুলোর মাঝে বহু চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে এসব ফোরামে।
১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চলতি বছর চীন জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ১৫০টির বেশি দেশ এবং ৩০টি আন্তর্জাতিক সংস্থা বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই উদ্যোগের অধীনে ৩ হাজার ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে, যার মূল্যমান ১ ট্রিলিয়ন ডলার। ছয়টি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করিডোর চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে। এগুলো হলো, চীন-মধ্যএশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য করিডোর, চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া করিডোর, চীন-ইন্দোচীন উপদ্বীপ করিডোর, চীন-পাকিস্তান করিডোর ও বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর।
মিশন ‘গ্লোবাল সাউথ’
বেল্ড এন্ড রোড প্রকল্প ইউরোপ ও মধ্য আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছে গেলেও এর মাধ্যমে চীন মূলত বিশ্বের ‘দক্ষিণাংশকে’ নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে চাইছে বলে মনে করা হয়। এই অংশের মধ্যে রয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা মহাদেশ। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কেনেডি স্কুলের গবেষক হং ঝাং এর মতে, চীন এই প্রকল্পের মাধ্যমে এটি প্রমাণ করতে চায় যে, বিশ্বকে উন্নয়নমুখী করতে যেসব দেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে তারা তার মধ্যে একটি। একই সাথে পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে সহায়তার জন্য মানবাধিকারসহ বিভিন্ন শর্ত দিয়ে থাকে- চীন সেগুলো নিয়ে সমালোচনার সুযোগটি কাজে লাগাতে চায়। কারণ তারা সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের শাসন ব্যবস্থা, গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো শর্ত আরোপ করে না।
জার্মানির হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির চীনা সহায়তা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা বিশেষজ্ঞ মারিনা রুডিয়াক এর মতে, চীন এই প্রকল্পের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিশ্বে এক নম্বর হতে চায় না ঠিকই, তবে তারা নিজেদের বিকল্প একটি শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করছে। বিশেষ করে তারা যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশে দাঁড়াচ্ছে সেটির প্রমাণ দিতে চায়।
কে কীভাবে দেখছে
রাশিয়া শুরু থেকেই এই প্রকল্পের সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করে আসছে। দেশটি ইতোমধ্যেই যুক্ত হয়েছে প্রকল্পে। চীন থেকে মঙ্গোলিয়া হয়ে রাশিয়ায় সড়ক পথে পণ্য পরিবহণও শুরু হয়েছে বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পের অধীনে। চলতি বছর বেল্ট এন্ড রোড ফোরামে যোগ দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তার বিদেশ ভ্রমণ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও এরকম একটি বাণিজ্যিক ফোরামে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের যোগদান বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে চীন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা যে আরো বেড়েছে সেটিও দেখানোর একটি উদ্দেশ্য হয়তো ছিল পুতিনের চীন সফরে।
চীনের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত এখনো এই প্রকল্পে যুক্ত হয়নি। বিআরআই-এর কোনো ফোরামেও যোগ দেয়নি ভারত। বরং এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘণের অভিযোগ তুলেছে নয়া দিল্লি। কারণ পাকিস্তান-চীন অর্থনৈতিক করিডোর চলে গেছে আজাদ কাশ্মীরের ওপর দিয়ে। ভারত যেহেতু কাশ্মীরের পুরোটাই নিজেদের বলে দাবি করে, সে হিসেবে তারা আজাদ কাশ্মীরের ওপর দিয়ে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক করিডোর প্রবেশ মেনে নিতে পারছে না। ভারত এই প্রকল্পে ‘ঋণের ফাঁদ’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
পাকিস্তান ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা যোগ দিয়েছে এই প্রকল্পে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর একশ বছরের জন্য লিজ নিয়ে পুনঃনির্মাণ করেছে চীনা কোম্পানি। যেটিকে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের আশঙ্কা হিসেবে দেখছেন চীনের বিরোধী শিবির। বাংলাদেশ এখনো এই প্রকল্পে যোগ দেয়নি। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাংক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউজ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে চীনের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৭.০৭ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে বিভিন্ন চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের নির্মাণ ঠিকাাদারির কাজ পেয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গত ১০ বছরে বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পের অধীনে চীন ৩৫টি প্রকল্পে ৪.৪৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে (সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে পোল্যান্ড, গ্রিস, পর্তুগাল, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ড যোগ দিয়েছে বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভসে। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা মহাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু দেশ যুক্ত হয়েছে প্রকল্পটিতে। পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ দেশও নাম লিখিয়েছে এই তালিকায়। মধ্যপ্রাচ্যের ইরান, সৌদি আরব, মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশও যুক্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের উল্লেখযোগ্য কিছু দেশ এই প্রকল্প নিয়ে ভারতের মতোই অবস্থানে রয়েছে। তাদের অভিযোগ এই প্রকল্পের নামে চীন আফ্রিকা ও এশিয়ার স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে ঋণের লোভ দেখিয়ে নিজের দল ভারি করছে। এর মাধ্যমে চীন বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের প্রভাব জোরালো করতে চায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই সরাসরি এই প্রকল্পকে ‘ঋণ ও ফাঁসের চুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
তবে পশ্চিমা বিরোধীতা সত্ত্বেও চীনের এই মহাপ্রকল্প যে মহাসমারোহে এগিয়ে চলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতি বছরই নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণ কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে, যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন দেশ কিংবা সংস্থা।
Discussion about this post